শাহীন রহমান: ঢাকার পর পাবনায় মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলার স্থান। লেখক, প্রকাশক, পাঠকদের একটি মিলনমেলায় পরিণত হয় এই বইমেলা। পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল স্বাধীনতা চত্বরে গত ৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় মাসব্যাপী একুশে বইমেলা।
রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) পাবনার বইমেলায় আসেন প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক ও দৈনিক কালের কন্ঠের প্রধান সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন। তার সাথে বইমেলা, পাঠক, লেখক, প্রকাশকসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয়।
ঢাকা এবং পাবনার বইমেলা কেমন দেখছেন, এবছর বইয়ের ক্রেতা কেমন জানতে চাইলে ইমদাদুল হক মিলন বলেন, আমি সারাবছর এই বইমেলার জন্য অপেক্ষা করি। ঢাকায় যে অমর একুশে বইমেলা হয় সেটা আমার জন্য অনেক আকর্ষণীয় ভাল লাগার একটা জায়গা। কারণ, সেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ আসে। প্রচুর বই বিক্রি হয়। শিশুরা আসে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা আসে। ঢাকা থেকে পাবনা বইমেলায় এসে যেটা দেখছি, মানুষ অনেক কিন্তু বইয়ের ক্রেতা কম। ঢাকার অমর একুশে বইমেলায় যে মানুষ সমাগম হয়, তারা প্রত্যেকে যদি একটি করে বই কিনতেন তাহলে বইমেলার স্টল ফাঁকা হয়ে যেতো। কোনো বই থাকতো না। আমি মনে করি পাবনাতেও অবস্থাটা ওরকমই।
তাহলে কি বইপ্রেমী ও পাঠকদের সংখ্যা কমছে বলে মনে করেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে বই কেনাটা দরকার। শিশুদের হাতে বই তুলে দেয়াটা দরকার। আমরা ভাষা রক্ষার জন্য, বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য বুকের তাজা রক্ত দিয়েছিলাম। এখন সেই বাংলা বইয়ের প্রতি যদি মানুষের মমত্ববোধ কমে যায়, তার মানে হচ্ছে বাংলা ভাষার প্রতি তার মমত্ববোধ কমে যাচ্ছে।
পাঠক ও বইপ্রেমীদের প্রতি আপনার আহবান কি জানতে চাইলে ইমদাদুল হক মিলন বলেন, সব শ্রেণির মানুষকে আমি অনুরোধ করবো, তারা নিজেরা বই পড়বেন, প্রিয়জনকে বই উপহার দিবেন, সন্তানদের বই কিনে দিবেন। প্রয়োজনে অপ্রিয়জনকেও বই কিনে দিবেন। অর্থাৎ বইয়ের প্রতি মমত্ববোধটা জন্মানো দরকার। বইয়ের প্রতি মমত্ববোধ জন্মালে মানুষ হওয়ার পথটা আলোকিত হবে। বই আপনার অন্তরটাকে বদলে দেবে, আপনার চিন্তার জায়গাটাকে বদলে দেবে, আপনার বুদ্ধির জায়গাটাকে বদলে দেবে। সুতরাং বইয়ের চেয়ে বড় বন্ধু আর কিছু হতে পারে না।
মানসম্পন্ন বই লেখা হচ্ছে কি না- আপনার কি মনে হয়, জানতে চাইলে ইমদাদুল হক মিলন বলেন, সব লেখা যে মানসম্পন্ন হচ্ছে এটা আমি বলতে পারবো না। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় সারা বাংলাদেশের মানুষ একত্রিত হন। পাঁচ হাজার পর্যন্ত নতুন বই বের হয়। এই পাঁচ হাজার বই কি সব মানসম্পন্ন হতে পারে? আমি মনে করি, তার মধ্যে যদি একশো, দুশো বই মানসম্পন্ন হয় তাতেই আমি খুশি। মানসম্পন্ন বই সবসময় লেখা হবে না।
তবে তরুণ লেখকদের মধ্যে অনেকেই ভাল লিখছেন। কিন্তু সমস্যা হলো এই চার পাঁচ হাজার বইয়ের মধ্যে ভালো লেখকের বই হারিয়ে যায়। খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সেই কারণে আমি মনে করি যে, যারা বইয়ের ক্রেতা, যে পাঠক বই ভালবাসেন, যিনি বই কিনবেন, তিনি নিশ্চয়ই মানসম্পন্ন বইটিই কিনবেন।
যখন একটি প্রতিষ্ঠান বড় হয়ে ওঠে সেখানে প্রচুর মানহীন জিনিসও কিন্তু তৈরি হতে পারে উল্লেখ করে প্রখ্যাত এ কথা সাহিত্যিক বলেন, সুতরাং কোনটা মানসম্পন্ন আর কোনটা মানহীন এটা বোঝাও একটা কঠিন ব্যাপার। এর মধ্যে যদি একজন পাঠক একটি মানহীন বই কিনে ফেলেন, সেটা পড়ে তিনি যদি হতাশ হন, তাহলে তিনি কিন্তু বই বিমুখ হয়ে যাবেন। সুতরাং এক্ষেত্রে প্রকাশকদের উচিত হবে, তারা যেন মানহীন বই প্রকাশ না করেন। সেটি যদি হয় তাহলে বইয়ের একটা মানদণ্ড পাবো।
এজন্য লেখকদের প্রতি আপনার আহবান কি থাকবে- প্রশ্নের উত্তরে ইমদাদুল হক মিলন বলেন, লেখকদের প্রতি আহবান একটাই। লেখকদের আসলে কোনো শিক্ষক নেই। লেখকদের একমাত্র শিক্ষক হচ্ছে একটা ভাল বই। বাংলা সাহিত্যে, পৃথিবীর সাহিত্যে প্রচুর ভাল বই লেখা হয়েছে। যদি একজন লেখক ভাল বইগুলো পড়েন, তাহলে তিনি বুঝতে পারবেন তার কি লেখা উচিত। আগে পৃথিবীতে বা বাংলা ভাষায় যা লেখা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে আমাদের বড় লেখকরা যা লিখেছেন, নজরুল যা লিখেছেন, সেই লেখাগুলো থেকে আমার লেখাটা কতটা পৃথক, আমি নতুন করে কি লিখতে পারছি, এইটা বোঝার জন্য ভাল বই পড়া হলো একমাত্র উপায়।