রুমন চক্রবর্তী: বাড়ির নাম আনন্দধারা। প্রধান ফটকের পাশে বাড়ির সীমানাপ্রাচীরে ইটপাথরের বদলে শোভা পাচ্ছে বইয়ের মোড়ক। কালজয়ী কিছু বইয়ের মোড়কের আদলে নিজের বাড়ির প্রাচীরটি দৃষ্টিনন্দনভাবে সাজিয়েছেন তরুণ বইপ্রেমী মোহাম্মদ রকিব হাসান।
বইকে ভালোবেসে, বইয়ের প্রতি মানুষের উৎসাহ বাড়াতে ব্যতিক্রম উদ্যোগটি নিয়েছেন তিনি। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার সরারচর ইউনিয়নের কালেখাঁর ভান্ডা গ্রামের এই বাড়িটি দেখতে লোকজন ভিড় করছেন।
বাড়িতে প্রবেশের প্রধান গেটটি ঠিক বইয়ের মতো। গেটের দুপাশের সীমানাপ্রাচীর যেন বিশাল বুকসেল্ফ। যেখানে সাজানো রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মীজীবনী, মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি, কাজী নজরুলের অগ্নিবীণা, সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই, বিভূতি ভূষণের পথের পাঁচালী, সমরেশ মজুমদারের গর্ভধারিণী, জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলির মতো বহু পাঠকনন্দিত বই।
বইপ্রেমী প্রয়াত বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আর বইপড়াকে উৎসাহ দিতে রকিব হাসান এ কাজটি করেছেন। তার ব্যতিক্রমী উদ্যোগ প্রশংসা পাচ্ছে এলাকায়।
তার এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন সরারচর শিবনাথ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক মো. শাহজাহান।তিনি বলেন, রকিব আমার প্রাক্তন ছাত্র। আজ মনে হচ্ছে তাকে বিদ্যান বানাতে আমার যতটুকু শ্রম ছিল তা স্বার্থক। আসলে সে ছোট থেকেই পড়াশোনায় বেশ উদ্যমী। মানুষকে বইয়ের প্রতি আসক্ত করার তার যে প্রয়াস, সেটি অতুলনীয়।আমি আশা করি তার এমন উদ্যোগের ফলে বর্তমান প্রজন্ম অনেক কিছুই জানতে পারবে এবং বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হবে।
বইয়ের আদলে প্রাচীর নির্মাণের পর প্রতিদিনই সেটি দেখতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী সেখানে ভিড় করছেন। শিক্ষার্থীরা বলেন, এমন ধরনের চিন্তা-ভাবনা যিনি করছেন তাকে আমরা সবাই ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এটি তৈরি হওয়ার পর স্কুল শেষে যাওয়ার পথে আমরা প্রায়ই এখানে আসি। এখানে এসে অনেক বইয়ের নাম আমরা লিখেও রাখছি। কারণ এটা তৈরি না হলে বিখ্যাত বিখ্যাত লেখকদের এমন বই সম্পর্কে আমরা জানতে পারতাম না। আমরা শুনেছি উনি এখানে একটি লাইব্রেরিও করবেন, সেটি হলে এখানে এসে বই পড়তে পারবো।
দোতলা বাড়িটি নির্মাণের পর ২০২০ সালে বইয়ের মতো করে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কাজে হাত দেন তিনি। প্রথমে ইটপাথর দিয়ে প্রাচীরের কাঠামো তৈরি করে তার ওপর বসানো হয় স্টিলের পাত। যেখানে বুকসেল্ফের মতো করে সাঁটানো হয় বিভিন্ন বইয়ের মোড়ক। বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত শামছুল হক ভূঁইয়ার ছোটসন্তান তরুণ উদ্যোক্তা রকিব হাসান বইপাগল মানুষ। তার বাবার ছিলো বইয়ের প্রতি দারুন অনুরাগ। ছয় ভাইবোনের সবারই রয়েছে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা। বইপড়া ও জ্ঞানচর্চাকে উৎসাহ দিতেই অভিনব উদ্যোগটি গ্রহণ করেন তিনি।
এই কাজটি করতে ঢাকা থেকে প্রধান কারিগর হিসেবে কাজ করেন এবাদত হোসেন। তিনি জানান, তার দীর্ঘ কর্মজীবনে এমন ধরনের কাজ তিনি কখনও করেননি। রকিব হাসান যখন তার সাথে দেখা করেন এবং এমন একটি পরিকল্পনার কথা তাকে বলেন। তখন থেকেই কাজটি কিভাবে করা যায়, সে বিষয়ে ভাবতে থাকেন। অবশেষে ধীরে ধীরে সকল পরিকল্পনা শেষে প্রায় ছয় মাসে কাজটি প্রায় শেষের পথে কিছু কিছু কাজ বাকি রয়েছে।রকিবের প্রশংসা করে তিনি বলেন, বইয়ের প্রতি একটা মানুষের যে এমন আসক্তি, তার সাথে দেখা না বুঝতেই পারতাম না।
৩৩টি পাঠকনন্দিত কালজয়ী বইয়ের মোড়ক শোভাপাচ্ছে সীমানাপ্রাচীরে। বাড়িটি দেখতে প্রতিদিন দূরদূরান্তের লোকজন ভিড় করছে সেখানে। রেল লাইনের পাশে বাড়িটির সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়, ট্রেনে যেতে যেতেও। অভিনব বাড়িটি দেখে রকিবের সৃজনশীল চিন্তা ও রুচির প্রশংসা করছে সচেতন মহল। এ উদ্যোগ বইয়ের প্রতি সবশ্রেণির মানুষকে আগ্রহী করে তুলবে বলে বিশ্বাস তাদের।
বাড়ির মালিক ও এমন কাজের উদ্যোক্তা রকিব হাসান জানান, বুকসেল্ফের মতো সীমানাপ্রাচীর নির্মাণে দক্ষ কারিগর পেতে অন্তত ছয়মাস খোঁজাখুজি করতে হয়েছে তাকে। তাদের সঙ্গে দিনরাত লেগে থেকে অবশেষে কাঙ্খিত অবয়ব পায় দেয়ালটি। তবে এখানে থেমে থাকতে চান না তিনি। তার বাড়িতে বড়সড় একটি লাইব্রেরি করবেন তিনি। যেখানে বিনা পয়সায় এলাকার তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সী লোকজন বই পড়ে নিজেদের সমৃদ্ধ করবে।