সময় প্রকাশনের আয়োজনে নিউইয়র্কে হুমায়ূন কবিরের দুটি গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা
বিশেষ প্রতিনিধি ॥ হুমায়ূন কবির তার লেখায় যা বলছেন- তা আমাদের যাপিত জীবনের নিঃশ্বাস। প্রবাসে থেকেও তিনি সাহিত্যের বীজ বুনে যাচ্ছেন। একজন শিল্পীর ব্যর্থতার দায় বিচার করে সময় ও পাঠক। সময়ই সবচেয়ে বড় বিচারক। এমনও দেখা গেছে, ৪০০ বছর পরও পঠিত হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম। কবি চন্দ্রাবতীর ‘রামায়ণ’ আমাদের কাছে উজ্জ্বল উদাহরণ। কথাগুলো বলেছেন বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
তিনি, সময় প্রকাশনের উদ্যোগে নিউইয়র্কে হুমায়ূন কবিরের দুটি গ্রন্থ ‘তীর্থ যাত্রী তিনজন তার্কিক‘ ও ‘এক জীবনের কথা‘-নিয়ে আলোচনায় এই মন্তব্য করেন।
২৩ মে ২০১৬ সোমবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্কে জুইশ সেন্টার- মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় এই মনোজ্ঞ সাহিত্য আলোচনা। বিশিষ্ট টিভি ব্যক্তিত্ব বেলাল বেগ-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সেলিনা হোসেন।বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রতিভাবান লেখক আনিসুল হক। প্রধান আলোচক ছিলেন খ্যাতিমান লেখক, সাহিত্য সমালোচক হাসান ফেরদৌস।
অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশ নেন, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ‘শব্দঘর’ সম্পাদক মোহিত কামাল, কবি ফকির ইলিয়াস ও লেখক সিনহা মনসুর।
অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য রাখেন লেখক আবু রায়হান। তার পরই তিনি মাইক তুলে দেন সময় প্রকাশনের কর্ণধার ফরিদ আহমেদ এর হাতে। পুরো অনুষ্ঠান উপস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন ফরিদ আহমেদ।
আলোচনায় অংশ নিয়ে মোহিত কামাল বলেন, হুমায়ূন কবির তার লেখায় নিজের মতো করে দাঁড়াতে চেয়েছেন। তার লেখায় কাব্য-গদ্যের মিশ্রণ আছে। তিনি ভিন্ন মাত্রায় নিজেকে চিহ্নিত করার প্রয়াস নিয়েছেন। তিনি বলেন, হুমায়ূন কবির পেশায় চিকিৎসক হলেও মননে একজন সমাজচিন্তক,লেখক। তার লেখায় সেই সাক্ষ্য আমরা পাই।
লেখক সিনহা মনসুর বলেন, হুমায়ূন কবির তার ‘এক জীবনের কথা’ আমাদের জীবনের আখ্যানকে চিত্রিত করেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে। তার লেখা প্রচণ্ড খরায় এক পশলা বৃষ্টি। তিনি বলেন- আমরা স্বপ্ন দেখি বাংলায়। আমাদের স্বপ্নে সেই বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ঘুরে ফিরে আসে বারবার।মানবিক সম্পর্ক নিয়েই এই লেখকের সাহিত্যকর্ম।
কবি ফকির ইলিয়াস তার বক্তব্যে, লিটলম্যাগাজিন ‘ঘুংঘুর’এর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, ‘ঘুংঘুর’ এর সম্পাদনা পরিষদের সদস্য হিসেবে আমি বলতে পারি, হুমায়ূন কবির একজন সুসাহিত্যিক, যিনি প্রতিটি মুহুর্তে চান- তার সমাজ এগিয়ে যাক, তার প্রজন্ম এগিয়ে যাক।
হুমায়ূন কবিরের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, এই কবি নতুন করে দেখার চেষ্টা করেছেন। তাকাবার সাহস সকলের থাকে না। তিনি সেই সাহস দেখিয়ে আমাদের শাণিত করেছেন। তার কবিসত্তা আমাদের জাগ্রত বিবেকের প্রতীক, যোগ করেন কবি ফকির ইলিয়াস।
প্রধান আলোচক হাসান ফেরদৌস বলেন- ‘তীর্থ যাত্রী তিনজন তার্কিক‘ বইটি বুঝতে আমার কষ্ট হয়েছে। কারণ এটি না গদ্য-না পদ্য কোনো ক্যাটাগরিতে পড়েনি। আমার কাছে মনে হয়েছে বইটি, ‘উইজডম অব উইজডম’।
তিনি বলেন- পাঠক একটি বই পড়ে এগোতে না পারলে তা কন্টিনিউ করবেন কেন ? এই বইয়ে অনেক কিছুই অস্পষ্ট মনে হয়েছে আমার কাছে।বিশদ বর্ণনা নেই বইটিতে। জ্ঞানের বিষয়ে জ্ঞান দান করে বই লেখা যায় কী না তা নিয়ে সন্দেহ আছে আমার।
হাসান ফেরদৌস বলেন, এই গ্রন্থে লেখক জীবনের মধ্য দিয়ে আসেন নি। অনেক কিছুই এসেছে আরোপিত হয়ে। তিনি একটি প্যারাবল তৈরি করতে চেয়েছেন। যা দুঃখবোধের বিভিন্নতায় পুষ্ট বটে। তবে তিনি শিল্পের ভেতর ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছেন।
হাসান ফেরদৌস বলেন, শিল্পীর কাজ হচ্ছে মানবিক অভিজ্ঞতা আঁকা। হুমায়ূন কবির সেই চেষ্টায় আরও কৌশলী হতে পারতেন। তবে তার বলার ভঙ্গি আমাদের কাছে টানে।
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন- ফুলের সুঘ্রাণ কি, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। কবিতা পড়ে কি বুঝা যায়- তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। মন ভালো করাই শিল্পের কাজ। মন খারাপ করাও শিল্পের কাজ। তিনি বলেন, মানুষ সাড়ে তিন হাত। কিন্তু আমরা কেউই সাড়ে তিনহাত ঘর বানাই না। আমাদের পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। হুমায়ূন কবির তার লেখায় সেই পরিচর্যা আমাদের দেখিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এক জীবনের কথা‘ গ্রন্থটি উপন্যাসের উপন্যাস। লেখকের বেদনা একান্তই নিজস্ব।
তিনি বলেন, আমরা-লেখকরা অনেক কিছুই থামাতে পারি না। তারপরও কেন লিখি। আমি মনে করি শিল্পী-সাহিত্যিক হওয়া মানেই ব্যর্থ হওয়া। ব্যর্থতার চাকর জীবন কাটানো। তিনি বলেন, ‘তীর্থ যাত্রী তিনজন তার্কিক‘ কোনো ফর্মে পড়ে না। আর পড়ে না বলেই এটি একটি ভালো বই। একজন উপন্যাসিক ইতিহাসবিদ নন। তিনি অস্তিত্বের পরিব্রাজক। হুমায়ূন কবির আমাদের আনন্দ দিতে চেয়েছেন তার সাহিত্যে। সেই অভিপ্রায়কে আমাদের সম্মান জানাতেই হবে।
প্রধান অতিথি সেলিনা হোসেন বলেন, দ্যা ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’ আমার পছন্দ হয়নি। আর এটাই হলো একজন পাঠকের স্বাধীনতা, দর্শকের স্বাধীনতা। তিনি বলেন, ‘এক জীবনের কথা‘ বইটি আমি নিজে পড়েছি। আমি আমার স্বামী বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খানকেও বইটি পড়তে দিয়েছিলাম। তিনিও পড়েছেন। আমি বইটি পড়ে অবিভূত হয়েছি। চমৎকার বর্ণনায় তিনি দেশ বিভাগের কথা তুলে ধরেছেন। তার এই বইয়ে নাপিত গোপালের কি হবে ! হিন্দু গোপালের কি হবে- এই প্রশ্নটির উত্তর কি আমরা এখনও দিতে পেরেছি ?
তিনি বলেন, তার এই বইয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ এসেছে উজ্জ্বলভাবে। যা আমাদের প্রজন্মের জানা দরকার। আমি আশা করবো, হুমায়ূন কবির তার নিজস্ব চিন্তা নিয়ে দাঁড়াবেন। তিনি তার মতো করে জীবনের চিত্রায়ন সম্পন্ন করবেন তার লেখায়।
গ্রন্থ দুটির লেখক হুমায়ূন কবির বলেন- আমি সম্মানিত আলোচকদের ভাষ্য থেকে অনেক কিছু জেনে গেলাম। শিখলাম। প্রশংসা মানুষকে শেখায় না- সমালোচনাই একজন লেখকের অন্যতম পাথেয়। আমি মনে করি- খণ্ডচিত্র থেকেই পূর্ণ বিনির্মাণ। আমি হয়তো পুরোটি পারিনি। আমি মনে করি, তীর্থ বলে কোনো জায়গা নেই। মূলত আমরা সবাই যাত্রী। আসলে আমাদের জীবনটাই এ্যাবস্ট্রাক্ট।
হুমায়ূন কবির তার সহধর্মিনী স্বপ্না কবিরকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, আমার লেখালেখির সময়টা ওর কাছে থেকেই চুরি করা। তার প্রেরণা আমাকে সাহায্য করে প্রতিক্ষণ। তিনি সময় প্রকাশনকে এরকম একটি আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
অনুষ্ঠানের সভাপতি বেলাল বেগ বলেন, হুমায়ূন কবিরের লেখায় দর্শন আছে। তার সাহিত্য তিনি উপজীব্য করে তুলেছেন গণমানুষের জন্য। যারা আমাদের শ্রেণীচরিত্রের প্রধান শক্তি। তার লেখা আমাদের ভাবায়। এটাই একজন লেখকের মূল কাজ।
তিনি বলেন- বাঙালীর চিরন্তন মূল্যবোধ হলো, সবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই। এই লেখক তার প্রতিটি লেখায় সেই চেতনার স্ফূরণ ঘটিয়েছেন।
ধন্যবাদ জ্ঞাপনপর্বে সময় প্রকাশনের কর্ণধার ফরিদ আহমেদ বলেন, আমি কৃতজ্ঞ নিউইয়র্কে এমন একটি চমৎকার আয়োজন করতে পেরেছে- সময় প্রকাশন। আমরা ভবিষ্যতেও এমন উদ্যোগ নেবার কথা ভাববো।
তিনি বলেন, ‘সময়’ সবসময় লেখাকে গুরুত্ব দেয়। আজ থেকে বিশ বছর আগে এই নিউইয়র্ক থেকে একজন কবি ‘সময় প্রকাশন’কে পাণ্ডুলিপি পাঠান। তখন নিউইয়র্কে প্রকাশকদের পদচারণা তেমন জমে উঠেনি। আমি যেহেতু সেই কবি সম্পর্কে জানতাম না, তাই তার বিষয়ে ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবালের কাছে জানতে চাই। তিনি প্রথম কথায়ই বলেন- আপনি এই কবির বই ছাপতে পারেন। তিনি আজকের কবি ফকির ইলিয়াস। ‘সময় প্রকাশন’ এভাবেই দেশে ও প্রবাসের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরি করে এগিয়ে যাচ্ছে। এই ধারা আগামীতে আরও ব্যাপৃত হবে, বলেন ফরিদ আহমেদ।
অনুষ্ঠানে উত্তর আমেরিকার বিশিষ্ট জনেরা অংশগ্রহণ করেন। রাতে আহারপর্বের মাধ্যমে শেষ হয় আয়োজন।