মো. সাখাওয়াত হোসেন
অপরাধবিজ্ঞানী সাদারল্যান্ড বলেছেন, criminal behavior is learning অর্থাৎ অপরাধপ্রবৃত্তি মানুষ ক্রমান্বয়ে শিখে এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পরে অপরাধী হয়ে উঠে এবং সমাজের নিকট ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত হয়। প্রসঙ্গক্রমে যারা রাজনৈতিক অপরাধী তারা কিন্তু একদিনে অপরাধী হয়ে উঠেনি, একটি নির্দিষ্ট সময় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় তথা পৃষ্ঠপোষকতায় থেকে অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে এবং রাজনৈতিক নেতাদের ইশারায় স্থিতিশীল পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার মানসেই তাদের অপকর্মগুলো সংঘটিত করে জনমনে ভয় ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে থাকে। কাজেই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, যারা রাজনৈতিক অপরাধী তাদের অবশ্যই পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং একটি নির্দিষ্ট দলের যোগসাজশে তারা পরিচালিত হয় ও দলের ইঙ্গিতে অপকর্ম করে জনগণকে ভোগান্তির মধ্যে ফেলে। কাজেই যে সকল রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী অপরাধীদের আশ্রয় প্রশ্রয় প্রদান করে এবং দলের স্বার্থে (দেশের স্বার্থে নয়) অপরাধীদের ব্যবহার করে, এ ধরনের গোষ্ঠী কিংবা দল কখনোই জনগণের কল্যাণার্থে কোনরূপ কর্মকান্ড সম্পাদন করতে পারে না।
অপরাধবিদ Cloward and Ohlin এর মতে-একজন ব্যক্তি অবশ্যই অপকর্মে (deviant behaviour) সম্পৃক্ত হয়ে উঠবেন যদি তিনি অপকর্ম শেখার অনুকূল পরিবেশ পায় এবং এ ক্ষেত্রে অপকর্ম শেখার পরিবেশের কারণে অন্যদের আহবান করা কিংবা ডাকার বিষয়েও দক্ষতা ও গুণাগুণ অর্জন করতে পারে। অপরাধবিদগণ মনে করেন অপরাধের সুযোগ (scope of ability) কিংবা পরিবেশ (environment) তৈরি অপরাধ প্রবণতার জন্য বহুলাংশে দায়ী। এ ক্ষেত্রে যে বা যারাই উদাহরণ সৃষ্টি করে থাকে তাদেরকে কিন্তু অপরাধকর্মের জন্য দায়ী করা যেতে পারে। অর্থাৎ তারা অন্যদের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করে থাকে কিংবা অন্যদেরকে অপরাধের দিকে উদ্বুদ্ধ করে তোলে, অপরাধের দিকে প্ররোচণা প্রদান করে।
সাম্প্রতিক সময়ে বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশ ঢাকা শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ রাজনীতির জন্য এ ধরনের স্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রত্যাশা করে থাকে। কিন্তু দেখা গেল সমাবেশ পরবর্তী সময়ে ঈগল পরিবহনের বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে, দুর্বৃত্তদের অতর্কিত হামলায় পুলিশ আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। এ ধরনের সহিংস আচরণ রাজনীতির মাঠে কাম্য নয়। এ কথা অনিবার্যভাবে সত্য যে, নির্বাচনকে ঘিরে একটি গোষ্ঠী উৎপেতে থাকে; সুযোগের সন্ধানে থাকে। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, সাময়িক সময়ের জন্য হলেও রাজনীতির মাঠে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পরিবেশকে উত্তপ্ত করে মুনাফা লুটিয়ে নেওয়া। নির্বাচন সময়ের প্রেক্ষিতে এ গ্রুপটি শক্তিশালী এবং একটিভ। কাজেই এ গ্রুপটিকে যারা সুযোগ তৈরি করে দেয়, সহিংস আচরণের জন্য তাদেরকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে।
কিন্তু যারা রাজনীতিতে একটি প্ল্যাটফরম দখল করে আছেন, উৎপেতে থাকা সুযোগ সন্ধানীদের তারাই সুযোগ করে দেয় এবং এ গ্রুপটিই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অপরাধীদের মদদ দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে কর্ম সাধন করে থাকে। সুতরাং এ ঘটনার ধারাবাহিকতায় যে অপরাধগুলো সংঘটিত হবে, এর দায়ও তাদেরকেই নিতে হবে কিন্ত। কারণ একটি ঘটনাই পরবর্তী ঘটনাগুলোর জন্ম দেয় এবং সুযোগ ও পরিবেশ তৈরি করে থাকে অন্যান্য অপরাধীদের ক্ষেত্রে। এ জন্যই জ্বালাও পোড়াও এর ঘটনা একটি কোনভাবে ঘটে থাকলে পরবর্তীতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশংকা থেকেই যায়।
জ্বালাও পোড়াও এর চিত্র কখনোই ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনতে পারে না। জ্বালাও পোড়াও এর কারণে যে কেউ যে কোন সময়ে হতাহত হয়ে সারাজীবনের জন্য ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে। আমরা যদি ক্ষতিগ্রস্থতার চরিত্র উদঘাটন করতে চাই তাহলে দেখা যায় জ্বালাও পোড়াও এর কারণে বহুমাত্রিক ক্ষয়ক্ষতি সম্পাদিত হয়ে থাকে। প্রথমত: প্রাথমিক ক্ষতিগ্রস্থতা (primary victimization) অর্থাৎ ব্যক্তি শারীরিকভাবে আক্রমণের শিকার হয়ে থাকে (আঘাত প্রাপ্ত হওয়া, মৃত্যুর কোলে ঢলে পরা, দীর্ঘমেয়াদে রোগে ভোগা প্রভৃতি); মাধ্যমিক ক্ষতিগ্রস্থতা (secondary victimization) অর্থাৎ ব্যক্তির সম্পত্তির ক্ষতিগ্রস্থতা, এ যাত্রায় ব্যক্তি শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখোমুখি হয়ে থাকে (টাকা পয়সার লুটপাট, গাড়ি ভাংচুর, ঘরবাড়ি লোপাট প্রভৃতি; সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্থতা (tertiary victimization) অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করে দুষ্কৃতিকারীরা বিশেষ করে সরকারি স্থাপনা ধ্বংস করে পুরো রাষ্ট্রের মানুষকে ক্ষতিগ্রস্থ করে থাকে এ চক্রটি। রাজনীতির বিভিন্ন পর্যায়ে দেখেছি আন্দোলনের নামে কতিপয় গোষ্ঠী ঢাকা শহরে রাষ্ট্রীয় স্থাপনা বিনষ্ট করে উল্লাসে মেতেছে।
খোলা চোখে দেখলে দেখা যায়, জ্বালাও পোড়াও এর রাজনীতি কোনভাবে বিতর্কিতরা শুরু করতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে স্থবিরতা নেমে আসতে পারে। দেখা যাবে, হরতাল অবরোধের মত ধ্বংসাত্নক কর্মসূচির অবতারণা হতে পারে। রাস্তা ঘাট অচল করে দেওয়ার পায়তারা হতে পারে। দোকান পাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে দেশের সচল অর্থনীতি অচল হয়ে যাবে। বিদেশী বিনিয়োগ কমে আসবে, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাবে।ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপক ক্ষতি হবে। দেশের স্থিতিশীল রাজনীতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অপরাধচক্রের যোগসাজশে অপরাধীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠবে প্রিয় স্বদেশ। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভুলুন্ঠিত হয়ে উঠবে। প্রাতিস্বিক আচরণে প্রিয় স্বদেশ তাঁর স্বকীয়তা হারাবে। সে কারণেই এ ধরনের পরিস্থিতির অবতারণা যাতে কোনভাবেই না হয়ে উঠে তৎপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশী প্রত্যেকটি নাগরিকদের সচেতন ও সজাগ থাকতে হবে এবং যারা এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে পরোক্ষভাবেও জড়িত তাদেরকে এখনই বয়কট করতে হবে।
রাজনীতিবিদদের জানা উচিত, বাংলাদেশের জনগণ কি প্রত্যাশা করে? এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এ দেশের মানুষ সংঘাত সহিংসতাকে প্রশ্রয় দিতে জানে না। জ্বালাও পোড়াও এর অপরাজনীতি এ দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে একেবারে বেমানান। রাজনীতিবিদদের এ বিষয়টি চিন্তা করে সামনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষেত্রে জ্বালাও পোড়াও অত্যন্ত প্রতিবন্ধক। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের উচিত হবে, যে বা যারাই জ্বালাও পোড়ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকুক না কেন তাদের পরিচয় চিহ্নিত করা। পরবর্তী পর্যায়ে চিহ্নিতকারীদের মাধ্যমেই তাদের গোটা চক্রকে সনাক্ত করে সারা দেশের মানুষকে জানানো উচিত। নির্বাচন নির্বাচনের প্রক্রিয়া মোতাবেক অনুষ্ঠিত হবে। এ ক্ষেত্রে কোনরূপ আপত্তি থাকলে রাজনীতিবিদরা নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে এবং এটিই চায় এ দেশের আপামর জনসাধারণ। নির্বাচন আয়োজনের নামে, জনগণকে ভোগান্তির মধ্যে রেখে কোন কর্মসূচি প্রণয়ন করা কোনভাবেই সমীচিন নয়।
আমরা মনে করি, সকল পর্যায়ের রাজনীতিবিদেরা জনগণের সুবিধা অসুবিধার বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করবে। কেননা এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচির আড়ালে কুচক্রিমহল রাজনীতির পরিবেশকে অস্থিতিশীল করার মানসে যে কোন ধরনের ধ্বংসাত্নক কর্মসূচি গ্রহণ করতেও দ্বিধা করবে না। বিশেষ করে সরকারের ইন্টিলিজেন্সি উইং এ সংক্রান্তে আরও তৎপর হয়ে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও জোরালো ও তৎপর ভূমিকা পালন করতে হবে বিশেষ করে নির্বাচন আয়োজনের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত। অবশ্য এ ব্যাপারে যাদের বিরুদ্ধে পূর্ববর্তী সময়ে আগুন সন্ত্রাসের অভিযোগ রয়েছে, জ্বালাও পোড়াও এর সঠিক তথ্য রয়েছে কিংবা এ সংক্রান্তে অভিযোগের কারণে জামিনে রয়েছে তাদের ব্যাপারে বিশেষ নজরদারির প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ কখনোই রাজনীতির মাঠকে উত্তপ্ত দেখতে চায় না সে কারণেই বলা চলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জ্বালাও পোড়াও এর আবির্ভাব একেবারেই প্রাসঙ্গিক নয়।
লেখক-চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।