বিবৃতি পক্ষপাতদুষ্ট কেন?

মো. সাখাওয়াত হোসেন

 

প্রতিষ্ঠিত ইমেজ কোন কারণে ক্ষুণ্নু হলে সেটি ফেরত পাওয়া কিংবা পুনরুদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ অমোঘ সত্যটি জেনেও যারা ভুল করেন পরবর্তী জীবনে তাদের খেসারত দিতে হয়। সাধারণ মানুষের নিকট তিনি ও তাঁরা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। ইত্যবসরে লবিস্ট শব্দটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে আধুনিক বিশ্বের নানাবিধ কর্মকান্ডের কারণে। বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলবিদ ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান বিচারকাজ বন্ধে বিবৃতি দিয়েছেন বিশ্ব নেতারা, বিশ্ব নেতাদের মধ্যে নোবেলবিদ, জাতিসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব ও রাষ্ট্র প্রধানেরা আছেন। যারা বিবৃতি দিয়েছেন তাদের অনেককে এ দেশের মানুষ ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করতেন, অনুসরণ ও অনুকরণ করতেন। এখন যেহেতু তারা বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা নিয়ে পরোক্ষভাবে হলেও প্রশ্ন তুলেছে সেটি কিন্তু এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে আঘাত করার শামিল। তাদের এহেন কার্যক্রমে এ দেশের প্রায় সকলেই কষ্ট পেয়েছেন কিন্তু অনেকে সে বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না নানাবিধ কারণে। তবে বাংলাদেশের মানুষ আহত হয়েছে তাদের এমন বিবৃতিতে এবং বিবৃতিদাতাদের যে ব্যক্তিগত সুনাম ও ইমেজ ছিল সেটি কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের নিকট প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং ভবিষ্যতে সেটি পুনরুদ্ধার করা মুশকিল হয়ে পড়বে।

এদিকে পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কারান্তরীণ এবং সেখানে স্পষ্টতই মানবাধিকারের লঙ্ঘন হচ্ছে সে বিষয়ে কারোর কোন বিবৃতি নেই। যে সকল বিশ্বনেতারা ড. ইউনূসের স্বপক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন তারা কেন ইমরান খানের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করছেন না? এখানেই কিন্তু বিশ্বনেতাদের চরিত্র উঠে আসে। ড. ইউনূসের বিষয়টি বিচারাধীন, বিচারে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা যাচাই বাছাই সাপেক্ষে তাঁকে নিরপরাধ হিসেবে ঘোষণাও আসতে পারে। কাজেই বিচারের আগেই এ ধরনের বিবৃতি খুবই মারাত্মক পরিস্থিতির আশঙ্কাকে সামনে নিয়ে আসে। আপনি যদি প্রকৃতঅর্থেই কারও অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট থাকেন তাহলে যেখানে অনিয়মের সংবাদ তৈরি হবে সেখানেই প্রতিবাদলিপি জানাতে হবে। তা না হলে আপনার নিরপেক্ষতা নিয়ে জনতা প্রশ্ন তুলবে।

কারাবন্দী পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) বলেছে, তারা কারাগারে ইমরান খানের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, যেখানে তার জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। দলের নেতারা ইমরান খানের শারীরিক পরিস্থিতি নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত। জানা যায়, ইমরান খানকে বন্দী হিসেবে প্রাপ্য অধিকার দেওয়া হয়নি। পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা প্রায়শই বলে থাকেন যে দেশটির বিচার ব্যবস্থাকে তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। এহেন প্রেক্ষিতে কথিত বিবৃতিদাতারা বিবৃতি প্রদান তো দূরের কথা সাম্রাজ্যবাদে বিশ্বাসী রাষ্ট্রসমূহের প্রতিনিধিরা পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলের নেতাদের চেয়ে সামরিক বাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে থাকে। অর্থাৎ সামরিক বাহিনীর শাসনকে কার্যত জিইয়ে রেখে পাকিস্তানের সাধারণ জনতাকে নির্যাতন করার মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ করে দেয় সাম্রাজ্যবাদীরা।

অথচ বাংলাদেশের বিষয়ে বিবৃতিদাতাদের আগ্রহ খানিকটা বেশিই বলা যেতে পারে। এ ব্যাপারটিকে কয়েকটি আঙ্গিকে দেখা যেতে পারে।

প্রথমত: বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় অনেকেই হতাশ হয়ে বিরোধিতার নিমিত্তে বিবৃতি প্রদান করে।

দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশের পক্ষ হতে অবৈধ সুবিধা আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় বিবৃতিদাতারা বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণায় যুক্ত হয়।

তৃতীয়ত: বিবৃতিদাতাদের ফর্মুলা অনুযায়ী বাংলাদেশ পরিচালিত না হওয়ায় বিবৃতিদাতারা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বিরাগভাজন হয়ে বিবৃতি দিয়ে থাকে।

চতুর্থত: বাংলাদেশ বিরোধী অপশক্তির এজেন্ডা বাস্তবায়নের হেতু লবিষ্টরা সবসময়ই বাংলাদেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পায়তারা থেকেই মিথ্যা প্রচারণার সূত্রপাত ঘটায়।

পঞ্চমত: নির্বাচনকে সামনে রেখে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিরা একত্রিত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে যাতে পরবর্তী সরকার গঠনের ক্ষেত্রে বিদেশীদের প্রভাব বজায় থাকে।

শেষত: রাষ্ট্রীয়ভাবে যারা সন্ত্রাস প্রতিষ্ঠিত করতে চায় মূলত তারাই দেশে বিদেশে লবিষ্ট নিয়োগ করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রদানের ব্যবস্থা করছে।

কাজেই, বাংলাদেশের চলমান বিচার প্রক্রিয়ায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দ যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে সে ব্যাপারে বিশেষ সন্দেহের আবির্ভাব পাওয়া যায়। কেননা পাকিস্তানের সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারাগারে অথচ তাঁর সঙ্গে আইনজীবীদের সাক্ষাত করার অনুমতি প্রদান করছে না। কারাগারে একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যেভাবে ডিভিশন পাওয়ার কথা সেটি সরকার নিশ্চিত করছে না ব্যাপারটি স্পষ্টতই মানবাধিকারের লঙ্ঘন। ইমরান খানকে নিয়ে তেমন খবরও নেই পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমে, সংবাদ পরিবেশনে বিরত থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। এ বিষয়গুলো কি বিশ্ব নেতৃবৃন্দ দেখছে না, যেখানে প্রতিক্রিয়া দেখানোর কথা সেখানে প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে একটি দেশের বিচারব্যবস্থাকে নিয়ে কোন কারণ ব্যতিরেকে মন্তব্য প্রদান করার বিষয়টি কোনভাবেই শোভনীয় নয়। আমরা প্রত্যাশা রাখি বিশ্ব নেতৃবৃন্দ যে কোন ব্যাপারে কিংবা বিষয়ে মন্তব্য প্রদান করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট ঘটনার কার্যকারণ অনুধাবন করেই বিবৃতি প্রদান করবেন এবং তাদের অর্জিত স্বচ্ছ ইমেজকে ধরে রাখবেন।

সুতরাং বাংলাদেশ বিরোধী বিবৃতিদাতাদের বিবৃতির বিষয়ে এ দেশের জনগণকে সচেতন থাকতে হবে। জনগণ যাতে বিভ্রান্ত না হতে পারে সে বিষয়ে সরকারেরও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। মূলত বিবৃতিদাতারা যে সকল বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতি বিরাগভাজন হয়ে বিবৃতি প্রদান করছে, সকল বিষয় জনসাধারণের সামনে তুলে ধরতে হবে। বিবৃতিদাতারা যে সকল অবৈধ সুবিধার ব্যাপারে সরকারের শরণাপন্ন হয়েছিল সে বিষয়েও জনসাধারণকে জানাতে হবে। তাহলে বাংলাদেশের জনগণ প্রকৃত বিষয় সম্বন্ধে জানতে পারবে এবং বিবৃতিদাতাদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবগত হতে পারবে। আবার এটিও খেয়াল রাখতে হবে, নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে বিবৃতিদাতাদের পক্ষ হতে বিবৃতির পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে, ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা থেকে লবিস্টরা বিভিন্নভাবে বাংলাদেশকে নিয়ে মূল্যায়ন করছে।

এমনও অনেক সংস্থা আছে, সংস্থার চেয়ারম্যান রয়েছে যারা পৃথিবীর সব কিছুতেই নিরব ব্যতিক্রম কেবলমাত্র বাংলাদেশ। এ জায়গাগুলোতে লবিস্টদের দৌরাত্ম্য দৃশ্যমান হয়, না হলে লবিস্টরা তাদেরকে জাগ্রত করতে পারবে না। আমরা যতই পুঁজিবাদি সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলি কাজে কর্মে কিন্তু সবাই পুঁজিবাদি। অর্থের বিনিময়ে মানুষকে দিয়ে কাজ করানো যায় সে কাজটি জঘন্য ও নৃশংস হলেও। লবিস্ট হিসেবে যারা কাজ করেন তারা নিঃসন্দেহে মেধাবী ও চতুর। সকল কিছু জেনে বুঝেই একমাত্র অর্থের বিনিময়েই তারা মিথ্যার পক্ষে সাফাই গায়। আচ্ছা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিচারাধীন কোন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর ও উদ্দেশ্যমূলক এবং প্রকারান্তরে দেশটির স্বাধীনতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। এসব জেনে বুঝেই কিন্তু লবিস্টরা বাংলাদেশে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে বিবৃতি প্রদান করেছে।

আবার বাংলাদেশে নির্বাচন কিভাবে হবে, কোন প্রক্রিয়ায় হবে এসব নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের জনগণ, বাংলাদেশের সরকার। এ ব্যাপারে অন্যরা বিবৃতি প্রদানের কে? নির্বাচন যদি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হয় তদন্ত সাপেক্ষে সে বিষয়ে অন্যরা মতামত দিতে পারেন কিন্তু নির্বাচনের প্রসেস ও নির্বাচনকালিন সরকার নিয়ে অন্যদের মতামত প্রদানের এখতিয়ার নেই। তবে এ ধরনের বিষয় কিছুদিন ধরে প্রকাশ্যে আসায় মানুষও কিছুটা হলে দ্বিধাদ্বন্ধে থাকতে পারে তবে বাংলাদেশ সরকার স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে ভিন্ন দেশের কোন নেতার প্রেসক্রিপশনে এ দেশ পরিচালিত হতে পারে না, এ দেশ পরিচালিত হবে এ দেশের জনগণের কথায়। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায়ও এ ব্যাপারটি নিশ্চিত করে। কাজেই বিদেশীদের উচিত নিজের দেশের ব্যাপারে সচকিত হওয়া, শুধু শুধু বাংলাদেশ নিয়ে মূল্যায়ন কিংবা বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মতামত প্রদানের কোনরূপ প্রয়োজন নেই।

লেখক: চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts