চার দশকে পদ্মা নদীর পানি প্রবাহ ২৬ দশমিক ২ শতাংশ কমে গেছে। এই সময়ের মধ্যে পানির গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। আর পদ্মা নদীর আয়তন কমেছে ৫০ শতাংশ। এছাড়া পদ্মা নদীতে মিঠা পানির সরবরাহ কমেছে ৯০ শতাংশ।
একদল গবেষকদের গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ‘বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড কনজারভেশন’ এর ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় গবেষণাপত্রটি প্রকাশ পেয়েছে।
হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হওয়া গঙ্গা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে। এরপর নাম ধারণ করেছে পদ্মা। বাংলাদেশে এর গতিপথ ৩৬৬ কিলোমিটার।
গবেষণায় রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে চারঘাটের সারদা পর্যন্ত পদ্মার ৭০ কিলোমিটারকে বেছে নেওয়া হয়। ১৯৮২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয় গবেষণায়। এ জন্য গবেষকেরা পদ্মার হাইড্রোলজিক্যাল, জলবায়ু এবং নৃতাত্ত্বিক বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করেন। এছাড়া স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিও বিশ্লেষণ করা হয়।
গবেষণার সময় ৭০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ৯টি পয়েন্টে মৎস্য প্রজাতির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। গবেষকেরা পদ্মা পাড়ের ২৭টি জেলে পল্লীতে গিয়ে জেলেদের সঙ্গে কথা বলেন। পদ্মা নদীর এমন করুণ দশার কারণ পদ্মার উজানে দেওয়া ভারতের ফারাক্কা বাঁধ বলে মত দিয়েছেন গবেষকেরা। পদ্মার উৎপত্তিস্থলের ১৮ কিলোমিটার উজানে ভারতে ১৯৭৫ সালে এই বাঁধ দেওয়া হয়। তারপর থেকেই শুষ্ক মৌসুমে মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে একসময়ের খরস্রোতা পদ্মা।
গবেষক দলটিতে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামস মুহাম্মদ গালিব। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল থেকে তিনি জানান, ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগে ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে পানি প্রবাহিত হতো ৯ হাজার ৩২ কিউবিক মিটার। পদ্মার ডাক এসে কানে বাজতো। কিন্তু বাঁধ চালুর পর থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেখা গেছে, পানির প্রবাহ নেমেছে ৫ হাজার ১৪৬ কিউবিক মিটারে।
ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে সেকেন্ডে ২ হাজার ৩৩ কিউবিক মিটারে নেমেছে। মরণফাঁদ ফারাক্কা চালুর আগে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ থাকতো ৩ হাজার ৬৮৫ কিউবিক মিটার। আগে বর্ষা মৌসুমে গড় পানির প্রবাহ ছিল সেকেন্ডে ১২ হাজার ১১৫ কিউবিক মিটার। ফারাক্কা চালুর পর এই প্রবাহ নেমেছে ১০ হাজার ৮২৭ কিউবিক মিটারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, পদ্মা অববাহিকায় গড় বৃষ্টিপাতও কমেছে ১৯ দশমিক ২ শতাংশ। ১৯৮০ সালে পদ্মা অববাহিকায় দৈনিক গড় বৃষ্টিপাত ছিল ৫ দশমিক ২ মিলিমিটার। ২০১৯ সালে এসে তা কমে ৪ দশমিক ২ মিলিমিটারে নেমেছে। বৃষ্টিপাত কমার কারণে তাপমাত্রাও বেড়েছে কিছুটা। ১৯৮১ সালে পদ্মা অববাহিকায় বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ছিল ২৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ফারাক্কা বাঁধ চালুর পরেও ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সালের দিকে পদ্মার পানির গড় গভীরতা ছিল ১২ দশমিক ৮ মিটার। প্রতি সেকেন্ডে ৬ হাজার ৮ কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হতো। এখন গড় গভীরতা নেমে এসেছে ১১ দশমিক ১ মিটারে। পানির প্রবাহ ৪ হাজার ৫৮১ কিউবিক মিটার।
গবেষণায় দেখা গেছে, পদ্মা নদীতে জেলের সংখ্যা ৩৮ গুণ বেড়েছে, কিন্তু কমেছে মাছ। গবেষণার জন্য বেছে নেওয়া এলাকাগুলোতে ১৯৮০ সালে জেলে ছিলেন মাত্র ৭১ জন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬১৬ জন। প্রায় চার দশকে পদ্মা নদী থেকে অনেক মাছের প্রজাতি হারিয়ে গেছে। ১৯৮২ সালে পদ্মায় পাওয়া যেত বড় বাইম বা বামুস আর এক ঠুইটা মাছ। কিন্তু ২০১৭ সালে মাছ দুটির আর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ১৯৯৮ সালের পর থেকে পাওয়া যায় না নানদিনা ও তিলা শোল। ২০১৭ সালেও পাওয়া যায়নি রূপালী কাচনি, চাপিলা, খোরি, ঘোড়া চেলা, বেতাঙ্গী, ঘোড়া মুখো রুই, ইলংগা, পাতি ডারকিনা, জাঁত পুঁটি, কোসা পুঁটি, কাঁটা চান্দা, মলা পুঁটি, ঘনিয়া, কাজুলি, গাং টেংরা, নুনা টেংরাসহ দেশীয় ২৮ প্রজাতির মাছ। অথচ ১৯৮২ সালেও এসব মাছ পাওয়া যেত পদ্মায়।
গবেষকরা বলছেন, তাদের পর্যবেক্ষণ করা এলাকায় পদ্মা নদী দূষণ করছে রাজশাহী সিটি করপোরেশন। শহরের ১৮টি নালার মুখ দিয়ে কোন ধরনের পরিশোধন ছাড়াই বর্জ্যপানি নামছে পদ্মা নদীতে।
এছাড়া পাবনার রূপপুরে পদ্মার তীরে গড়ে ওঠা দেশের একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বিশেষ শিল্পাঞ্চল থেকে পদ্মা নদীতে দূষণ ছড়ানোর আশঙ্কা করেছেন তারা।
গবেষক দলের সদস্য তাসকিন পারভেজ বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা নদীর বেশিরভাগ অংশে এখন পানি থাকে না। মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে কী ধরনের বিরূপ প্রভাব নদীতে পড়েছে সেটা এই গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। নীতিনির্ধারণী মহল এই গবেষণার তথ্য-উপাত্ত নিয়ে পদ্মাকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিতে পারে।’
নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (হাইড্রলিক রিসার্চ) পিন্টু কানুনগোয় বলেন, ‘ফারাক্কা চুক্তি অনুযায়ী পদ্মা নদীতে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য থাকে পদ্মার বেশিরভাগ অংশ। ধু ধু বালুচর হয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে দিনকে দিন। এ অবস্থার উন্নতি করতে হলে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালকে একসঙ্গে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে এগোতে হবে।’