এএইচএম নোমান
সকল দলের আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার মানসিক চিন্তা ভাবনা নিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়া একান্ত জরুরী। বর্তমান পরিস্থিতি ও স-ব অবস্থার প্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট যে, সকল প্রশ্ন-বিতর্ক, সংঘাত-অরাজকতা, অস্থিরতা, ধবংসাত্মক পরিস্থিতির বিপরীতে একমাত্র সকলের গ্রহণীয়তা, জবাবদিহিতা ও শান্তিকামিতাই পারবে প্রকৃত গণতন্ত্রের নির্বিঘ্ন চলার পথে অর্থনৈতিক মুক্তির বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে। পরিস্থিতির শঙ্কা-সমস্যার একমাত্র সমাধান হতে পারে সকলের নিকট গ্রহণীয় একটি ব্যবস্থা ও কার্যকর পদ্ধতি। এজন্য ‘সার্বজনীন নির্বাচন ব্যবস্থাপনা পরিষদ’- সানিবপ (Universal Election Management Council-UEMC) গঠন প্রস্তাব করছি।
আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ভোটারদের স্বাধীন ইচ্ছায় গণতান্ত্রিক সরকার গঠন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে এই পরিষদ সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে। আমরা গভীরভাবে বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক দলই দেশ পরিচালনা করবে ও ক্ষমতায় আসীন হবে। অপরপক্ষে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। এভাবেই এদেশে গণতন্ত্র শেকড় পর্যায় থেকে রাষ্ট্রিয় পর্যায় পর্যন্ত কাঙ্খিত জনকল্যাণমূলক ফল দিতে শুরু করছে-করবে। শান্তির জন্য কেবল ধৈর্য, পরমতসহিষ্ণুতা ও পরস্পর আদর্শিক শ্রদ্ধাবোধ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করবে।
কাঠামো ও গঠন প্রণালী :
ক্ষমতাশীন দল যেমন বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও সাম্প্রতিক অতীত (Immediate past) দল যেমন বিএনপি (২০০১-২০০৬) সভাপতি/চেয়ারম্যান যৌথ ভাবে সানিবপ এর দায়িত্ব পালন করবেন। দলের অনুমোদনে জোটভুক্ত দলের সভাপতি/চেয়ার বদল হতে পারে।
১. এই পরিষদের কাঠামো হবে ৫ স্তর বিশিষ্ট ক. জাতীয় খ. জেলা গ. আসন/উপজেলা ঘ. ইউনিয়ন, ঙ. ভোট কেন্দ্র। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্ট ধাপের কর্মকর্তা, সুশীল সমাজ, শিক্ষক, গণমাধ্যম প্রতিনিধি, পেশাজীবি, ব্যবসায়ী, আইনজীবি, অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা, শিক্ষক ও এনজিও প্রতিনিধি এ পরিষদের সদস্য হবেন।
২. প্রত্যেক রাজনৈতিক দল থেকে ৩ জন করে প্রতিনিধি থাকবেন। তাঁরা হলো সংশ্লিষ্ট পর্যায়ের রাজনৈতিক দলেরঃ সভাপতি/চেয়ারপর্সন, সেক্রেটারী ও সাংগঠনিক সম্পাদক। ধরুন সেখানে রয়েছে ৫টি দল ঢ ৩ জন = ১৫ জন কমিটির ব্যবস্তাপনায় ক. ইউনিয়ন, খ. নির্বাচনী এলাকা/উপজেলা, গ. জেলা এবং ঘ. জাতীয়-এ চার পর্যায়েই সাচিবিক ধাপ/শাখার সভাপতিদ্বয় সভাপতির যৌথ দায়িত্ব পালন করবেন।
৩. নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট পর্যায়ের কর্মকর্তা সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন।
৪. নির্বাচন কমিশন তালিকাভুক্ত নির্বাচনে দেশীয়-এলাকা পর্যবেক্ষণ সংস্থা/এনজিও প্রতিনিধি, যুগ্ম সচিব হবেন।
৫. নির্বাচন কমিশন বা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, অথবা তৎকর্তৃক সাব-কমিটি গঠন ক্রমে রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে ওয়ার্কিং পেপার দিয়ে সংলাপের মাধ্যমে সার্বজনীন নির্বাচন ব্যবস্থাপনা পরিষদ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন।
নির্বাচন ব্যবস্থাপনা পরিষদ-মূল ফ্রেমে থাকবে:
প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়া, নির্বাচন কমিশন ঘোষিত এবং গ্রহণীয় ফ্রেম অনুযায়ী হবে। এ পরিষদ নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ, স্বাধীন, স্বচ্ছ, শক্তিশালী ও গতিশীলতায় সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। এটি রাজনৈতিক দল, পেশাজীবি সংগঠন, এনজিও নেটওয়ার্কসহ সুশাসন বিনির্মাণে গণতন্ত্র চর্চ্চা ও ব্যবহারিকতা আনয়নে সহায়ক হবে।
সার্বজনীন নির্বাচন ব্যবস্থাপনা পরিষদ গঠন ও মেয়াদকাল :
জাতীয় নির্বাচনকে সুষ্ঠু, গ্রহণীয় ও সার্বজনীনভাবে কার্যকর করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন, সকল রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, জনপ্রতিনিধি, আগ্রহী ব্যক্তি, জোট ও পেশাজীবি সংগঠনের প্রতিনিধি সমন্বয়ে এ পরিষদ গঠন করবে। এ পরিষদ নির্বাচন কালে প্রার্থী প্রাক-মনোনয়ন, প্রচারণা, নির্বাচন পরিচালন অর্থাৎ নির্বাচন শুরু ও ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের সহায়ক (বাফার সংগঠন) দায়িত্ব পালন করবে। নির্বাচন শুরু ও ফলাফল প্রক্রিয়া পর্যন্ত দল-বিদল, মত ও পন্থা অনুযায়ী কারা কোথায়, কী ধরনের অবস্থান ও কার্যক্রম নিবেন তা রাজনৈতিক দল ও প্রতিনিধি অর্থাৎ এই পরিষদ একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমে থেকে নীতিগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে।
পরিষদের মেয়াদকাল হবে নির্বাচন বছরে বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন থেকে পূর্বের ৬-৯ মাস ও পরবর্তি ৩ মাস অর্থাৎ মোট ৯-১২ মাস। এই পরিষদ শুধু নির্বাচন ফলাফলসহ dispute সমাধান পর্যন্ত একটা নীতিগত নিরপেক্ষ ফ্রেমে থাকবে।
মনোনয়ন কাঠামো :
নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়া নির্বাচনী এলাকায়ই প্রায় সমাপ্ত হবে। জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মনোনয়ন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে নির্বাচন ফলাফল পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে সহায়ক শক্তি হিসেবে এ পরিষদ কাজ করবে।
প্রার্থী মনোনয়ন কে ঠিক করবে ও কিভাবে করবে :
স্থানীয় রাজনৈতিক দল বা নির্বাচক মন্ডলীর প্রস্তাবে ও সমর্থনে প্রতি নির্বচনী এলাকায় গঠিত দলীয় কমিটি প্রার্থী মনোনয়ন/প্রস্তাব করবে। সানিবপ সংসদ এলাকার প্রতিটি ইউনিয়নে দু’বারে ২টি জনসভা করবে। প্রথমটি অবহিতকরণ ও প্রস্তুতি সভা। ইউনিয়ন পরিষদ অঙ্গন বা উদ্যোক্তাদের আলোচনাক্রমে যে কোনো খোলা জনসমাগমস্থল হতে পারে। উভয় সভার জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে মাইক, চুঙ্গা, ঢোল, সহরত বা স্থানীয় যে কোনো বা সাধ্যমত সকল প্রকার প্রচারণার ব্যবস্থায় স্থানীয় জনগণের সমর্থনে মনোনয়ন প্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকাভুক্ত হবে। সকল ইউনিয়নে জনসভা শেষ করে উপজেলা পরিষদ/সংসদ এলাকা পর্যায়ে বৃহৎ জনসভার মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে দলীয়ভাবে প্রস্তুত নাম তালিকাভূক্ত ঘোষণা করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সানিবপ তার এলাকা থেকে প্রাপ্ত তালিকার সকল প্রার্থীর অংশগ্রহণে ‘ছাকুনি-ঝাকুনি’র মাধ্যমে নির্বাচনী এলাকার প্রার্থী তালিকা তৈরী করবে। সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলওয়ারী বাছাই চূড়ান্ত করে মনোনয়নের জন্য জেলা কমিটির মাধ্যমে জাতীয় কমিটির কাছে সুপারিশ করবে। এ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা পরিষদ দলীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপে যাবে।
নির্বাচনী প্রচারণা :
নির্বাচন কমিশন নীতি মালা অনুযয়ী প্রতি গ্রাম, পাড়া, ইউনিয়ন, জনমসাগমস্থল, বাজার পুরো এলাকা মিলে ২০-২৫টি সভা হবে। একই মঞ্চে সকল প্রার্থী যার যার নির্বাচনী ওয়াদা, দলীয় আদর্শ ও ইস্তেহারসহ বক্তব্য রাখবেন।
নির্বাচনী ফান্ড-ব্যয়:
কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন কমিশন সরাসরি বা দলকে নির্বাচনী ফান্ড দিতে পারে অথবা প্রতিটি আসনে নির্বচনী কার্য পরিচালনার জন্য প্রতি প্রার্থী তাদের নির্বাচনী নির্দিষ্ট বাজেট থেকে ২০-২৫ লক্ষ টাকা আসন/উপজেলা সানিবপ তহবিলে প্রদান করবে। নির্বাচনী ব্যয় কমালে নির্বাচন সহনীয় হবে। ফলে কালো টাকা মালিকদের দাপট কমবে। সৎ, সজ্জন ও যোগ্য প্রার্থীদের পক্ষে মনোনয়ন পাওয়া সহজ হবে। এখন নির্বাচনী ব্যয়ের অজুহাতে অনেক সৎ ও সজ্জন ব্যক্তিকে রাজনৈতিক দল মনোনয়ন দিচ্ছে না। মোটা দাগে বলা যায় প্রতি আসনে সাকুল্যে এক থেকে দেড় কোটি টাকা বাজেটে ব্যবস্থাপণা ব্যয় সংকুলান হবে। প্রার্থী ও আসন বাস্তবতায় কম বেশী হতে পারে (বাজেট ব্যয় খাত বিস্তারিত তৈরী আছে)।
তাহলে বৈষম্যহীন স্বনির্ভর বাংলাদেশ বিনির্মাণ হবে। শোষনহীন সমাজ ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্রের স্বাদ ও সুফল দেশবাসী সমভাবে ভোগ করবে। রাজনৈতিক/দলীয় সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা যে নামেই হোক না কেন প্রস্তাবিত এ সানিবপ ‘বাফার’ সংগঠন হয়ে কাজ করবে। তা হলেই স্থায়ীভাবে স্বাধীন মুক্ত দেশে স্বাধীন রাজনীতির জন্য স্থায়ীভাবে সকলের কাছে গ্রহণীয় ‘সার্বজনীন নির্বাচন ব্যবস্থাপণা পরিষদ’ কার্যকর হবে।
উপসংহারঃ
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সকলের নিকট গ্রহণীয় করতে, সানিপব গঠনের মাধ্যমে আদর্শিক রাজনৈতিক কালচার সৃষ্টি করি। তাই এখন থেকেই নির্বাচন কমিশন (প্রধান নির্বান কমিশনার জনাব হাবিবুল আউয়াল) বা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে ওয়ার্কিং পেপার দিয়ে সংলাপের মাধ্যমে সানিপব গঠন ও কার্যকরিতা শুরু করার দাবী জানাই। প্রস্তাবিত সানিপব নির্বাচন কমিশনের ছাতা ও পক্ষে সমন্বয় করবেন। নির্বাচন ব্যবস্থা, পদ্ধতি বা সংস্কার নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে বিশেষ করে দেশবাসীর প্রত্যাশার আশ্রয়স্থল নির্বাচন কমিশনের বা দায়িত্ববান রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন দলকে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করার আহবান জানাই।
এএইচএম নোমান: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ-বামাসপ এবং সদস্য ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ-EWG
ই-মেইল: nouman@dorpbd.org