হিরোশিমার হিমেল হাওয়ায় কাঁপছি সবাই। সময়টা ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি। জাপানে জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। আন্তর্জাতিক বঙ্গবিদ্যা পরিষৎ-এর সম্মেলনে যোগ দিতে টোকিও যাওয়া। সেখান থেকে ঐতিহাসিক হিরোশিমায়। ছিলাম ছ’জন অধ্যাপক। রাত নটা। হোটেলে ফেরার বাস পেলাম না। দুটো ট্যাক্সিতে ফেরার ব্যবস্থা হল। দুজন মহিলা ট্যাক্সিতে উঠেছেন। তৃতীয়জন আমি। ট্যাক্সিতে উঠতে গিয়ে বাধা পেলাম। কারণ দলটি ছিল তিনজন মহিলা ও তিনজন পুরুষের। দুজন মহিলার সঙ্গে এক ট্যাক্সিতে ওঠার আপত্তি এল পশ্চিমবঙ্গের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিলা অধ্যাপকের কাছ থেকে। পুরুষবিহীন ট্যাক্সিতে নিরাপত্তাহীনতার অভাববোধ থেকে এই আপত্তি। বাধ্য হয়ে ভাগাভাগি। দুটো ট্যাক্সিতে পুরুষ-মহিলা মিলেমিশে ছ’জন। তৈরি হল নিরাপত্তার বলয়!
‘পতি বিনা অবলার কি গতি জগতে।’—মধুসূদন দত্তের এই বাক্য পিতৃতন্ত্রকে লালন করে তৈরি। অবলা মানে যার বল নেই। নারী, ললনা, মহিলা অর্থে বোঝানো হচ্ছে। এরা কারও ওপর নির্ভর করে বাঁচে। পিতৃতন্ত্রের তৈরি এই শব্দ-ভাবনায় পুষ্ট হয়েছে নারী-পুরুষের মন-মানসিকতা। আজ নারী-পুরুষের সমান অধিকারের প্রশ্নে সোচ্চার হয়ে মিটিং, মিছিল, সেমিনারের জোয়ার বইছে। কিন্তু মনের প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্ত হতে পেরেছি ক’জন?
যে পুরুষ মনে করছেন আমরা সবাই সমান। নারীর অধিকার স্বীকৃত যাঁর কাছে। যিনি বাইরের কর্মজগতে মহিলাদের অগ্রসরকে তারিফ করেন। তিনিও বাড়িতে কাজের বিভাজনে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ টেনে দেন। খাওয়ার পর টেবিল মোছা মহিলাকেই করতে হবে। ওটা ওদের কাজ। অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয়, বাড়িতে খাওয়ার সময় মহিলা নেই। পুরুষ টেবিলে খাবেন। ডাল, ঝোলের ফোঁটা পড়ে থাকবে। বাড়ির মহিলা কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে সেই টেবিল মুছে পরিষ্কার করবেন। এর জন্য মহিলার প্রতিবাদ ধোপে টেকে না। কারণ সামান্য একটু কাজ। তার জন্য এত হইচই কেন। এটা হয়ত মহিলারা মনে করেন। এবং পুরুষও। কিন্তু কাজ যখন সামান্য তবে বেশিরভাগ পুরুষের তাতে অনীহা কেন। কিছু কাজ শুধু মেয়েদেরই ভেবে নির্দিষ্ট করে রাখার মধ্যে মানসিক দীনতার পরিচয় বহন করে নাকি?
রান্নার মাসি বা কাজের মাসির অনুপস্থিতির বিকল্প দায়িত্ব বাড়ির মহিলাকেই নিতে হয়। বাচ্চা সামলানো সে তো মায়েরই দায়িত্ব। কিছুটা সময় বাবা নিশ্চয় দেন। কিন্তু সন্তানের সঙ্গে আবেগের সম্পর্কে মাকে জড়িয়ে দিয়ে পূর্ণ সময়ের কাজ আদায়ের ছলচাতুরি পিতৃতন্ত্রের কৌশলেই প্রবাহিত হচ্ছে। ক’জন পুরুষ কাজের ভার লাঘব করতে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসেন? যদিও বা আসেন সেটা ছ’মাসে ন’মাসে কখনও কদাচিৎ। এবং সেই টুকরো অংশগ্রহণের অহঙ্কারে তিনি নিজের প্রগতিশীলতার তারিফ করেন।
ঘর-বাহির সামাল দিতে গিয়ে দৈনন্দিন কাজের চাপে দিশেহারা মহিলার অবস্থান পরিমাপ করা পিতৃতন্ত্রের বোধ-বিবেচনার আওতার বাইরে। সমান অধিকারের প্রশ্ন সেখানে প্রহসন মাত্র।
শুধু ঘরে নয়। বাইরেও ভারসাম্য টালমাটাল। মহিলা কলেজে অধ্যাপনা করি। অধিকাংশ অধ্যাপক মহিলা। ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক মহিলা। কলেজ থেকে শিক্ষক সংগঠনের কনভেনার ঠিক করা হচ্ছিল জুনিয়র এক পুরুষ অধ্যাপককে। আপত্তি জানালাম। আর কেউ যদি রাজি না থাকে তবে আমি কনভেনার হতে রাজি। যদিও ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপকের এ ব্যাপারে কথা চলে না। তবু তিনি মত দিয়েছিলেন। এবং তাঁর মতকে আলোচনায় টানছি নিজেদের আত্মসমীক্ষার গরজে। উনি জানালেন, ওটা বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কাজ। তাই ছেলেদের পক্ষে সুবিধা। আমি মহিলা, তাই কলেজের ভেতরের কোনও কাজের কমিটিতে রাখবেন। আর বিস্ময় নেই। শুধু বিরক্তির পালা। নতুন মহিলা অধ্যক্ষ এলেন কলেজে। শুরু হল বিভিন্ন কমিটি তৈরির কাজ। স্পোর্টস কমিটিতে সব ছেলেদের নাম। কারণ নাকি খেলাধুলোর বিষয়টা ওঁদেরই এক্তিয়ারে।
প্রবল আপত্তি জানিয়ে একজন মহিলাকে কমিটিতে রাখা হল। খেলবে ছাত্রীরা। হাল ধরবেন পুরুষরা। মহিলা অধ্যাপকরা পুতুল সেজে দর্শকের ভূমিকা পালন করতে যাবেন। তাহলে মাঠ ছেলেদের, ঘর মেয়েদের? বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিপ্রাপ্ত, উচ্চপদে আসীন মহিলারাও নির্বিকারে পিতৃতন্ত্রকে লালন করে এগিয়ে দিচ্ছেন। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন হয়ত পিতৃতন্ত্রের তৈরি ফ্রেমের বাইরে বেরতে।
এন এস এসের প্রোগ্রামে হাওড়ার এক কলেজে গিয়েছিলাম বক্তা হয়ে। মেয়েদের অধিকার নিয়ে আলোচনা করলাম। ছাত্রছাত্রী ছাড়াও কিছু অধ্যাপক ছিলেন। মত বিনিময়ে বুঝলাম অধ্যাপকরাও একই ভাবনার শরিক। মধ্যাহ্নভোজনে গিয়ে বিপরীত চিত্রে হতবাক। ক্যান্টিন থেকে খাবার নিয়ে যাঁরা হাজির হয়েছেন তাঁদের হাতে খাবার পরিবেশনের দায়িত্ব নেই। খেতে বসেছি প্রায় পনেরোজন। মহিলা অধ্যাপকরা শাড়ির আঁচল গুঁজে পাতে পাতে খাবার দিয়ে যাচ্ছেন। আর পুরুষ অধ্যাপকরা বাড়ির কর্তার ভূমিকায় দাঁড়িয়ে তদারকি করছেন। ভাল করে খাবার পরিবেশনের নির্দেশও দিচ্ছেন। হাসিমুখে মহিলারা মনোযোগী হচ্ছেন ত্রুটিবিহীন অতিথি আপ্যায়নে। কর্মবিভাজনের এই নীতিতে ওই হাসিমুখের আড়ালে ঝড় উঠবে কিনা জানি না।
মেয়ে মানেই বাড়ি ও হাঁড়ির সঙ্গে জুড়ে থাকার ভাবনা। যতই এক সিলেবাস পড়ে, একরকম প্রশ্নপত্রের উত্তর লিখে, একইভাবে ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরিতে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করুন না কেন। বাসন ধোয়া, কাপড় কাচা, ঘর পরিষ্কার রাখা, রান্নার কাজ এবং অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা— সব তো মেয়েদের জন্য।
কোনও বান্ধবী বা সহকর্মীর বাড়ি গিয়ে এমনটা ঘটেনি যে, আমরা গল্প করছি বা কোনও কাজ করছি আর সেই বাড়ির পুরুষ সদস্য চা এনে আমাদের দিচ্ছেন। কথা বন্ধ রেখে সেই মহিলাকেই উঠতে হয়। নিজের বন্ধু এবং স্বামীর বন্ধু উভয়ের ক্ষেত্রেই বাড়ির মহিলার দায়িত্ব। মেয়েরা দায়িত্ব নিয়েই জন্মাই। আর পুরুষরা জন্মায় অধিকার নিয়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে দিয়ে, সেবাযত্ন করে তাঁদের আরামে রাখার দায়িত্ব মেয়েদের। আর মেয়েদের কাছ থেকে যত্ন পাওয়ার অধিকার যেন ছেলেদের। পিতৃতন্ত্রের গড়ে দেওয়া অভ্যাসে দিন যাপনের এই ছবি অতি প্রকট। এতদিনের মেয়েদের করে আসা বাড়ির কাজকে পুরুষরা বুঝি নিম্নমানের মনে করে। আর তাই নিম্নমানের কাজে পুরুষরা নিযুক্ত হতে চান না। সে–সব কাজে যুক্ত করে পুরুষদের অধঃপতন দেখতেও চান না অনেক মহিলা। পিতৃতন্ত্রে লালিত হয়ে পুরুষের এই পতন কি সহ্য করা যায়?
বিবাহিত এক উচ্চশিক্ষিত মহিলা শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচারিত। বাবা-মার কাছে অভিযোগ জানিয়ে সুরাহা হয়নি। পিতৃকুলের চেয়ে শ্বশুরকুলের আর্থিক অবস্থা অনেক ভাল। বাবা-মা তাই তাঁর নালিশকে গুরুত্ব দেননি। উপরন্তু শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে জোট বেঁধে তাঁকে নজরবন্দী করে রাখেন। কারণ মেয়েটি বাবা-মায়ের সাহায্য না পেয়ে থানায় নালিশ জানাবেন বলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত নজরবন্দী এড়িয়ে বিভিন্ন সংগঠনের কাছে তিনি ইমেল পাঠান নিজের অবস্থানের কথা জানিয়ে। সেই ইমেল-এর কপি থানায় দিয়ে আসে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।
অভিযোগের এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন যে, স্বামী তাঁকে যৌন নির্যাতন করে। থানার অফিসার এই অংশটি পড়ে হেসে জানান, বিবাহিত স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে আবার যৌন নির্যাতনের অভিযোগ? বিবাহিত স্ত্রী মানেই যেন যৌন অত্যাচার করার অধিকার বর্তায়। প্রশাসন থেকে সাধারণ মানুষ সর্বত্র পিতৃতন্ত্রের দাপট। গণতান্ত্রিক এই দেশের আইনে ব্যক্তিমাত্রই প্রশাসনিক সুবিচারের দাবিদার। কিন্তু মুসলিম মেয়েদের বিয়ে বা তালাকজনিত সমস্যার জন্য এই গণতান্ত্রিক উদারতার লিপিবদ্ধ বাণী খাটছে না। তাঁরা তখন ভারতের ব্যক্তি নাগরিক নন। একটা সম্প্রদায়ের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয় পরিচালিত ব্যক্তিগত আইনের অংশীদার। ভারতীয় গণতন্ত্রও তাহলে প্রশ্নের সম্মুখীন নয় কি? দৃষ্টির স্বচ্ছতা না থাকলে প্রশাসনের কাছেও সুবিচার আশা করা যায় না।
ফিরে আসি অত্যাচারিত সেই মহিলার প্রসঙ্গে। তাঁর চিঠির ভিত্তিতে পিতৃকুল এবং শ্বশুরকুলের তৈরি করা দমবন্ধ অবস্থা থেকে তিনি মুক্তি পান। পুলিস গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে। কিন্তু মেয়ের এই স্বাধীন, স্বাবলম্বী জীবন মেনে নিতে পারেননি শিক্ষিত চাকরিজীবী মা। তিনি আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, সব মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে মানিয়ে চলতে হয়। কিন্তু এ কেমন দেশের আইন, যেখানে বিবাহিত মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসে! পিতৃতন্ত্রের তৈরি ভাবনার খাঁচায় বন্দীজীবনে অভ্যস্ত নারী মেয়ের এই স্বাধীন ভাবনাকে স্বেচ্ছাচার মনে করেন।
রোকেয়া বলেছেন, কোনও অজ্ঞাত কারণে মানবজাতির একটা অংশ (পুরুষ) উন্নতি করতে লাগল আর অপর অংশ (নারী) সেরকম উন্নতি করতে পারল না বলে পুরুষের সহধর্মিণী না হয়ে দাসী হয়ে পড়ল। মহিলাদের অকর্মণ্য মনে করে পুরুষ তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এল। সাহায্য পেতে পেতে মহিলারা আরও অকর্মণ্য হয়ে পড়ল। মহিলাদের সাহায্য নিয়ে চলায় অভ্যস্ত মানসিকতাকে রোকেয়া ভিক্ষুকের সঙ্গে তুলনা করেছেন, ‘এদেশের ভিক্ষুদের সহিত আমাদের বেশ তুলনা হইতে পারে। একদিকে ধনাঢ্য দানবীরগণ ধর্ম্মোদ্দেশ্যে যতই দান করিতেছেন, অন্যদিকে ততই ভিক্ষুসংখ্যা বাড়িতেছে! ক্রমে ভিক্ষাবৃত্তি অলসদের একটা উপজীবিকা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এখন আর তাহারা ভিক্ষা গ্রহণ করাটা লজ্জাজনক বোধ করে না।… আমরাও অনুগ্রহ গ্রহণে আর সঙ্কোচবোধ করি না। সুতরাং আমরা আলস্যের-প্রকারান্তরে পুরুষের— দাসী হইয়াছি। ক্রমশ আমাদের মন পর্যন্ত দাস হইয়া গিয়াছে। এবং আমরা বহুকাল হইতে দাসীপনা করিতে করিতে দাসত্বে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি। এইরূপে আমাদের স্বাবলম্বন, সাহস প্রভৃতি মানসিক উচ্চবৃত্তিগুলি অনুশীলন অভাবে বারবার অঙ্কুরে বিনাশ হওয়ায় এখন আর বোধ হয় অঙ্কুরিতও হয় না।’
অন্য রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী তাঁর অভিজ্ঞতার কথা অনুশোচনার সঙ্গে শোনালেন। মারুতি কোম্পানির কর্মীদের দাবিতে তাঁরা ধর্নায় বসেছিলেন। সেখানে সবাই পুরুষ। মাত্র দুজন ছিলেন মহিলা। পুরুষদের গ্রেপ্তার করা হয়। মেয়ে দুজনকে নয়। এই দুজন মহিলাই ছোটাছুটি করে থানা থেকে তাঁদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেন। সবাই ফিরে আসেন আবার ধর্নাস্থলে। সন্ধ্যার মুখে সেই পুরুষরা এই দুই মহিলাকে পাঠান কাছেই এক কমরেডের বাড়ি, তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে রুটি তৈরি করতে। ধর্নায় বসা কমরেডদের খাওয়ার জন্য। সব কাজ সকলের জন্য এই বোধোদয় না হলে অধিকারের প্রসঙ্গ অর্থহীন। হাঁড়ির হাল, বাড়ির দায়, বাচ্চা সামলানোর চাপ শুধু মেয়েদেরই কেন? দৈনন্দিন সাংসারিক কাজের সব চাপ মেয়েদের ওপর থেকে লাঘব করতে না পারলে বাইরের জগতের অনেক যোগাযোগ থেকে তাঁদের পিছিয়ে থাকতে হবে। মেয়েরা বাইরের কাজ আরও নিষ্ঠার সঙ্গে করতে পারবে বাড়ির কাজ ভাগ হলে।
১৯৮৫ সালে এম এ পড়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে থাকতাম মাসিক সত্তর টাকা দিয়ে। খাবারের মান অত্যন্ত খারাপ ছিল। একই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের হস্টেলে দুশো টাকা নিত। খাবার অনেকটা ভাল দিত সেখানে। কিছু ছাত্রী আন্দোলন শুরু করলাম টাকা কিছু বাড়িয়ে ভাল খাবারের দাবিতে। কিন্তু সে আন্দোলন টিকল না। বেশিরভাগ ছাত্রীর সায় ছিল না টাকা বাড়ানোয়। হস্টেলের নিয়ম ভঙ্গ করেই ঘরে ঘরে মেয়েরা স্টোভ জ্বালিয়ে রান্না করত। ছেলেরা হস্টেলের ঘরে রান্না করত বলে শুনিনি। এ ব্যাপারে হস্টেল কর্তৃপক্ষেরও কোনও কড়াকড়ি চোখে পড়েনি। আগুনের তাপ, শ্রমকষ্ট, সময় নষ্ট তাদের চেতনায় নাড়া দেয়নি। ক্লাস শেষে ঘরে ফিরে রেঁধে-খেয়ে ভাল থাকার তৃপ্তিকর মনোবাসনা।
হস্টেলে ফেরার তাগিদ মেয়েদের ছিল নিয়মের কড়াকড়িতে। বড়জোর ক্লাসের পর একটু লাইব্রেরি যাওয়ার সময় জুটত। স্মৃতি ফিকে হয়ে এসেছে। নির্দিষ্ট সময়টা মনে করতে পারছি না। তবে সম্ভবত রাত সাতটা বা সাড়ে সাতটার মধ্যে হস্টেলে ঢুকতে হত। তারপর মেইন গেটে তালা। মফস্সল থেকে পড়তে এসেছি কলকাতায়। একাডেমিতে নাটক দেখব না, নন্দনে সিনেমা দেখব না, এমন তো চলতে পারে না। রাত করে কোনওদিন ফিরতে চাইলে হস্টেল কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমতি নিতে হত। সেটাও বড়জোর রাত সাড়ে আটটা বা নটা। তাই বড্ড ঝুঁকি ছিল নাটক দেখতে যাওয়া।
মনে পড়ছে একবার অনুমতি নিতে গেলে হস্টেল সুপার যিনি একটি কলেজে অধ্যাপনা করতেন সেই মহিলার বক্তব্য ছিল, মফস্বল থেকে এসে মেয়েদের ডানা গজায়। এসব ছেলেদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর মতলব। জানি না এই অভিজ্ঞতা ছেলেদের হস্টেলে হয় কিনা। কোনও বন্ধুর কাছে অন্তত কখনও শুনিনি। ডানাছাটার তালিকায় মেয়েদেরই নাম। এ এক অদ্ভুত চিন্তায় আক্রান্ত হয়ে আমরা মেয়েরাই নিজেদের কূপমণ্ডূক করে তুলছি। তুমি সন্ধেতেই ঘরে ফেরো। তোমার কোনও সংস্কৃতি চর্চার দরকার নেই, সভা-সমিতিতে যোগ দিও না, রাত করে লাইব্রেরিতে পড়ো না। লক্ষ্মণরেখা ডিঙোলেই চারদিক থেকে আঙুল উঁচিয়ে তোমাকে চিহ্নিত করবে। তোমার শরীরের সঙ্গে জুড়ে একটা শব্দ তৈরি করেছে পিতৃতন্ত্র। তার নাম সতীত্ব। ভাষার এই রাজনৈতিক চালে তুমি জড়িয়ে পড়েছ। প্রলোভিত হয়েছ। সেই প্রলোভনে পিছু হটছ বাইরের কর্মজগৎ থেকে।
সময়টা অনেক এগিয়েছে। আমার তিরিশ বছর আগের হস্টেল জীবনের সঙ্গে বর্তমানে যে সব মেয়ে হস্টেলে থাকছে তাদের জীবনের মিল থাকার কথা নয়। তবু কোথাও একই কথার প্রতিধ্বনি শুনে চমকে উঠে ভাবতে হচ্ছে, মেয়ে কবে মানুষ হবে! সাম্প্রতিক ‘পিঁজরাতোড়’ আন্দোলন শুরু হয়েছে। যার উৎস দিল্লির একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হস্টেল। রাত পৌনে আটটার মধ্যে মেয়েদের হস্টেলে ঢুকতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি খোলা থাকে রাত দুটো পর্যন্ত। কিন্তু হস্টেলের মেয়েরা নির্দিষ্ট সময়ের পর আর লাইব্রেরিতে থাকতে পারে না।
এইরকম এক হস্টেলের ছাত্রী, অবস্থানের পরিবর্তন চেয়ে দিল্লির অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছে আবেদন জানান। তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে শুরু হয় ‘পিঁজরাতোড়’ আন্দোলন। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলের ছাত্রীরাও তাঁদের প্রতি আইনের অনুশাসনকে লাঘব করার দাবি তোলেন। আর সেজন্য দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার ডিগ্রির ছাত্রীকে হস্টেলের প্রভোস্ট মহিলা বলেন, নিয়ম পাল্টাতে বলছ কেন, ঘরে ছেলে ঢোকাতে চাও? তিরিশ বছর আগে আমার হস্টেলে শোনা সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি। মেয়েদের জন্য আইন শিথিলের দাবি যেন পুরুষ পাওয়ার বাসনা থেকেই। অথবা আজকের এই ছাত্রীকে তাৎপর্যময় ইঙ্গিতে প্রতিবাদ দমনের কৌশলে। এই কৌশল তো পুরুষের তৈরি। ছেলেদের সঙ্গে মিশছ, হাসছ, চলছ, বলছ। তবে তোমার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করা তো অপরাধ নয়। ছেলেদের নাম জুড়ে মেয়েদের অবদমিত করে রাখার এ এক পিতৃতান্ত্রিক চাতুরি। তাঁর নিজের কিছু শেখার নেই, চলার নেই, বলার নেই।
জন্ম থেকে সমাজকাঠামোয় একটি মেয়েকে তৈরি করা হয় শুধু পুরুষের জন্য। একটি ছেলে এবং তার পরিবারের পছন্দের সার্টিফিকেট পাওয়ার তাড়নায় ট্রেনিং চলে মেয়ের। কতটা বাহ্যিক সৌন্দর্যে পাত্রপক্ষের চোখে আকৃষ্ট হবে। বিউটি পার্লার সুন্দরী বানাবে। ফেয়ার এন্ড লাভলি ফর্সা করবে। পুরুষের তারিফে মেয়ে তুমি ধন্য, জীবন তোমার সার্থক। এমন ভাবনায় লালিত হতে হতে মেয়েরা হারিয়ে ফেলেছে তাদের সত্তা। তাই উচ্চডিগ্রিপ্রাপ্ত, চাকরিরত মহিলাদের মধ্যেও সচেতনতার পরিসংখ্যানে আমরা আতঙ্কিতই হই।
গোধরা–কাণ্ডে গুজরাটে দাঙ্গা হয়। তার প্রেক্ষাপটে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেনস স্টাডিজের যৌথ উদ্যোগে ‘সম্পর্ক’ নামে একটি প্রজেক্ট তৈরি হয়। এই প্রজেক্টে যুক্ত হয়ে ছাত্রীদের পাঠিয়েছিলাম সমীক্ষায়। দশজন ছাত্রী একশোজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। সেখানে একটি প্রশ্ন ছিল, ‘সধবা ও বিধবা যাই হোক না কেন, মেয়েদের চিহ্ন ধারণ কি বাধ্যতামূলক?’ অধিকাংশ পুরুষ এবং বহু মহিলাও এই চিহ্ন ধারণের সপক্ষে মত দিয়েছিলেন। এর সঙ্গে নাকি জড়িয়ে আছে স্বামীর কল্যাণ এবং মেয়েদের নিরাপত্তা। চিহ্ন ধারণের অসম্মানে কেন আহত হন না মেয়েরা? তুমি বিবাহিত মানেই অলঙ্কৃত হয়ে শরীরে ফোটাতে হবে সধবার ঔজ্জ্বল্য। স্বামী মারা গেলে বৈধব্যের বিষাদ তাও শরীর দিয়েই, নিজেকে নিরলঙ্কৃত করে বোঝাতে হবে। কিন্তু বিবাহিত বা বিপত্নীক পুরুষদের স্ত্রীর বেঁচে থাকা বা মারা যাওয়ার ওপর তো নির্ভর করে না শরীরে কিছু অর্জন বা বর্জন করার ব্যাপার। আজও টেলিভিশনের সিরিয়ালগুলোতে মাথার সিঁদুরের মর্যাদা রক্ষার প্রচার চলছে রমরমিয়ে। প্রচারক সেই মেয়েরাই। তাঁদের মুখ দিয়েই শোনানো হচ্ছে এই অমূল্য সম্পদকে সযত্নে রক্ষা করার গুণগান।
ট্রেনে যেতে যেতে দুই শিক্ষিকার কথোপকথন কানে এল। একজন দুঃখ করে বলছেন, বৃদ্ধ মা একা বাড়িতে থাকেন তাই নিজের কাছে নিয়ে এলাম। কিন্তু জামাইয়ের বাড়ি বলে তিনি থাকতে চাইছেন না। আমার বাড়ির কাছাকাছি একটা বাড়ি ভাড়া খুঁজছেন। এটা আমার টাকায় কেনা ফ্ল্যাট। জামাই দূরে থাকেন। তবু বুঝতে চাইছেন না। এর উত্তরে দ্বিতীয় শিক্ষিকা বললেন, বোঝা তো উচিত নয়। এটাই রীতি। বিবাহিত মেয়ের টাকা মানেই পরের টাকা। মেয়ের বাড়ি থাকা তো অসম্মানের। দ্বিতীয়জনের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা শব্দগুলো গরম শলাকা হয়ে কানে ঢুকল।
মনে পড়ল অধ্যাপনা জীবনের শুরুতে এক সিনিয়র সহকর্মীর জুনিয়র সহকর্মীকে দেওয়া পরামর্শের কথা। জুনিয়র সহকর্মী সংসারের প্রয়োজনে উপার্জনের টাকা ব্যয় করেন। সিনিয়র দিদি এটাকে বোকামি মনে করে উপদেশ দেন, মেয়েরা আবার সংসার খরচে টাকা দেবে কেন? স্বামীকে বলে দিবি ডাল সবজি ভাত যা জোটাতে পারবে তাতেই সংসার চালাবে। এই দিদিকেই আবার অনেক সময় দেখেছি মেয়েদের অধিকারের প্রশ্নে সরব হতে। এঁদের হাতেই গড়ে উঠছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম! ছেলেমেয়ের সমান অধিকারের কথা উঠছে। অথচ সচেতন চিন্তার চর্চা করছেন না। স্বামীকে হতে হবে স্ত্রীর চেয়ে উচ্চডিগ্রি, উচ্চ চাকরি, বেশি মাইনের। তবে স্ত্রী নিজেকে নিরাপদ এবং সম্মানিত মনে করবেন। এই বৈষম্যের ভাবনা থেকে মেয়েরা মুক্ত হতে না পারলে সমান হতে চাওয়ার প্রসঙ্গ অর্থহীন। এই সংক্রমণের রোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায় আত্মসম্মানবোধ গড়ে উঠলে। বিবাহিত মেয়ে বাবা-মাকে দেখবে না, দাম্পত্য জীবনে আর্থিক সহযোগিতায় অংশ নেবে না, পরনির্ভরশীল হয়ে চলতে চাইবে, আবার নারীমুক্তির কথাও বলবে?
ছোট থেকেই মেয়েকে ঢাকাঢুকি দিয়ে রাখার চল দেখা যায়। বিশেষ করে বহু মুসলিম পরিবারে এই প্রবণতা বেশি। এক সময়ের বাম নেতা, যিনি বর্তমানে শাসক দলে যোগ দিয়েছেন তিনি মুসলিম মেয়েদের পোশাকের ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং তাঁর বাড়ির মেয়েদের পোশাক ব্যবহার নিয়ে গর্ববোধ করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। মেয়েদের বস্ত্র পরিধান নিয়ে পিতৃতন্ত্রের খবরদারি অনেক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই সামনে আসে। কোনও মহিলা কেন ধর্ষিত হল, কতটুকু বস্ত্রে নিজেকে ঢেকেছিল, শরীরের কিছু অনাবৃত অংশই তার ধর্ষণের কারণ কিনা তাও আলোচিত হয়। পোশাক নিয়ে আমিও যে কোনও প্রশ্নের সম্মুখীন হইনি, তা নয়। কেন শাড়ির আঁচল গায়ে জড়াইনি। মাথা কেন খোলা। ওড়না দিয়ে নিজেকে ঢাকিনি কেন। এমন চেনা প্রশ্নের গণ্ডিতেও, দেহ আমার বুঝব আমি এই মানসিকতার ছকেই চলেছি।
সম্প্রতি এক ফেসবুক বন্ধু লিখেছেন, বাড়তি পোশাকের ঢাকনায় মেয়েদের শরীর ঢেকে রাখা কুরুচির ইঙ্গিত। যেন ঢাকনা দিয়ে খাবার ঢাকা। তাই বলছিলাম, পরতে পরতে পিতৃতন্ত্রের জালে জড়িয়ে রেখে আমরা কি শুধুই নারীমুক্তি, নারীশক্তির কাব্যগাথা শুনিয়ে যাব? আগে ঘটুক মেয়েদের চিন্তার মুক্তি, তখনই মুক্ত পথের বাধাকে আমরাই পারব সরিয়ে দিতে।
আজকাল, কলকাতা