সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা হাসপাতালের চেয়ে প্রাইভেট চেম্বারে রোগিদের বেশি সময় দেন- এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সরকারি হাসপাতাল প্রাইভেট চেম্বার চালু করতে যাচ্ছে।
১ মার্চ থেকে সরকারি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ অফিস সময়ের বাইরে নিজ সরকারি হাসপাতালেই চেম্বারের মাধ্যমে রোগী দেখবেন। চিকিৎসক প্রত্যেক রোগীর কাছ থেকে সর্বোচ্চ ফি ৩০০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ১৫০ টাকা নিবেন।
দেশের ৮৩টি সরকারি হাসপাতালে এই ‘প্রাইভেট চেম্বার’ কার্যক্রম শুরু হবে ১ মার্চ এবং আগামি ৩১ আগস্টের মধ্যে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে এ কার্যক্রম চালু হবে।
প্রাইভেট চেম্বার চালুর বিষয়ে গত ২২ জানুয়ারি একটি কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সাইদুর রহমানকে কমিটির প্রধান করা হয়। প্রথমে ২০ জনকে কমিটির সদস্য করা হয়। পরে আরও ৬ জনকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এ বিষয়ে কমিটির প্রধান সাইদুর রহমান বলেন, আগামি ১ থেকে সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালু হবে। চলতি সপ্তাহে আরো একটি বৈঠক হবে। সেখানে সব কিছু চূড়ান্ত হবে।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, চেম্বারের সময় বেলা ৩ টা থেকে সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত করার পক্ষে মতামত দিয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু বেলা ৩ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়। জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকের ফি ৩০০ টাকা। কনিষ্ঠ চিকিৎসকের ফি ১৫০ টাকা।
৩০০ টাকা ফি থেকে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক পাবেন ২০০ টাকা। তার সহায়তাকারী পাবে ৫০ টাকা এবং বাকি ৫০ টাকা সরকারি তহবিলে জমা হবে। ১৫০ টাকা ফি থেকে কনিষ্ঠ চিকিৎসক পাবেন ১০০ টাকা, চিকিৎসকের সহায়তাকারী পাবেন ২৫ টাকা। বাকি ২৫ টাকা জমা হবে সরকারি তহবিলে।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র আরো জানায়, ১ মার্চ উপজেলা পর্যায়ে ৫০টি, জেলা পর্যায়ে ২০টি, বিভাগীয় পর্যায়ে ৮টি ও বিশেষায়িত ৫টি সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট চেম্বার চালু হবে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ঠিক করা হয়েছে রোগীর উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে। যেসব হাসপাতালে রোগী বেশি আসে, সেখানে এ সেবা চালু করা হবে। আগামী আগস্টের মধ্যে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট চেম্বার চালুর পরিকল্পনা করছে মন্ত্রণালয়।
প্রাইভেট চেম্বারে কনসালটেশন, ডায়াগনস্টিক, ল্যাবরেটরি, রেডিওলজি, ইমেজিং ও সার্জিক্যাল সেবা দেওয়া হবে। চিকিৎসকেরা পালা করে রোগী দেখবেন। একজন অধ্যাপক সপ্তাহে দুই দিন, সহযোগী অধ্যাপক দুই দিন, সহকারী অধ্যাপক দুই দিন রোগী দেখবেন। চিকিৎসক যদি রোগীকে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেন, রোগী চাইলে তা সরকারি হাসপাতালে করতে পারবেন। আবার বেসরকারি হাসপাতালেও করতে পারবেন।
এবিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, নিজ হাসপাতালে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত প্রাইভেট প্র্যাকটিসের পর কোনো চিকিৎসক যদি অন্য কোথাও গিয়ে রোগী দেখেন, সেটি তার নিজস্ব বিষয়। চিকিৎসক চাইলে তা করতে পারবেন।
এবিষয়ে কমিটির সদস্য ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বলেন, আমাদের কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই শুরুতে সীমিত আকারে হয়তো শুরু করবো। পর্যায়ক্রমে এর পরিধি বাড়ানো হবে।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) যখন এই সেবা চালু হয় তখন সবারই ব্যাপক আগ্রহ ছিলো। এর পর সিনিয়র অধ্যাপকরা জুনিয়র মেডিক্যাল অফিসারদের বসিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত চেম্বারে চলে যান। এটার তদারকিতে আর কেউ থাকেন না। বিএসএমএমইউতে যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে সরকারি হাসপাতালগুলোর চিত্র কেমন হবে? তবে সরকার কঠোর হলে সবই সম্ভব।
এবিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, শূন্য পদগুলোতে নিয়োগ দান, চিকিৎসকদের বিকেলে রোগী দেখার জন্য রোস্টার তৈরির পাশাপাশি তাদের ব্যক্তিগত চেম্বার করারও সুযোগ দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বৈকালিক চেম্বারকে মডেল হিসেবে ধরে ধাপে ধাপে এটি চালু করলে ভালো হবে।
এবিষয়ে কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি ডা. মো. জামাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সরকার যেহেতু অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এটিকে বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন, বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও চিকিৎসক সমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাগে এটি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দেশের মানুষের জন্য অত্যন্ত কল্যাণকর এই কাজের শুরুটি হবে মহান স্বাধীনতার মাসের শুরু (১ মার্চ থেকে) থেকেই। এটি শুরু হলে দেশের লাখো মানুষ ক্লিনিক-ফার্মেসিতে ডাক্তার দেখানোর ভোগান্তি থেকে রেহাই পাবে।
উল্লেখ্য, সংসদ সদস্য ও চিকিৎসক অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য থাকাকালে হাসপাতালটিতে এ সেবা চালু করেন। সেখানে এখন বেলা ৩ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকেরা বহির্বিভাগে রোগী দেখেন। রোগীপ্রতি ফি ২০০ টাকা। এর মধ্যে ১৩৫ টাকা পান চিকিৎসক। বাকি ৬৫ টাকা নেন কর্মচারী। এ ব্যবস্থায় রোগীরা লাভবান হচ্ছেন। অথচ বিএসএমএমইউর একজন চিকিৎসককে বাইরের চেম্বারে দেখাতে ফি দিতে হয় ১০০০-১৫০০ টাকা। এতে রোগীদের অনেক টাকা সাশ্রয় হচ্ছে।