মুসলমানরা যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদায় মঙ্গলবার (৭ মার্চ) দিবাগত রাতে মহান রাব্বুল আলামিনের রহমত কামনায় নফল ইবাদত-বন্দেগীর মধ্যদিয়ে পবিত্র শবেবরাত পালন করবেন।
হিজরি বর্ষের শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে সৌভাগ্যের রজনী। মহিমান্বিত এ রাতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার বান্দাদের ভাগ্য নির্ধারণ করেন। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা এ রাতে মহান আল্লাহর রহমত ও নৈকট্য লাভের আশায় নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজগারসহ বিভিন্ন ইবাদত বন্দেগি করে থাকেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন শাবানের মধ্য দিবস আসবে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করবে ও দিনে রোজা পালন করবে (ইবনে মাজাহ)। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখ। কেননা, এদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং আহ্বান করেন; কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছ কি? আমি ক্ষমা করব; কোনো রিজিকপ্রার্থী আছ কি? আমি রিজিক দেব; আছ কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি উদ্ধার করব। এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৩৮৪)।
এদিন রাতে যেসব ইবাদত করা প্রয়োজন সেগুলো হচ্ছে-
১. নফল নামাজ পড়া
২. নামাজে কিরাআত ও রুকু-সেজদা দীর্ঘ করা।
৩. পরের দিন নফল রোজা রাখা;
৪. কোরআন তিলওয়াত করা
৫. দরুদ শরিফ বেশি বেশি পড়া;
৬. তাওবা-ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা;
৭. দোয়া-কালাম, তাসবিহ তাহলিল, জিকির-আসকার ইত্যাদি করা;
৮. কবর জিয়ারত করা;
৯. নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সকল মোমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়া করা।
তবে শবেবরাতকে কেন্দ্র করে কিছু ভুল রেওয়াজ রয়েছে, যা পরিহার করা আবশ্যক।
যা যা করা উচিত নয়
১. আতশবাজি বা পটকা ফোটানো
২. ইবাদত-বন্দেগি বাদ দিয়ে ঘোরাফেরা করা
৩. অনাকাঙ্ক্ষিত আনন্দ-উল্লাস করা
৪. অযথা কথাবার্তা ও বেপরোয়া আচরণ করা
৫. শুধু শবেবরাতকে কেন্দ্র করে মসজিদে বা ঘরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত লাইটিং করা
৬. হালুয়া-রুটি বা খাওয়ার পেছনে বেশি সময় নষ্ট করে ইবাদত থেকে দূরে থাকা
৭. ইবাদত মনে করে খাসি জবেহ করা
৮. গর্হিত ও অশ্লীল কোনো কাজ করা
৯. অন্য কারও ইবাদতের বা ঘুমের বিঘ্ন ঘটানো
তবে অনেকে হালুয়া-রুটি বিতরণকে বিদআত মনে করেন। এ প্রসঙ্গে ইকরা জামিয়ার সিনিয়র মুহাদ্দিস মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান বলেন, একেক অঞ্চলের একেক কালচার বা কৃষ্টি থাকে। এসব কালচার আর্থসামাজিক ও ঐতিহাসিক বিভিন্ন কারণেই গড়ে ওঠে। এর সঙ্গে ধর্মের কোনো সংঘর্ষ থাকে না। অনেকে না বুঝেই সেগুলোকে বিদআত বলে দেয়। অথচ বিদআতের সংজ্ঞায় শাস্ত্রবিদগণ এ কথা স্পষ্ট করেছেন, কোনো বিষয়কে ধর্মের অংশ মনে করলে তবেই তা বিদআত হবে। রাসুল (সা.) রুটি খেতেন, কেউ যদি তার অঞ্চলগত অভ্যাসের কারণে রুটি না খেয়ে ভাত খায়, তাহলে এটিকে বিদআত বলা যায় না। এটা তার অভ্যাস ও সুবিধার ব্যাপার। খাওয়া-দাওয়া পোশাক-আশাকের মতোই সাংস্কৃতিক বিষয়াদি। শবেবরাত নিঃসন্দেহে ধর্মীয় বিষয়। কিন্তু শবেবরাতের আনুষ্ঠানিকতা ধর্মের অংশ হিসেবে নয়, উপমহাদেশের মুসলিম কালচার হিসেবে উদ্যাপিত হয়ে আসছে। তবে কালচার হিসেবে যা কিছু উদ্যাপিত হয়, তার সবকিছুকে চোখ বুজে বৈধ বলে দেওয়া যায় না। দেখতে হবে, এসব উদ্যাপনের মাঝে কোনো শরিয়াবিরোধী কিছু আছে কি না? অপব্যয়, অপচয় ও বেশরা কাজকর্ম নিঃসন্দেহে পরিত্যাজ্য। কিন্তু রাত জেগে নামাজ পড়া, দোয়া করা, পরদিন রোজা রাখা, কবর জিয়ারত করা ইত্যাদি আমল হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। ফকির-মিসকিন-এতিমদের দান-সদকা করা, গরিব-দরিদ্র অসহায় মানুষকে সাহায্য করা শবেবরাতে নিষিদ্ধ হওয়ার কোনো কারণ নেই।
ফজীলত
হাদিস শরীফে এসেছে- ‘হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, পাঁচটি রাত এমন আছে, যে রাতে বান্দার কোনো দোয়া ফেরত দেওয়া হয় না। আর তা হলো-
জুমআর রাতের দোয়া, রজব মাসের প্রথম রাতের দোয়া, নিসফা শাবান তথা অর্ধ শাবানের রাতের দোয়া, ঈদুল ফিতর তথা রোজার ঈদের রাতের দোয়া, ঈদুল আজহা তথা কুরবানির ঈদের রাতের দোয়া।’ (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক)
তাই আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের জন্য নিচের দোয়াটি বেশি বেশি পড়তে পারেন-
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাগফিরলি জামবি, ওয়া ওয়াসসি’লি ফি দারি, ওয়া বারিক লি রিজকি। (নাসাঈ)
অর্থ: হে আল্লাহ! আমার গোনাহ মাফ করে দাও। আমার জন্য আমার বাসস্থান প্রশস্ত করে দাও। এবং আমার রিজিকে বরকত দিয়ে দাও।
এ ছাড়া হযরত উমর ইবনু আব্দিল আযিয রহ., ইমাম শাফেয়ী রহ. প্রমুখ মনীষীদের থেকেও এ রাতের ইবাদতের সপক্ষে রেওয়ায়াত রয়েছে। অন্তত বারোজন সাহাবি থেকে শবেবরাতের ফজিলত সংক্রান্ত হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এখানে বিখ্যাত দুটি হাদিস তুলে ধরা হলো-
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, আল্লাহ তায়ালা শাবান মাসের মধ্যরজনীতে সমস্ত মাখলুকের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং বিদ্বেষ পোষণকারী ও হত্যাকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন [মুসনাদু আহমাদ, হাদিস নং ৬৬৪২]। অন্য বর্ণনায় রাসূল সা. বলেন, মুশরিক ও বিদ্বেষপোষণকারী [তাবারানি- হাদীস নং ২০৩]।
হযরত আয়শা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, এ রাতে আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং কালব গোত্রের মেষপালের পশমের চাইতেও অধিক সংখ্যক লোকের গুনাহ মাফ করেন [ইবনু মাজাহ- হাদিস নং ১৩৮৯]।
মূল কথা এই যে, এসব রাত উৎসবের নয়, ইবাদত-বন্দেগী ও তওবা- ইস্তেগফারের রাত। তাই রসম-রেওয়াজের অনুগামী হয়ে এ রাতে উপরোক্ত কাজকর্মে লিপ্ত হওয়া নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে বরাতের মহিমান্বিত রাতে শরিয়তসম্মত পন্থায় ইবাদত বন্দেগি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।