কলা গাছে ভোট দিন > নতুন করে পুরান কথা

এএইচএম নোমান

রাজনৈতিক দলসমূহকে লক্ষ্য করে ১৯৯৯ সালের ২২ মে তারিখে ‘কলা গাছে ভোট দিন’ শিরোনামে এসোসিয়েশন অফ রিটায়ার্ড প্রফেশনালের সেন্টার ফর মাইক্রো স্টাডিজ আলোচনা সভার আয়োজন করে। এসোসিয়েশনের সভাপতি সাবেক সচিব জনাব এ এম মেসবাহউদ্দিনের সভাপতিত্বে ‘টিটিটি’ হলে সূচনা বক্তব্যে বলেন, দেশের সামগ্রিক প্রতিকূল পরিবেশে যেমন পোষাক শিল্প পরিবহন ব্যবস্থা, টেলিযোগাযোগ, ব্যাংকিং, নির্মাণ, গৃহায়ণ, মুরগী, গরু, মাছের খামার প্রসার ও দারিদ্র বিমোচন কার্যক্রম ইতিবাচক ঘটনাবলী প্রমাণ করে দেশ সম্পর্কে হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই।

আবদুল্লাহ সিদ্দিকী’র উপস্থাপনায় কলাগাছে ভোট দিন সংকলক জনাব মোহাম্মদ আবু মিসির সারকথায় লিখেন:

আপনারা ঢাকা শহরের অন্যতম দ্রষ্টব্য জাতীয় সংসদ দেখেছেন ! অর্থাৎ নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সব ধরনের লোকেরই সমাগম। সেদিক থেকে জাতীয় সংসদ চত্বর প্রায় সত্যিই ‘‘জাতীয়” হয়ে উঠেছে। ভিক্ষা প্রার্থী অথবা চিনাবাদাম বা চানাচুর হকারদের ধরনের দরিদ্ররাও জাতীয় সংসদের চত্বরে স্থান পেয়েছেন।

কোন কোন সরকারে বিচারপতি, উচ্চপদস্থ আমলা, শিক্ষাবিদরাও যোগদান করেন। কাজেই শুধু রাজনীতিবিদদের দোষারোপ করা অন্যায়। মেনে নিতে হবে সংসদ অধ্যক্ষ প্রধানমন্ত্রীর দলের নিয়ন্ত্রণে, তথা সংসদের সকল কার্যক্রম সরকারী দলের ঈশারায় সংসদ অধ্যক্ষ চালনা করেন। রেওয়াজ হয়ে গেছে প্রথমে রাষ্ট্রপতির প্রশস্তি, পরে সরকারের আমলে অগ্রগতির প্রশস্তি এবং সবশেষে নিজ এলাকার ছোটখাট সমস্যার উল্লেখ করে বক্তৃতা দিতে হবে। কলাগাছ না হলে এভাবে সংসদকে সরকারের পর সরকার নিজ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারতোনা। সংসদের চেয়ে রাজপথ বেশী শক্তিশালী, এ কারণেই সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি এবং টাকার খেলা। সেজন্য সকল দলই বলেন আমরা যাদেরকেই মনোনয়ন দিই, তারা কলাগাছ হলেও তাকেই ভোট দিবেন। এইভাবে ঘটনা গড়াতে গড়াতে চরমে ওঠে ভোট ডাকাতি, ভোট কেন্দ্র দখল, ভোটারদের কেন্দ্রে আসা বন্ধ করা, ভোট জালিয়াতি এবং ভোট গণনার আগে ভোট বাক্স ছিনতাইও হয়।

১৯৯৬ সাধারণ নির্বাচনে যা হলো:-
১. ঢাকা শহরে কামাল হোসেন হেরেছেন, অনেক টাকার মালিক হওয়া সত্ত্বেও সালমান এফ রহমান হেরেছেন, কারণ তিনি টাকা খরচ করার অলিগলি জানতেন না।
২. সামরিক, বেসামরিক অনেক আমলা, যারা দু’দলেরই মনোনয়ন চেয়ে যে দলে সফল হয়েছেন সে দলের প্রার্থী হিসেবে জিতেছেন।
৩. দলছুট ব্যক্তিবর্গ যারা নতুন দলে অর্থ ব্যয়ে বড় মুরুব্বী যোগাড় করতে পেরেছেন এবং
৪. যারা দীর্ঘদিন ধরে নিজ এলাকায় শক্ত পেশীর কর্মী বাহিনী পুষেছেন। যেখানেই টাকা ও সন্ত্রাস ক্ষমতার সম্মিলন ঘটেছে সেখানে দলনেতারা অগ্রনী হয়ে এই সব ভাগ্যবানদের মনোনয়ন দিয়েছেন।

সময় এসেছে রাজনৈতিক দল সমূহের প্রার্থী মনোনয়নের একটা সঠিক মাপকাঠি তৈরী করার:

১. কালো টাকার মালিক বলে সুপরিচিত ব্যক্তিদের;
২. সন্ত্রাসী অথবা সন্ত্রাস সহায়ক ব্যক্তিদের;
৩. অস্ত্র, চোরাচালান, মাদক দ্রব্য ব্যবসায়ীদের;
৪. অন্যের সম্পত্তি ভোগকারী, সরকারী সুবিধার অপব্যবহারকারী ও দুর্নীতিতে অভ্যস্ত ব্যক্তিদের;
৫. দলে যোগদানের পর কমপক্ষে পাঁচ বছর হয়নি এমন ব্যক্তিকে মনোনয়ন না দেয়া । মোদ্দাকথা হলো, আর কলাগাছ নয়, এবার যোগ্য ব্যক্তিদের ভোট দেওয়ার সুযোগ চাই।

আলোচনায় অংশগ্রহণকারী যে যা বলেন-

ড. বিনায়ক সেন সিনিয়র রিসার্স ফেলো, বিআইডিএস বলেন, দেশের সামগ্রীক অব্যবস্থা, সন্ত্রাস, দারিদ্র ও স্বৈরাচারীতার অবসানকল্পে সংসদীয় ব্যবস্থার পরিবর্তনের সুপারিশ করেন। দেশে একটি সংসদের স্থলে চার স্তরে বিকেন্দ্রীকৃত বিভাগীয়, জেলা, থানা ও ইউনিয়ন ভিত্তিক সংসদ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এতে কেন্দ্রের ক্ষমতা হ্রাস পাবে ও স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। গত নির্বাচনে শুনা গেছে যে দলীয় নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রার্থীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে তিনি কত টাকা খরচ করতে পারবেন এবং দলকে তিনি কত চাঁদা দিতে পারবেন। সম্পূর্ণ মনোনয়ন পদ্ধতিটা তৃনমূল পর্যায়ে মনিটরিং থাকা উচিত।

ড. মুনতাসির মামুন : রাজনৈতিক দলকে বাস্তবতা মেনে নির্বাচনে নামতে হয়। সেখানে টাকার ভূমিকা থাকবেই। মনোনয়ন মনিটর করা এবং ‘ভোটার এডুকেশন’ প্রোগ্রাম চালু করা সমর্থন করা যায়।

ব্যারিষ্টার রাবেয়া ভূঁইয়া : আমাদের রাজনীতি সম্পূর্ণ ব্যক্তিভিত্তিক। নেতাই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মহিলাদের নিরাপত্তা নাই। সুশাসনের জন্য বর্তমান সংসদীয় কমিটিগুলোকে যথাযথভাবে কার্যকর নাই।

এল কে সিদ্দিকী : অন্ততঃ দু’বার আমরা কলাগাছে ভোট দিয়েছিলাম, ১৯৪৬ ও ১৯৭০ সালে যেখানে দেশ বিভাগ ও স্বাধীনতা লাভের প্রয়োজনে পার্টিই ছিল মূখ্য, প্রার্থীর কোন ভূমিকা ছিলনা।

এডভোকেট সালমা আলী : দেশের সকল সন্ত্রাসীরাই কোন না কোন রাজনৈতিক দলের মদতপুষ্ট। অর্থ বিত্তের অভাবে মহিলারা মনোনয়ন পায় না।

শফিক রেহমান : সংসদ সদস্যরা অসহায়। সংসদ সরকার নিয়ন্ত্রিত। সরকার আমলা নির্ভর। সরকার বদলালেও প্রশাসন বদলায়না। দল-ভিত্তিক মনোনয়ন দলের কেন্দ্রীয় দফতর না দিয়ে দলের স্থানীয় শাখা দিতে পারে। রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্বাচন তহবিল গঠন করে মনোনীত প্রার্থীদের নির্বাচন প্রচার বাবদ অর্থ ব্যয় সীমিত রাখা।

শহিদুল হক খান : জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনীত প্রার্থীকে অবশ্যই স্থানীয় সরকারের কোন একটি স্তরে অন্তত: একবারের জন্য নির্বাচিত এবং সাফল্যের সাথে কার্য্য সম্পাদনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হতে হবে।

কে এম রব্বানী : দল চায় Yes man। দলীয় স্বার্থ ও নির্দলীয় স্বার্থ এক নয়। রাজনীতি এখন প্রায় সর্বগ্রাসী। ফলে জনগণ দলীয় সরকার অপেক্ষা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপর বেশি আস্থাশীল। প্রচলিত গণতন্ত্র চর্চায় দেশে নিরপেক্ষ সরকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।

এএইচএম নোমান : আলোচনা শুধু Drawing room এ সীমাবদ্ধ না রেখে Media তে নিয়ে যেতে হবে। উপযুক্ত Forum এর মাধ্যমে তৃনমূল পর্যায়ে মনোনয়ন তদারকী এবং পরিবেশ পরিবর্তনের জন্য ভোটার এডুকেশন দরকার। সংশ্লিষ্ট অনেক প্রতিষ্ঠান বয়স্কশিক্ষা কার্যক্রমে ‘সচিত্র ভোটের কথা’ পুস্তিকা ছাপিয়ে ব্যবহার করে।

মিসবাউদ্দিন খান : সংসদের অনুমোদন ছাড়াই হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। এর জবাবদিহিতার কোন উপায় নাই, কারণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা হয়ত অবসর গ্রহণ করেছেন অথবা বিদেশে চলে গেছেন। কারণ রাজনৈতিক নেতা, কর্মী ও ভোটার সবাই চাইবেন সাংসদদের কাছ থেকে নানা রকম সুযোগ সুবিধা, যেমন, মেয়ের বিয়ের টাকা, ছেলের খতনার টাকা, সংসার খরচ ইত্যাদি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোন পরিবর্তন আনেন না। রাজনৈতিক দলের মনোনীত কলাগাছকে ভোট দিলে অন্তত: একছড়া কলা তো খাওয়া যাবে।

আব্দুল মান্নান চৌধুরী : তৃনমূল পর্যায়ে মনোনয়ন হতে হবে। সংসদে উচ্চ পরিষদ ও নিম্ন পরিষদ প্রবর্তন করা বাঞ্ছনীয়।

ড. এ কে ফজলুল কবীর : বর্তমান দলের সমর্থনে বিত্তবান কলাগাছরা ভোট কিনে নিচ্ছে।

ড. ফয়জুর রহমান আল-সিদ্দিক : সংসদ ভবনকে মনে হয় গণতন্ত্রের কবর স্থান। রাজনৈতিক দলগুলি বিত্তবানদের কাছে দায়বদ্ধ। দলের উচিত বিত্তবান ও শিল্পপতিদের পরিবর্তে দেশের জন্য নিবেদিত প্রান ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেয়া।

ব্যরিষ্টার আবদুল হক : আমলাতন্ত্রের উপর নীতি নির্ধারনের ভার দিলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। আমলা বা রাজনীতিবিদ সুশাসন নিশ্চিত করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলির যে নীতি আদর্শ থাকা উচিত তা তাদের নাই।

কফিলউদ্দিন মাহমুদ : আলোচনা পত্রে যে সকল সমাধান চাওয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন করবে কে ? সরষের ভিতরেই যে ভূত রয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এসকল প্রস্তাব মেনে নেবে না।

সমাপনী বক্তব্যে ড. মোজাফ্ফর আহমদ : দেশে নির্বাচনের পরিবেশ ক্রমান্বয়েই নোংরা হয়ে যাচ্ছে। এর থেকে বেড়িয়ে আসার একটা সংস্কৃতি তৈরী করতে হবে। একেবারে গোড়াতে অর্থাৎ শিক্ষা ক্ষেত্র থেকেই সংস্কার শুরু করতে হবে। কারণ পিতা মাতার পরে শিক্ষকরাই প্রকৃত Role model হিসাবে কাজ করতে পারে। শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি দূর করতে হবে।

সেই দুই যুগ পূর্বের এ-সব কিছুই পুরানো কথা নতুন করে বলা।

২০০৭-৮ সাল থেকে বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ- বামাসপ ‘সার্বজনীন নির্বাচন ব্যবস্থাপনা পরিষদ-সানিবপ’ গঠন করার বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা-কাঠামোসহ প্রস্তাব করে আসছে। সানিবপ মৌলিক কথা হলো- বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিগত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিএনপি এর যৌথ সিদ্ধান্তে এ পরিষদ কাজ করবে। নির্বাচন কমিশনের নিয়ম-নীতির কাঠামোতে থেকে জাতীয় পর্যায় থেকে গ্রামের ভোট কেন্দ্র পর্যন্ত নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল/স্বতন্ত্র প্রার্র্থী, সিভিল সোসাইটি, এনজিও এবং পেশাজীবী সংগঠন প্রতিনিধি সানিবপ’র সদস্য হবে। সানিবপ সাংবিধানিক নির্বাচন কমিশনের সহযোগী শক্তি হয়ে Buffer কাজ করবে। সভা, সেমিনার, মিডিয়া, ওয়ার্কশপের মাধ্যমে বড় দলসহ প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের উঁচু পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ সুশীল সমাজসহ প্রথম থেকেই এ প্রস্তাব দেশ ও বিদেশে প্রচুর সমাদৃত হয়। কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়ায় বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? নির্বাচন কমিশন প্রধান বা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ কে ঘণ্টা বাঁধকের উদ্যোগ নেওয়ার বিনীত আবেদন জানাই।
আল্লাহ্ সহায় হউন।

লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ-বামাসপ।
Email: nouman@dorpbd.org

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts