ছোট থেকে তারা বেড়ে উঠেছে পঞ্চগড়ের ‘আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীতে’। এবছর পঞ্চগড় সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে তারা। এসএসসি পরীক্ষায় সাফল্যে তাদের যেন বাধভাঙা উচ্ছ্বাস, চোখে নতুন জীবনের স্বপ্ন।
অনিশ্চিত পথের জীবন থেকে ওঠে আসা এই ছয় বালক একে অপরের বন্ধু। তারা হলেন- শ্রী সাগর টপ্পো, বিপ্লব বাবু, আব্দুল মজিদ, সাজ্জাদুল ইসলাম সিয়াম, আরিফুল ইসলাম জয় এবং সাগর চন্দ্র রায়।
ছোটকালেই তারা বাবাকে হারিয়েছেন। অভাবের তাড়না আর নানা প্রতিবন্ধকতায় থাকা হয়নি মায়ের কাছেও। কখনও নিকটতম স্বজনের স্নেহের পরশ পাবার সৌভাগ্যও হয়নি তাদের। নেই প্রতিবেশি, নেই পরিচিত কেউ। এই ছয় বালক এবার এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। এদের মধ্যে একজন পেয়েছে জিপিএ-৫। সবারই স্বপ্ন প্রকৌশলী হওয়ার, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দুঃখীনি মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার।
আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীটি পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের জলাপাড়া গ্রামে অবস্থিত। অনাথ, ছিন্নমুল এবং বঞ্চিত ও হারিয়ে যাওয়া পথশিশুদের সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এটি।
রোববার (৩০ জুলাই) বিকেলে এই শিশু নগরীতে গিয়ে দেখা যায়, দুই পাশে দুটি বড় বড় ভবন। মাঝে একটি বিশালাকার খেলার মাঠ। শিশুদের পদচারণায় মুখর মাঠটি। সেখানে কথা হয় সদ্য এসএসসি পাশ করা এই ছয় জনের সঙ্গে।
জিপিএ-৫ অর্জন করেছে সাগর টপ্পো। রংপুরের মিঠাপুকুরে তাদের বাড়ি ছিলো। ২০১২ সালে তার দিনমুজুর বাবা সামছুল টপ্পো মারা যান। এরপর থেকেই ছোট্ট সাগর মায়ের সঙ্গে জীবন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, শুরু হয় ভাসমান জীবনযাপন। থাকতে হতো খেয়ে না খেয়ে। পড়ালেখাতো ছিলো কল্পনাতীত। সেখান থেকে এক সমাজকর্মী উদ্ধার করে ২০১৪ সালে এই শিশু নগরীতে ঠাঁই দেয় সাগরকে। এরপর থেকে শুরু হয় তার নতুন স্বপ্ন দেখা। প্রাথমিকেও ভালো ফল ছিলো তার। প্রকৌশলী হতে চায় সাগর।
জিপিএ-৪.৫৪ পাওয়া বিপ্লব বাবু জানায়, সেও বাবা-মায়ের সঙ্গে রংপুরে থাকতো। বাবা এরশাদ আলীর মৃত্যুর পর খুব কষ্টে দিন কাটতো তাদের। ২০১৩ সালে এক দুঃসম্পর্কের স্বজনের মাধ্যমে এখানে আসে। বললো, শুরুর দিকে খারাপ লাগলেও এখন ভালো আছি। এটাই আমার বড় ঠিকানা। এসএসসি পাশ করবো- এটা ছিলো স্বপ্নের মতো। পাশ করেছি, এই অনুভুতি বুঝাতে পারবোনা। পড়ালেখা শেষ করে ভালো কিছু করতে চাই।
জিপিএ-৪.৫৪ পেয়েছেন আব্দুল মজিদ। তার জন্মস্থান চট্টগ্রামে। মজিদ বললো- ২০০৯ সালে বাবা নিরুদ্দেশ হন। বেঁচে আছেন কি-না জানিনা, মা ঢাকায় থাকেন। আমিও ঢাকায় একটি অনাথআলয়ে ছিলাম। সেখানে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। এরপর ঠাঁই হয় এখানে। এখানে থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই পাশের বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে অষ্টম শ্রেণি পাশ করে কারিগরি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হই এবং এবছর এসএসসি পাশ করি। ভালো রেজাল্ট করেছি, সামনে আরো ভালো করতে চাই।
সাজ্জাদুল ইসলামের সিয়ামের রেজাল্ট জিপিএ-৪.৩২। বাবাকে হারিয়েছে অবুঝকালে, থাকা হয়নি মায়ের কাছেও। সিয়াম বললো- কখনো কারো আদর স্নেহ পাইনি। আত্মীয় স্বজন কেউ আছেন কি-না তাও জানিনা। এই শিশু নগরীই আমাদের ঠিকানা। এখানকার স্যারেরাই আমাদের অভিভাবক।
জিপিএ-৩.৮২ পেয়ে উত্তীর্ণ আরিফুল ইসলাম জয় বললো- ঢাকায় থাকতাম। বাবার মৃত্যুর পর এখানে ঠাঁই হয়, মা ঢাকায় গৃহকর্ত্রীর কাজ করে। মাঝে মধ্যে ফোনে কথা হয়। আমাদের বাড়ি কই জানিনা, মায়ের কাছে কখনো জানতেও চাইনি।
জিপিএ-৩.৭১ পাওয়া সাগর চন্দ্র রায় কখনওই বাবাকে দেখেনি। তার জন্মের পর পরই নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন বাবা শলন্ত রায়। বেঁচে আছেন কি-না তাও জানেনা। শুধু জানে তাদের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে, মায়ের নাম কুসু রানী।
আহছানিয়া মিশন শিশু নগরী কর্তৃপক্ষ জানান, বিভিন্ন বয়সি ১৬০ জন শিশু রয়েছে এখানে। এই ৬ জনের মত প্রত্যেকেরই গল্প হৃদয়বিদারক। অনেকেই পরিবার থেকে হারিয়ে যাওয়া, জানেনা নিজের পরিচয়। আবার কারো বাবা নেই, কারো মা নেই। এমনও আছে কারো বাবা-মা দুজনই নেই। তবে এখানে স্বাচ্ছন্দ্যেই থাকছে তারা। সময়মত পড়ালেখা, বাকীসময় খেলাধুলা আর আনন্দ বিনোদনে পার করে তারা।