এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে পিতা দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরী ও তার পুত্র নাট্যকার ড. মুকিদ চৌধুরীর মোট পাঁচটি বই।
এর মধ্যে দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরীর (১৯২৯-১৯৯৬) প্রয়াণদিবস (২৩ ফেব্রুয়ারি) ও জন্মদিবস (১ মার্চ) উপলক্ষ্যে অনিন্দ্য প্রকাশ নিয়ে এসেছে ‘স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা (আগস্ট ১৯৪৭ – মার্চ ১৯৭১)’ গ্রন্থটি। স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা গ্রন্থের মূল উপজীব্য বাংলাদেশের ইতিহাস (আগস্ট ১৯৪৭ – মার্চ ১৯৭১)। স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা গ্রন্থে অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ-পর্যালোচনা-গবেষণা-তথ্য ও সহজপাঠ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাস (আগস্ট ১৯৪৭ – মার্চ ১৯৭১) অনুধাবনের চেষ্টা করা হয়েছে। ইতিহাসের কলেবর অযথা বৃদ্ধি না করে, গবেষণা ও উপযোগী তথ্য নির্দিষ্ট পরিধির মধ্যে সীমিত রেখে, প্রয়োজন অনুযায়ী ও নির্বাচিত ঘটনাবিষয়ের ওপর যথোপযুক্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। স্থান-কাল-দেশের পরিপ্রেক্ষিতে, লেখকের সমকালীন ইতিহাসের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ-পর্যালোচনা-গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর পারঙ্গমতা প্রশ্নাতীত। তাঁর অভিজ্ঞতা, সংস্কাররুচিপ্রবণতা, তথ্যসংগ্রহ ও বিচারবিশ্লেষণব্যাখ্যা এই গ্রন্থটির মূল্য ও মর্যাদাকে অন্যস্তরে উন্নীত করেছে। আর তাই এই গ্রন্থে ঐতিহাসিক মূল্যায়ন হয়ে ওঠেনি কোনো বিতর্কিত অপব্যাখ্যা। এখানেই স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা গ্রন্থটির অভিনবত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। বাঙালি জাতি গঠনে স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতার ইতিহাস (আগস্ট ১৯৪৭ – মার্চ ১৯৭১) অপরিহার্য। বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ১৮০০ টাকা।
পাশাপাশি আব্দুর রউফ চৌধুরীর পুত্র নাট্যকার ড. মুকিদ চৌধুরীর চারটি বই এসেছে এবারের গ্রন্থমেলায়। সেগুলো মধ্যে আগামী প্রকাশনী নিয়ে এসেছে ড. মুকিদ চৌধুরীর ‘জার্মানি (অতীত ও বর্তমান)’ বইটি। এখন জার্মানি বলতে জার্মান জাতির আবাসভূমি বোঝানো হয়, তবে জার্মান জাতি বলতে যা বোঝায় তা অতীতে অনেক ব্যাপক ছিল, কেননা অস্ট্রিয়া, হল্যান্ডসহ ইউরোপীয় কিছু দেশের অনেক লোকই জার্মান জাতির অন্তর্ভুক্ত। খ্রিষ্টপূর্বের রোমান ঐতিহাসিকদের রচনায় জার্মান জাতি ছিল বর্বর, মদ্যসিক্ত ও যুদ্ধপ্রিয়। শিল্পসাহিত্যে জড়িত ছিল না। তাদের ছিল প্রভুভক্তি, সাহস ও বিক্রম। ফ্যাংকীয় উপজাতিই প্রথমে রোমান ভাষা, ধর্ম, রীতিনীতি আয়ত্ত করে রোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপ থেকে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। অটো ফন বিসমার্ক, ১৮ জানুয়ারি ১৮৭১, নতুন রাষ্ট্র জার্মানির জন্ম দেন। অতঃপর ইউরোপীয় রাজনীতিতে ফ্রান্সের শক্তি ও মর্যাদা ক্ষুন্ন করে জার্মানির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর দানবের মতো বিশাল পদক্ষেপে শিল্পজগতে প্রবেশ করে। রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ, অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ, কৃষি সাম্রাজ্যবাদ ও সমরতন্ত্রের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। নেমে আসে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে জার্মানি হয় দুইভাগে বিভক্ত- পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি। নির্মিত হয় বার্লিন প্রাচীর। ১৯৯০-এ বার্লিন প্রাচীর ভেঙে দুই জার্মানি সংযুক্ত হয়। জার্মান জনগোষ্ঠী ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে অনেক অবদান রেখেছে ও রাখছে। জার্মানিতে অনেক লেখক, শিল্পী, স্থপতি, সংগীতজ্ঞ এবং দার্শনিক জন্মগ্রহণ করেছেন। জার্মানি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। জার্মানির সুদীর্ঘ ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, কূটনীতি, আর্থসামাজিক, গণতান্ত্রিক ও মানবিক দিকগুলো এই গ্রন্থে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। সমগ্রভাবে জার্মানির বিবর্তনের ইতিহাস বাংলা সাহিত্যের প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হিসেবে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ও চমকপ্রদ দলিল। বইটির মূল্য ১৮০০ টাকা।
এছাড়া অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে ড. মুকিদ চৌধুরীর দুটি বই। সেগুলো হলো- ‘জার্মান সাহিত্য (প্রারম্ভ থেকে অধুনা)’ ও ‘ আটই ফাল্গুন’। জার্মান সাহিত্যের ব্যাখ্যামূলক ধারাবাহিক বিবরণ ‘জার্মান সাহিত্য (প্রারম্ভ থেকে অধুনা)’ বইটিতে পাওয়া যায়। এটি জার্মান সৃজনশীল চিন্তাধারার এক পরিপূর্ণ ইতিহাস। জার্মান ভাষায় লিখিত সাহিত্যের ভিত্তি প্রস্তুত হয় মৌখিক কাব্য উত্তরাঞ্চলীয় কিংবদন্তির মধ্য দিয়ে। সপ্তম শতকে লেখা হিলডেব্রানডের কীর্তন থেকে শুরু করে উচ্চজার্মান ও ব্যারোক যুগ হয়ে ক্যানট, লেসিং, ক্লোপস্টক, হারডার, ক্লিংগার (তুফান ও তাড়ন), ভাগনার, গ্যেটে, শিলার, ফিশচে, নোভালিশ, ক্লাইস্ট, কার্ল মার্কস, কাফকা, ম্যান, ব্রেশট, রেমার্ক, গ্রাস, মুলার প্রমুখ কথাসাহিত্যিক, কবি, দার্শনিকের রচনার নিদর্শন এই গ্রন্থে দেওয়া হয়েছে। জার্মান সাহিত্যের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য, মানবিকতাবোধ, সমাজব্যবস্থার সমালোচনা- কখনও উগ্র, কখনও-বা বৈপ্লবিক; যুক্তিবোধের সঙ্গে দেশের ও দশের মঙ্গলসাধন; ন্যায়পরায়ণতা ও গণতান্ত্রিক প্রত্যয়, পুঁজিতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা- সামগ্রিকভাবে এই গ্রন্থে জার্মান সাহিত্যের বিবর্তন ও ক্রমবিকাশ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। গ্রন্থটি স্বাতন্ত্র্য, অভিনব, সার্থক, সরস ও তথ্যপূর্ণ। গুরুত্ব সময়ের দাবির চেয়ে অনেক বেশি। বইটির মূল্য ১৫০০ টাকা।
আর ‘আটই ফাল্গুন’ লেখকের নাট্যোপন্যাস। এই নাট্যোপন্যাসের প্রধান রচিত্র আম্মা। তিনি একজন ভাষাসৈনিক। তিনি দুর্লভ এক নারী। কালকে অতিক্রম করে যান, একইসঙ্গে এগিয়ে দেন প্রবহমাণ কালের ধারাকেও, যে-ধারা মাঝেমধ্যে স্তিমিত হয়, নিস্তরঙ্গ হয়। তিনি লাঞ্ছিত হন, উপহসিত হন, বিরক্তিভাজন হন। আটই ফাল্গুন মাটি-খোয়ানো, অতীত-হারানো ও ঠিকানা খুঁজে-ফেরা আম্মার বুক-ফাটা যন্ত্রণা ও হাহাকারের এক হৃদয়স্পর্শী অজানিত আলেখ্য; একটি বিশেষ দেশ-কালের ইতিকথা, যা সদ্য বিগত, তবুও এখানে সেখানে ছায়া ফেলে রাখে। পটজ্ঞান, চরিত্রচিত্রণের কারুতা, আকীর্ণ মানবপ্রতিমার নির্মাণ, চেতনা, মূল্যবোধ, গল্পচয়নের কুশলতা, জীবন জিজ্ঞাসার ব্যাকুল, সত্যের অনুসন্ধান, রূপসৌকর্য- এসব ড. মুকিদ চৌধুরীর কয়ায়ত্ত। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি স্বতন্ত্র ও উজ্জ্বল। তাঁর আটই ফাল্গুন নাট্যোপন্যাসটি বাংলা কথাসাহিত্যের সম্পদ। বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ৩৫০ টাকা।
অপরদিকে ‘কলকাতায় মির্জা গালিব’ ড. মুকিদ চৌধুরীর একটি বিয়োগান্তক নাটক। এই নাটকে দেখা যায়, গালিব তখন যুবক। কলকাতায় এসেছেন কয়েক বছরের জন্য। এখানেই তাঁর একজন বাঈজির সঙ্গে মাত্র কয়েক দিনের জন্য পরিচয়। ভালোবাসা, মায়া, মমতা, দুঃখ, যন্ত্রণা নিভৃতে ভাষা পায়। হঠাৎ বাঈজি কলকাতা ছেড়ে চলে যায়। গালিবও কলকাতা ত্যাগ করেন, যা অনিবার্য পরিণতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ণয় করে। কাহিনি দাগ কাটে। বাচনিক স্পষ্টতা গভীরতা দান করে। কাহিনির পরিপুষ্টি দানে কুশলতা রয়েছে। নিষ্ঠুরতা, অন্যায়, অসত্য, কলুষও। মানব চরিত্রের বিচিত্র দিক ফুটে ওঠে। ভাষা ঝলমল, সজল, তৃপ্তিকর ও রুচিকর। শব্দ প্রয়োগে কুশলতা ও অব্যর্থতা। মূল চরিত্রের কালজয়ী আবেদনে ও লেখার প্রসাদগুণে কলকাতায় মির্জা গালিব যে সূক্ষ্ম শিল্পসম্মত সাহিত্যসৃষ্টি হয়েছে তা অনস্বীকার্য, তা শরতের নীলাকাশের মতো স্বচ্ছন্দ ও সৌন্দর্যসৃষ্টিকারী। প্রতিকথা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এই বইটির মূল্য ৩০০ টাকা।