স্টিফেন হকিং একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ, মহাবিশ্ববিদ, লেখক, বিজ্ঞান জনপ্রিয়কারী, কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক মহাকাশবিদ্যা বিভাগের পরিচালক, এবং প্রফেসর। পড়াশোনা করেছে, কিন্তু তার নাম জানে না, এমন মানুষ মনে হয় গোটা দুনিয়াতে একজনও পাওয়া যাবে না।
বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা মেধাবী এই মানুষটার পুরো নাম স্টিফেন উইলিয়াম হকিং। জীবনের বেশির ভাগ সময় মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত হয়ে হুইলচেয়ারে কাটিয়েছেন, তীব্র নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়েছেন। তারপরেও তার অর্জনের খাতা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি মহিমান্বিত।বাকশক্তি হারিয়ে ফেলার পরও তিনি এক ধরনের শব্দ-উৎপাদনকারী যন্ত্রের সাহায্যে অপরের সাথে যোগাযোগ করতেন।
যন্ত্রচালিত একটি হুইলচেয়ার। ডান দিকে হেলানো ঘাড়। হুইলচেয়ারের হাতলের কন্ট্রোলের উপর রাখা হাত। বিশ্ব তাঁকে এই অবস্থাতেই দেখেছে বছরের পর বছর। মৃত্যুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কী ভাবে জীবনের আস্বাদ নেওয়া যায়, তাঁর থেকে বড় উদাহরণ বোধহয় আর হয় না। তিনি, স্টিফেন উইলিয়াম হকিং দেখিয়েছিলেন হুইল চেয়ারে বসেই কী ভাবে মহাবিশ্বে ঘুরে বেড়ানো যায়।
নিয়তি যেন হকিংয়ের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। ১৯৬২ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত হন হকিং। সেই সময়ে চিকিত্সকেরা বলেছিলেন, দু’বছরের বেশি বাঁচা সম্ভব নয় হকিংয়ের। এর পর থেকে তাঁর পুরো জীবনই কেটেছে হুইলচেয়ারে।
তিনি ২০১৮ সালের ১৪ই মার্চ ৭৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে জন্ম হয় আধুনিক বিজ্ঞানের এই অন্যতম সেলিব্রিটির। গ্যালিলিওর জন্মের ঠিক ৩০০ বছর পরে। গরিব পরিবারের হলেও হকিংয়ের বাবা, মা দু’জনেই পড়তেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবা ছিলেন মেডিসিনের ছাত্র। মা পড়তেন রাজনীতি, অর্থনীতি এবং দর্শন। হকিংরা ছিলেন চার ভাই বোন।
হকিংয়ের কাজের বেশির ভাগ অংশ জুড়েই ছিল আপেক্ষিকতাবাদ, কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং মহাবিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র ক্ষুদ্র কণা ও তাদের চরিত্র এবং অবশ্যই ব্ল্যাক হোল। ১৯৭৪ সালে ব্ল্যাক হোলের উপর তাঁর বিখ্যাত থিওরি ‘হকিং রেডিয়েশন’ সামনে আনেন। সেই বছরই মাত্র ৩২ বছরে বয়সে রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হন তিনি। ১৯৭৯ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের লুকেসিয়ান প্রফেসর হন। এই পদে ছিলেন আইজ্যাক নিউটনও।
বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার পিছনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’। বইটির শুধুমাত্র ইংরেজি সংস্করণই এক কোটি কপি বিক্রি হয়েছিল। ২০০১ সালের মধ্যে ৩৫টি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’। ২০০১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘দ্য ইউনিভার্স ইন আ নাটশেল’।
রাজনীতি নিয়েও সরব হতে দেখা গিয়েছে এই বিজ্ঞানীকে। মার্কিন নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘বুদ্ধিমত্তা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। সরব হয়েছিলেন ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধেও।
১৯৬৫ সালে জেন ওয়াইল্ডকে বিয়ে করেছিলেন হকিং। তাঁদের তিন সন্তান। ২৫ বছর পর তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। পরে তিনি তাঁর নার্স এলাইন ম্যাসনকে বিয়ে করেন। যদিও এ সম্পর্কও বেশি দিন টেকেনি। ২০১৪ সালে তাঁকে নিয়ে তৈরি হয় সিনেমা ‘দ্য থিওরি অব এভরিথিং’।
স্টিফেন হকিং এর ধর্মবিশ্বাস
আইনস্টাইনের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে অনেকে টানাহ্যাঁচড়া করে। আইনস্টাইন প্রচলিত কোনো ধর্মের ঈশ্বরে বিশ্বাস না করলেও বারংবার মহাবিশ্বের ঐকতানকে ঈশ্বরের নাম দিয়ে উক্তি দিয়েছেন। হকিং এর ধর্মবিশ্বাস নিয়ে টানাটানি করার কোনো সুযোগ নেই। অবশ্য সেটা সাম্প্রতিক সময়ে। একসময় তিনিও উদাহরণ দিতে গিয়ে ঈশ্বর শব্দটা ব্যবহার করেছেন। কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে তিনি লিখেছেন, “যদি কোনোদিন আমরা একটা পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব আবিষ্কার করতে পারি, সেটা হবে মানুষের যুক্তিক্ষমতার সর্বোচ্চ বিজয়- আর সেদিন আমরা ঈশ্বরের মন বুঝতে পারবো”। কেউ টানাটানি করতে চাইলে এই লাইনটা নিয়ে করতে পারে; যদিও একই বইতে তিনি লিখে দিয়েছিলেন, “মহাবিশ্বের উৎপত্তি বর্ণনা করার জন্য ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রয়োজন নেই”। ২০১৪ সালে এটাকে আরো খোলাসা করে বলেছেন, “ঈশ্বরের মন বুঝতে পারা বলতে আমি বুঝিয়েছি, যদি কোনো ঈশ্বর থেকে থাকে–যা আসলে নেই–তাহলে সেই ঈশ্বরের যা যা জানার কথা, আমরা তাই জানবো। আমি নাস্তিক”।
হকিং এও বলেছেন, “ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। ধর্মের ভিত্তি কর্তৃত্ব ফলানোতে, আর বিজ্ঞানের ভিত্তি পর্যবেক্ষণ আর যুক্তিতে। জয় হবে বিজ্ঞানেরই, কারণ এটা কার্যকর”। স্বর্গ বা পরকালকে তিনি রুপকথার গল্প বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমাদের জীবন একটাই। এই এক জীবনেই ব্রহ্মাণ্ডের মহান নকশার কদর করতে হবে। আর সেই জীবন পেয়েছি বলে আমি কৃতজ্ঞ।”
হকিংকে নিয়ে মুভি
হকিং এর প্রথম স্ত্রীর লেখা বই Travelling to Infinity: My Life with Stephen . সেটা দিয়ে একটা সিনেমা বানানো হয়েছিলো ২০১৪ সালে, Theory of everything. স্টিফেন সেই সিনেমাটা দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। হকিং এর ভূমিকায় এডি রেডমেইনকে দেখে তিনি মনে করেছিলেন যে তিনি যেন নিজেকেই দেখতে পাচ্ছেন।সিনেমাটা আসলেই চমৎকার! আর এডি রেডমেইন একটা অস্কারও জিতে নিয়েছেন হকিং এর ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য।