স্মার্ট শিক্ষার্থী, স্মার্ট বাংলাদেশ

সুস্মিতা সাহা

২০৪১ সাল, স্মার্ট বাংলাদেশ। শিক্ষা, চিকিৎসা, সরকারি সেবাসমূহ, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানসমূহ সবকিছুতেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সরব উপস্থিতি। বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে মহাকাশে স্পেসশীপ পাঠানো বা চাঁদ জয় করা দেশগুলোর একটি। সফটওয়্যার বাণিজ্যে একচেটিয়া দখল বাংলাদেশের। সমুদ্রের তলদেশ থেকে মহাকাশ সবকিছুতেই বাংলাদেশের মানুষ বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে হয়ে উঠেছে অদ্বিতীয়।

২০৪১ সালের এই বাংলাদেশকে ছুঁতে হলে ২০২৩ সাল থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। এখন যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তারাই তখন হবে স্মার্ট বাংলাদেশের কান্ডারী। স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি স্তম্ভ: স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট গভর্ন্যান্স, স্মার্ট ইকোনোমি এবং স্মার্ট সোসাইটি। স্মার্ট সিটিজেন হতে হলে সবার আগে আমাদের বানাতে হবে স্মার্ট স্টুডেন্ট। আর সেটা শুরু করতে হবে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। কেননা মানুষ জীবনের শুরুতে যা শিখে তা তার হৃদয়ে শিকড়ের মত প্রোথিত হয়ে যায়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারেনা।’ আমাদের সংবিধানেও শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে মানসম্মত ও আধুনিকীকরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এখন আর বাচ্চাদের নতুন ক্লাসে নতুন বইয়ের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হয় না। বছরের প্রথম দিনেই তারা নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে খুশি মনে বাড়ি ফেরে। প্রতিটি শিশু এখন উপবৃত্তি পায় যা তার স্কুলের জামা, জুতো, খাতা-পেন্সিলের চাহিদা মেটায়। চালু করা হয়েছে প্রাক্ প্রাথমিক শ্রেণি ও তার সুসজ্জিত ক্লাসরুম। শতভাগ শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করা, ঝরে পড়ার হার শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা, প্রাইমারী এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (পিইডিপি-৪), জিপিএস, এনএনজিপিএস প্রজেক্টের মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর নতুন ভবন, ওয়াশব্লক, বাউন্ডারী ওয়াল নির্মাণ ও নিরাপদ খাবার পানির উৎস স্থাপনসহ বিভিন্ন ভৌত ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডিজিটাইলেশনের কার্যক্রম চালু হয়েছে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমসহ ডিজিটাল কন্টেন্ট এর মাধ্যমে ক্লাস নেওয়া ইত্যাদি পদ্ধতি বিদ্যমান আছে। করোনার সময় চালু ছিল অনলাইন ক্লাস। এর ফলে বাচ্চারা অনেক চিত্তাকর্ষক পদ্ধতিতে পাঠ গ্রহণ করতে পারছে।
ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলা একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল। এখানে বেশিরভাগ মানুষের পেশা কৃষি। ছেলেরা একটু বড় হলেই বাবার সাথে কৃষি কাজ করে। আর মেয়েরা বয়:সন্ধিতেই সানন্দে বসে যায় বিয়ের পিঁড়ীতে। স্কুলে ভর্তি হয় ঠিকই কিন্তু লেখাপড়ার আনন্দ তাদের কাছে কেন যানি অধরা। যাপিত জীবন যাপন করে দিনশেষে তাদের স্বস্তি’ এই বেশ ভালো আছি’। দু নয়নে ভয় আর মনে সংশয় কেবলই তাদের পিছু টেনে ধরে। তারা যেন প্রতনিয়ত বলে, আরে আরে বাদ দাওনা থাকগে, ওসব কি আর আছে মোদের ভাগ্যে! স্বপ্নহীন, উদাসীন ও লক্ষ্য বিহীন এ জনপদকে ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশের সাথে খাপ খাওয়াতে উপজেলা প্রশাসন হরিণাকুণ্ডুর নিবেদন ‘টেন মিনিট আইটি ও লাইব্রেরী ক্লাশ’।
হরিণাকুণ্ডু উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে , মানুষের সাথে কথা বলে আমার মনে হয়েছে এদের জীবনটা কূয়োর ব্যাঙের মত। এখানের অর্ধেকের বেশি মানুষ হয়তো কোনদিন আমাদের রাজধানী ঢাকা শহরেই যায়নি কিংবা যাবে না; বাকী সারা পৃথিবীর কথা তো বাদই দিলাম।

একবার মেয়েদের এক বাল্যবিবাহ রোধ শীর্ষক উঠান বৈঠকে একটি মেয়ে আমাকে প্রশ্ন করেছিল, আমরা ১৮ বছরের আগে বিয়ে করতে চাইনা। কিন্তু আমরা কি করব তাহলে? প্রশ্নটা শুনে আমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। একটা মানুষের জীবনে বিয়ে করা ছাড়া আর কোন কাজ নেই। তখন আমি বুঝলাম তাদের কাছে বিপুলা এইপপৃথিবী অধরাই রয়ে গেছে কারণ তারা বই পড়ে না। বই এর মাধ্যমে যে জীবনের স্বাদ পাওয়া যায়, এই হরিণাকুন্ডু বসেই এক মুহূর্তে আফ্রিকা, আমেরিকা, এন্টার্কটিকা, নায়াগ্রা, আমাজন চলে যাওয়া যায় তা তারা জানে না। তারা জানে না বই পড়ে তারা হতে পারে একই সাথে গোয়েন্দা, পুলিশ অফিসার, রাষ্ট্রনায়ক কিংবা আবিষ্কারক।

এ জীবন মানিক্যের খোঁজ দিতে তাদেরকে বই পড়ানোর কথা ভাবলাম সাথে লাইব্রেরী। সত্যি কথা বলতে মানুষ ছোট বেলা থেকে যে অভ্যাসে বড় হয় বা ছোট বেলায় মানুষকে যা সহজে শেখানো যায় বড় বেলায় তা শেখানো অনেক কঠিন। যদি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই তাদের বই পড়ার অভ্যাস গঠন করা যায় তাহলে একদিকে যেমন তাদের জ্ঞানের উৎকর্ষতা সাধিত হবে, অপরদিকে সমাজের কুসংস্কারের প্রভাব তাদের উপর পড়বে না। প্রাইমারীর গন্ডি পেরিয়ে হাই স্কুলে ঢুকলেই এখানকার ছেলেরা পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে দেয়। কেউ চায়ের দোকানে বসে; কেউ মাঠে কাজ করে কিংবা আর একু বড় হয়ে ক্যারাম খেলা আর নেশায় বুদ হয়ে থাকে।

সেই ভাবনা থেকেই স্কুলের পাঠ্য বইয়ের বাইরের বই পড়া বাধ্যতামূলক করা উচিৎ বলে মনে হলো। স্কুলে স্কুলে গিয়ে বললাম, দেখেন তো একটা লাইবেরী ক্লাস রাখা যায় কি না; লাইব্রেরী কক্ষ একটা তৈরি করা হলো অনেকগুলো স্কুলে। অকেজো ছোট খাট কক্ষকে খানিকটা মেরামত করে নিয়ে টেবিল, চেয়ার অথবা বেঞ্চ দিয়ে সাজানো হলো লাইব্রেরি কক্ষ। পুরোনো বই এর সংগ্রহের সাথে মিশানো হলো নতুন বই এর গন্ধ। চালু হলো লাইব্রেরি ক্লাস। ভাবলাম পুরো একটা বই না পড়তে পারলেও নাড়াচাড়া করবে, ছবি দেখবে; কৌতুহলী শিশু মনকে আকর্ষন করবে যার প্রভাব হয়তো আমরা আজকে না পেলেও আজ থেকে ১০ বছর পরে পাবো।

সব বড় লাইব্রেরিতেই বই এর সাথে কম্পিউটার থাকে। কম্পিউটার এখন আমাদের শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কম্পিউটার ছাড়া পড়াশুনার কথা আমরা চিন্তাই করতে পারি না আজকের যুগে। প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই কম্পিউটার আছে কিন্তু তা শিক্ষকদের ব্যবহারের জন্য। বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজসহ বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য সেই কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাচ্চাদের নিজেদের ব্যবহারের জন্য কোন কম্পিউটার নেই।

আমাদের মাধ্যমিক পর্যায়ে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব আছে যা শিক্ষার্থীদের আইসিটি শিক্ষায় খ্বুই সহায়ক। কিন্তু প্রাথমিকে এমন কোন ব্যবস্থা নেই। সেই থেকে মনে হলো একটা ছাত্র/ছাত্রী যদি প্রাথমিকেই কম্পিউটারের অ আ ক খ শিখে যায় তাহলে তার জন্য মাধ্যমিকে গিয়ে আইসিটি শেখাটা অনেক বেশি সহজ হবে এবং এ বিষয়ে ভীতিও দূর হবে। এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রাথমিক পর্যায়ে কারও বাসায়ই কম্পিউটার নেই। তারা হয়তো কম্পিউটারের নাম শুনেছে, দূর থেকে দেখেছে কিন্তু কেউ হয়তো ছুঁয়ে দেখেনি। বেশির ভাগেরই কম্পিউটার কেনার সামর্থ্যও নেই।
সেখান থেকে আসলে 10 minute IT এর ভাবনাটা শুরু। উপজেলা শিক্ষা অফিসার, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে আলোচনা করে পরিকল্পনা করলাম। এখন বিদ্যালয়ের কম্পিউটারেই শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে প্রাথমিকভাবে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার সম্পর্কে বেসিক ধারনা যেমন: কম্পিউটার অন অফ করা, একটি ফাইল খোলা, কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ সম্পর্কে ধারনা পাওয়া, ছবি আঁকা ইত্যাদি শিখবে। এরপর তাদের হাতে কম্পিউটার ছেড়ে দেয়া হবে। শিক্ষকরা টিফিন পিরিয়ডে, এক শিফট থেকে অন্য শিফট চালু হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে দশ মিনিট করে রোল অনুযায়ী গ্রুপ করে বাচ্চাদের শেখাতে লাগলেন।

এরপর পরীক্ষামূলকভাবে আমরা কয়েকটি বিদ্যালয়ে উপজেলা প্রশাসন থেকে, জেলা প্রশাসনে সহায়তায়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় লাইব্রেরি কক্ষে একটি করে কম্পিউটার স্থাপন করলাম। সাড়ম্বরে আমরা তা উদ্বোধন করলাম। কয়েকদিন পর খোঁজ নিয়ে জানলাম ১০ মিনিট আইটি ক্লাসে বাচ্চাদের ব্যাপক আগ্রহ। এই ক্লাসের জন্য বিদ্যালয়ে বাচ্চাদের নিয়মিত উপস্থিতির হার বেড়ে গেছে। আমরা সবাই এতে উৎসাহ পেলাম। ভাবলাম বাকী স্কুলগুলোতে কিভাবে কম্পিউটার দিব? প্রধান শিক্ষকদের নিয়ে মিটিং করে বললাম, আপনাদের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের ডাকেন, তাদের সাথে কথা বলেন। তাদের সবারই স্কুলের প্রতি ভালবাসা ও দায়িত্ববোধ দুইই আছে। তাদের কাছে একটি কম্পিউটার চান, দেখবেন নিরাশ হবেন না। সত্যি সত্যিই আমরা নিরাশ হইনি। বিদ্যালয়ে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা এগিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের সহযোগিতার জন্য। কিছুদিন আগে আমরা উদ্বোধন করেছি ভালকী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১০ মিনিট আইটি এবং লাইব্রেরি ক্লাস। গত ১২.০৯.২০২৩ তারিখে আমাদের হরিণাকুন্ডুতে এসেছিলেন খুলনা বিভাগের সম্মানীত বিভাগীয় কমিশনার জনাব হেলাল মাহমুদ শরীফ। ইনি হিজলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১০ মিনিট আইটি এবং লাইব্রেরি ক্লাস উদ্বোধন করেন। বাচ্চাদের তিনি কম্পিউটার অন করতে বলেন, ছবি আঁকতে বলেন, সেটা রঙ করতে বলেন এবং তারা সব পারে। গর্বে আমার বুক ভরে উঠেছিল, আনন্দে চোখে পানি চলে এসেছিল। আমি স্যারকে বলেছিলাম, স্মার্ট বাংলাদেশ মানে শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়; স্মার্ট বাংলাদেশ মানে আমার হরিণাকুণ্ডুর প্রত্যন্ত হিজলী গ্রামের ছেলেটাও ঢাকার যেকোন নামী স্কুলের ছেলেদের চেয়ে কম জানবে না।

১০ মিনিট আইটি এবং লাইব্রেরি ক্লাস হরিণাকুণ্ডুর প্রতিটি বিদ্যালয়েই পর্যায়ক্রমে আমরা চালু করবো বলে আমাদের ইচ্ছা আছে। হরিণাকৃন্ডুর প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা যেন কোন অংশেই পিছিয়ে না থাকে সেজন্য আমাদের নিরলশ ভাবনা এবং প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশে যেন হরিণাকুণ্ডুর মানুষদের প্রত্যক্ষ ও সরব অংশগ্রহণ থাকে তার জন্য যে বীজ আমরা রোপন করেছি তা এক সময় যতেœ, প্রচেষ্টায় মহীরুহ হয়ে আমাদের ছায়া দিবে এ আশা অন্তরে ধারণ করছি। তখন হয়তো আমি এখানে থাকবো না; কিন্তু যেখানেই থাকি হরিণাকৃন্ডুর সাফল্য অবশ্যই আমাকে ভালো লাগার জোয়ারে ভাসাবে।

লেখক: উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, হরিণাকুণ্ডু, ঝিনাইদহ।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts