নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন

বাংলাদেশের বিচিত্র শ্রমজীবি, পেশাজীবী, বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সমাজজীবন ও তাদের আবহমান কালের সংস্কৃতিকে নাটকে মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিদান করে যিনি নিজেকে খ্যাতির শিখরে নিয়েছেন, তিনি সেলিম আল দীন।

তাকে বলা হয় নাট্যাচার্য। মুক্তিযুদ্ধের পর নাট্য আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব সেলিম আল দীনের ৭৫তম জন্মদিন আজ। তার জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনীর সোনাগাজী থানার সেনেরখিল গ্রামে।

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই যুক্ত হন ঢাকা থিয়েটারে। ১৯৭৪ সালে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ওই বছরই বেগমজাদী মেহেরুন্নেসার সঙ্গে বিয়ে হয় তার। মধ্যযুগের বাংলা নাট্যরীতি নিয়ে গবেষণা করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বাংলা নাট্যকোষেরও প্রণেতা তিনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠা সেলিম আল দীনের হাত ধরেই। তিনি ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ১৯৮১-৮২ সালে নাসিরউদ্দীন ইউসুফকে সাথি করে গড়ে তোলেন গ্রাম থিয়েটার।

তিনি শুধু নাটক রচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, নাট্যবিষয়ক বহু গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা পূর্বক বাঙলা নাটকের সহস্র বৎসরের ইতিহাস এবং তার একটি সুস্পষ্ট আঙ্গিক নির্মাণেও সমর্থ হন, রচনা করেন মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য (১৯৯৬)। বাঙলা ভাষার একমাত্র নাট্যবিষয়ক কোষগ্রন্থ বাঙলা নাট্যকোষ সংগ্রহ, সংকলন, প্রণয়ন ও সম্পাদন করে বাঙলা নাট্যের কোষগ্রন্থের অভাব পূরণ করতেও সক্ষম হয়েছেন তিনি। নাট্য বিষয়ক গবেষণা পত্রিকা থিয়েটার স্টাডিজ-এর সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এছা্ড়া, নাট্যশিক্ষার্থীদের জন্য তিনি অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন নাট্যবিষয়ক গ্রন্থ নন্দিকেশ্বরের অভিনয় দর্পণ (১৯৮২)।

তার প্রকাশিত অন্যান্য সাহিত্যকীর্তির মধ্যে রয়েছে- কাব্যগ্রন্থ-কবি ও তিমি (১৯৯০), উপন্যাস-অমৃত উপাখ্যান (২০০৫)। তাঁর রচিত সব সৃজনকর্ম নিয়ে পাঁচ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র [১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ (২০০৫-২০০৯)]।

তার রচিত হরগজ নাটকটি সুইডিশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এ নাটকটি ভারতের রঙ্গকর্মী নাট্যদল কর্তৃক হিন্দি ভাষায় মঞ্চস্থ হয়েছে। সেলিম আল দীনের নাটক ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত।

অল্প বয়স থেকেই সলিম আল দীনের লেখক জীবন শুরু হলেও ১৯৬৮ সালে কবি আহসান হাবিব সম্পাদিত ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে আমেরিকার কালো মানুষদের নিয়ে তাঁর প্রথম বাংলা প্রবন্ধ নিগ্রো সাহিত্য প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম রেডিও নাটক বিপরীত তমসায় ১৯৬৯ সালে এবং প্রথম টেলিভিশন নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় লিব্রিয়াম (পরিবর্তিত নাম ‘ঘুম নেই’) প্রচারিত হয় ১৯৭০ সালে। আমিরুল হক চৌধুরী নির্দেশিত এবং ‘বহুবচন’ কর্তৃক প্রযোজিত তাঁর প্রথম মঞ্চনাটক সর্প বিষয়ক গল্প মঞ্চায়ন হয় ১৯৭২ সালে।

তার উল্লেখযোগ্য নাটক ও নাট্যগ্রন্থ- সর্প বিষয়ক গল্প ও অন্যান্য নাটক (১৯৭৩), জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন (১৯৭৫), বাসন (১৯৮৫), তিনটি মঞ্চ নাটক: মুনতাসির, শকুন্তলা ও কিত্তনখোলা (১৯৮৬), কেরামতমঙ্গল (১৯৮৮), প্রাচ্য (১৯৯৮), কিত্তনখোলা (১৯৮৯), হাতহদাই (১৯৯৭), যৈবতী কন্যার মন (১৯৯৩), চাকা (১৯৯১), হরগজ (১৯৯২), একটি মারমা রূপকথা (১৯৯৫), বনপাংশুল (১৯৯৬), নিমজ্জন (২০০২), ধাবমান, স্বর্ণবোয়াল (২০০৭), ঊষা উৎসব ও স্বপ্নরমণীগণ (নৃত্যনাট্য, ২০০৭), পুত্র (২০০৮) ইত্যাদি।

নাট্য ও গবেষণামূলক রচনাকর্মের পাশাপাশি তিনি টেলিভিশন নাটক রচনা, চলচ্চিত্রের সংলাপ রচনা ও মঞ্চনাট্যের নির্দেশক হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে এবং ঢাকা থিয়েটার তিনি যে সব নাটকের নির্দেশনা দেন সেগুলো হলো- মহুয়া (মৈমনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে) (১৯৯০), দেওয়ানা মদিনা (মৈমনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে) (১৯৯২), একটি মারমা রূপকথা (মারমা রূপকথা ‘মনরিমাংৎসুমই’ অবলম্বনে) (১৯৯৩), কাঁদো নদী কাঁদো, মেঘনাদবদ (অভিষেক নাম পর্ব)।

তার নাটকের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে একধিক চলচ্চিত্র, যেমন- ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘চাকা’ নাটকের চলচ্চিত্রায়ন করেন চলচ্চিত্র পরিচালক মোর্শেদুল ইসলাম এবং ২০০১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর কিত্তনখোলা নাটক নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন আবু সাইয়িদ।

১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত ‘একাত্তরের যিশু’ চলচ্চিত্রের সংলাপ রচনার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।

বাঙলা নাটকে অসামান্য অবদানের জন্য দেশে বিদেশে তিনি বহুবার সংবর্ধিত এবং জাতীয় পুরস্কারসহ বহু পরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পুরস্কার হলো- বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৬), নান্দীকার পুরস্কার (আকাদেমি মঞ্চ কলকাতা, ১৯৯৪), শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নাট্যকার (টেনাশিনাস পুরস্কার) (১৯৯৪), খালেকদাদ সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (একাত্তরের যীশু, শ্রেষ্ঠ সংলাপ) (১৯৯৪), একুশে পদক (২০০৭), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (২০০৭) ইত্যাদি।

তিনি ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কেন্দ্রীয় মসজিদের কাছে তাকে সমাহিত করা হয়।

 

-শাহ মতিন টিপু

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts