মেহেদী হাসান শিয়াম: চাঁপাইনবাবগঞ্জে কেটে ফেলা হচ্ছে ফজলি আম বাগান। ফজলি আমের উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে বাগান মালিকরা পুরনো বিশাল বিশাল গাছ কেটে ফেলছেন। আর ওই সব বাগানের জমি পরবর্তীতে বিক্রি হচ্ছে প্লট আকারে। কিন্তু নতুন করে আর ফজলি আমের আবাদ বাড়ছে না।
এমনটি চলতে থাকলে আগামীতে ফজলি আম অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।আম চাষীদের মাঝে সচেতনতা গড়ে না উঠলে ফজলি অলাভজনক অন্যান্য জাতের মতো হারিয়ে যাবে।
গত বছর রাজশাহী জেলার সাথে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মানুষ আন্দোলন করে ফজলি আমের জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন) স্বীকৃতি পেয়েছিলো। কিন্তু এখন জেলার বাগানগুলোতে দেদারসে কাটা হচ্ছে ফজলি আমের গাছ।
কৃষি সম্প্রসারণের তথ্য মতে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় এই বছর ৭ হাজার ৯৯৫ হেক্টর জমিতে ফজলি আমের চাষাবাদ হচ্ছে।এসব জমিতে রয়েছে ৫ লাখ ৯১ হাজার ১৫টি ফজলি আম গাছ। জেলার অন্যান্য উপজেলার মধ্যে শিবগঞ্জ উপজেলায় বেশি জমিতে ফজলি আমের চাষাবাদ হচ্ছে এবং সেখানেই বেশি পরিমাণে ফজলি আম গাছ কাটা হচ্ছে।
সম্প্রতি শিবগঞ্জের শেখটোলা গ্রামে সাড়ে ১৬ বিঘা আয়তনের একটি ফজলি বাগান কেটে ফেলতে দেখা গেছে। এই বাগানের একেকটি গাছের বয়স দেড়শ’ বছরের কম নয়। ধাইনগর, শাহবাজপুর, হাজারবিঘী, তেলকুপি এলাকাতেও বাগানের বড় গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। বাগান মালিকরা বলছেন, ৪-৫ বছর আগে থেকেই বাগান কেটে ফেলা শুরু হলেও গত দুই বছরে বেশি কাটা হচ্ছে গাছ।
আম চাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটা সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জে জনপ্রিয় আম ছিলো ফজলি। বিংশ শতাব্দির শুরুতেই নাবি জাতের আম্রপালি আম আসায় প্রথম বারের মতো বাণিজ্যিকভাবে পিছিয়ে যায়।আম্রপালি আম পাকে ফজলির সময়ই। আকার ও স্বাদেও আকর্ষণীয় হওয়ায় আমপ্রেমীরা ফজলির বিকল্প হিসেবে সাদরে গ্রহণ করে আম্রপালি আমকে। এরপরই চাষি ও ব্যবসায়ীদের আগ্রহ কমতে থাকে ফজলির প্রতি।জেলায় প্রতিবছর আম্রপালি আম বাগান বাড়লেও নতুন করে চাষিরা কেউ আর ফজলির বাগান গড়ে তুলছেন না। পুরনো যে ফজলির বাগানগুলো রয়েছে সেগুলোও হারিয়েছে উৎপাদন ক্ষমতা।সব মিলিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকেই যাচ্ছে জাতটি।
শিবগঞ্জের শেখটোলা গ্রামের আব্দুল জলিল বলেন, ফজলি আমের গাছগুলো থেকে আগের মতো আর আম পাওয়া যাচ্ছে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনক্ষমতা হারিয়েছে গাছগুলো। উৎপাদন কমে যাওয়ায় হতাশা থেকেই কেটে ফেলা হচ্ছে বাগান।এছাড়াও বড় গাছ হওয়ায় পরিচর্যা করতে সমস্যা হচ্ছে তাদের।
শিবগঞ্জের রসুলপুর এলাকার সমশের আলী বলেন, একটা সময় ছিলো ফজলি আম বাজারে খুব বিক্রি হতো। আম্রপালির কারণে বাজারে এখন আর ফজলি আম বিক্রি হচ্ছে না। এছাড়াও দেশের অন্যান্য জেলাগুলো বাসিন্দারাও ফজলি আম পছন্দ করছে না।তাই জেলার আম বাণিজ্যের জন্য ফজলি আমের গাছ কাটা অশনি সংকেত হলেও চাষিরা সাময়িক লাভের কথা চিন্তা করে উজাড় করছে বাগান।
মনসুর আলী নামে এক চাষি বলেন, ভারত থেকে আসা অবৈধ হরমোন ‘কালটার’ অতিরিক্ত মাত্রায় প্রয়োগের কারণে ফজলি আম গাছের ক্ষতি হয়েছে। অনেক গাছের কাণ্ড পচে গেছে। তাই কোনো কোনো বাগানে বাধ্য হয়েই কেটে ফেলতে হচ্ছে আম গাছ। বড় গাছে হরমোনের অতিরিক্ত প্রয়োগ বন্ধ হওয়াই প্রয়োজন বলেও মনে করেন চাষিরা।
বড় বড় ফজলি আমের গাছগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়েছে চাষিদের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক। তিনি জানান, বড় গাছ চাঁপাইনবাবগঞ্জের সম্পদ। যে হারে বড় গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে আম চাষিদের হা-হুতাশ করতে হবে।একটি বড় গাছ কম জায়গায় অনেক বেশি আম উৎপাদন করে। বড় গাছের সমপরিমান জায়গায় ছোট গাছ লাগিয়ে সেই পরিমাণ আম পাওয়া সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, গাছ কেটে ফেলার বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে সক্রিয় হতে হবে। চাষিরা যাতে গাছ কেটে না ফেলে সে ব্যাপারে তাদের সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি চাষিরা তাদের উৎপাদিত আমের সঠিক মূল্য যেনো পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আমভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের কর্মকর্তারা বড় গাছ কেটে ফেলায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।এটাকে আম বাণিজ্যের জন্য ‘মারাত্মক ক্ষতিকর’ দিক হিসেবেও বর্ণনা করেছেন তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক পলাশ সরকার বলেন, চাষিরা এখন আলট্র্যা হাইডেনসিটি (অতি ঘন) বাগানের দিকে ঝুঁকছেন। পাশাপাশি গত এক দশকে ছোট গাছের জাতগুলোর সম্প্রসারণ হয়েছে জেলায়। চাষিরা যখন কোনো নতুন প্রযুক্তি পায় তখন পুরনো প্রযুক্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে এটাই বাস্তবতা। তবে কৃষি বিভাগ চাষিদের মাঝে সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, যাতে তারা বড় গাছগুলো দেদারসে না কাটে।
আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান বলেন, আমের নতুন নতুন জাত পুরনো জাতের জায়গা দখল করে নিচ্ছে। তবে বড় বাগান কেটে ফেলে নতুন জাত সম্প্রসারণ করা ঠিক হবে না। চাষিরা এখন আগাম ও নাবী জাতের আম চাষের দিকে ঝুঁকছেন।আমের ভরা মৌসুম হিসেবে বিবেচিত জুন মাসে যে সব আম পাকে সেগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে চাষিরা। অতিরিক্ত লাভের আশায় এটা করেছেন তারা। কিন্তু এটা মোটেও উচিত নয়।
তিনি আরও বলেন, ফজলি জাতের আমও গাছ ছোট রেখে চাষ করা যাবে। কাজেই কেউ যদি ফজলির বড় গাছ কেটেও ফেলতে চান তিনি যেন সেখানে ফজলি জাতেরই গাছ লাগান।বাগান মালিকরা গাছ কাটতে কাটতে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, অদূর ভবিষ্যতে জুন মাসে ভালো আম পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে।