পরিবেশ নিয়েই আমাদের জীবন ॥ শাহ মতিন টিপু

পরিবেশ নিয়েই আমাদের জীবন। আমরা যে পরিবেশেই থাকি না কেন সেই পরিবেশ দ্বারাই আমরা প্রভাবিত ও গঠিত। প্রাকৃতিক পরিবেশের নিয়ম নিয়ন্ত্রিত গতি দ্বারা জীবন প্রবাহমান। প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান বা বৈশিষ্ট্য আমাদের জীবন গঠনে অপরিহার্য এবং তা অমূল্য সম্পদ। প্রাকৃতিক সম্পদের অপূর্ব সমাহার আর তার ব্যবহার দ্বারা জীবনকে আমরা করে তুলি আনন্দময়। প্রকৃতির সক্রিয়তা ও সজীবতা জীবনে এনে দেয় অফুরন্ত অভিজ্ঞতা। আমরা প্রকৃতির কাছ থেকেই শিখি, আর প্রকৃতির পরিবেশেই গড়ে উঠি।

বৈচিত্রময় প্রাকৃতিক সৌন্দযের্র উপাদান দ্বারা আবৃত বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক পরিবেশই আমাদের দেশকে করে তুলেছে আরও মোহনীয়, লাবণ্যময়। এই দেশ প্রকৃতির দেশ, প্রকৃতির দান। তাই প্রকৃতির সাথেই মানুষের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রকৃতির প্রশান্তিতে মানুষ ঘুমাতে যায়, আবার প্রকৃতির ডাকে মানুষের ঘুম ভাঙ্গে, প্রভাতে জেগে ওঠে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের আনন্দ দান করে, উপকার করে, আমরা সদ্ব্যবহার করে লাভবান হই। কিন্তু সেই প্রাকৃতিক সম্পদের উপকারের প্রতিদানে অপকার করি, হয়ে উঠি অকৃতজ্ঞ, দুর্বিনীত, অত্যাচারী, নির্দয়! হয়ে যাই নিকৃষ্ট মানুষ। প্রাকৃতিক পরিবেশের অন্যতম সৌন্দর্য তার বনরাজি ও বৃক্ষরাশি। সবুজ গাছ আর তরুলতা আমাদের জীবন বাঁচিয়ে রেখেছে অক্সিজেন নরবরাহ করে। বৃক্ষ যেখানে আমার পরম আত্মীয়, পরম বন্ধু, সেখানে আমরা হয়ে যাই গাছের প্রতি ভালবাসাহীন। আমরা তা সমূলে উৎপাটিত করে বা কর্তন করে, তাকে চিরতরে বিলীন করে, তার ভালবাসাকে মূল্যহীন করে দিচ্ছি। নিজেই ডেকে আনছি নিজের বিনাশ।

আমাদের জীবনের স্বার্থে, বাঁচার স্বার্থে পরিবেশকে টিকিয়ে রাখতে হবে। পরিবেশ ধ্বংস হলে ধ্বংস হয়ে যাব আমরাও। পরিবেশকে টিকিয়ে মানুষের বাস উপযোগী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতি বছরই পালিত হয় বিশ্ব পরিবেশ দিবস। যা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধকে জাগ্রত করে দেয়। প্রতিবছর আমার করনীয় সম্পর্কে বোধে নাড়া দিয়ে যায়। আমাদের চেতনাবোধকে শাণিত করতে প্রতিবছরই বিশ্ব পরিবেশ দিবসে একেকটি প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়। যেমন- ২০১২ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে আপনিও গর্বিত অংশীদার হোন’। ২০১৩ সালের প্রতিপাদ্য ছিল ‘ভেবেচিন্তে খাই, অপচয় কমাই’। ২০১৪ সালের প্রতিপাদ্য ছিল ‘হতে হবে সোচ্চার, সাগরের উচ্চতা বাড়াব না আর’। ২০১৫ সালের প্রতিপাদ্য ছিল – ‘৭০০ কোটি স্বপ্ন। একটাই পৃথিবী। ভোগ কর যতেœর সাথে।’ এবারের প্রতিপাদ্য ‘ বণ্যপ্রাণী ও পরিবেশ, বাঁচায় প্রকৃতি বাঁচায় দেশ।’

পরিবেশবাদীদের মতে, বাংলাদেশের প্রকৃতির অন্যতম উপাদান বন ও বন্যপ্রাণী। বিভিন্ন অঞ্চলের বন ও বন্যপ্রাণী মিলে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের প্রতিবেশব্যবস্থা। গড়ে উঠেছে প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ। বন ও বন্যপ্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরিবেশ – প্রতিবেশব্যবস্থার ওপর নেমে আসে বিপর্যয়।

প্রকৃতিতে এদের ভূমিকা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবে প্রতিনিয়ত বন ও বন্যপ্রাণী ধ্বংস হচ্ছে। বন ধ্বংস, অবৈধ বন্যপ্রাণী শিকার, দারিদ্র, অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পকারখানার দূষণ-এ বাংলাদেশের পরিবেশ আজ বিপর্যস্ত। বনভূমি উজাড়ের পাশাপাশি হারিয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণী। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।
১৯৭২ সালে জাতিসংঘের মানবিক পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) উদ্যোগে প্রতিবছর সারা বিশ্বের ১০০ টিরও বেশি দেশে ৫ জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
প্রকৃতি ও পরিবেশ আমাদের পরমবন্ধু। একে রক্ষা করতে হবে আমাদেরকেই।এখানে সামান্য অনিয়মে খুব সহজেই জনজীবনে নেমে আসে অসহনীয় দুর্ভোগ। বিষাক্ত ধোঁয়া প্রতি মুহুর্তে মানুষের জন্য সাক্ষাৎ মরণ ফাঁদ। নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওড়, খানা-খন্দ, জলাভূমি ভরাট করে, অপরিকল্পিত ভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে, অপরিমিত সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে, ডিমওয়ালা মাছ ও ‘গুড়ো’ মাছ ধরে, আমরা যে আমাদের জীবিকাই ধ্বংস করে চলেছি।
ধর্মআল্লাহ তাআলা সৃষ্টির সেরা জীব রূপে মানুষ সৃষ্টি করে ভূপৃষ্ঠের প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ হিসেবে ফলবান বৃক্ষরাজি ও সবুজ-শ্যামল বনভূমির দ্বারা একে সুশোভিত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছেন। বনাঞ্চল ও বনজাত গাছপালার দ্বারা ভূমণ্ডলের পরিবেশ ও মনোরম প্রকৃতির ভারসাম্য সংরক্ষণ করা হয়েছে।

প্রকৃতি ও পরিবেশরক্ষায় বনায়নের বিকল্প নেই। আধুনিক সুরম্য অট্টালিকা আর ইট-কাঠের নগরজীবন সত্ত্বেও বনাঞ্চল ছাড়া মানুষের বাঁচার উপায় নেই। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য জীববৈচিত্র্য থাকা অপরিহার্য। পৃথিবীতে লাখ লাখ প্রাণী ও উদ্ভিদের বসবাস হলেও গাছ কাটার কারণে গহিন অরণ্যের জীববৈচিত্র্য লোপ পাচ্ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘিœত করার জন্য মানুষই যে একমাত্র দায়ী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা, দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশ উন্নয়নে সামাজিক বনায়ন ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। প্রাণের অস্তিত্বের জন্যই সবুজ বৃক্ষরাজি ও বনায়নের প্রয়োজন অপরিসীম।

অন্যদিকে বন ও বন্যপ্রাণী পরিবেশ ও প্রতিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং মানুষের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য। বন্যপ্রাণী বিশেষ করে হরিণ, বাঘ, সিংহ, হাতিসহ অন্যান্য প্রাণীর চামড়া, দাঁত, শিং ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চাহিদা থাকায় বিশ্বব্যাপী এর বাণিজ্যে প্রসার ঘটেছে। অবৈধ পাচার ও বেআইনি শিকারের ক্রমবর্ধমান তৎপরতার ফলে দ্রুত হারে হ্রাস পাচ্ছে এসব মূল্যবান প্রাণীর সংখ্যা। বিপন্ন হচ্ছে এদের অস্তিত্ব। সারাবিশ্বে বর্ধিত জনসংখ্যার চাপ, দ্রুত নগরায়ন, পরিবেশ দূষণ, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস, নির্বিচারে বন্যপ্রাণী পাচার ও নিধনের ফলে অনেক প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে।

আমাদের দেশের সম্পদকে আমরা যথাযথ সংরক্ষণ ও সদ্ব্যবহার করি না বলেই আমাদের চরম দারিদ্র্যের শিকার হতে হচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশের আমরা যত যতœ নেব, সংরক্ষণ করব, সদ্ব্যবহার করব ততই উন্নয়নের ও অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাব। আমরা যেন প্রাকৃতিক সম্পদকে সদ্ব্যবহার করি, মানব কল্যাণে ব্রতী হই, প্রাকৃতিক সম্পদকে যেন দেশ ও জাতির বন্ধুরূপে কাছে টেনে নেই, পরম যতেœ লালন করি।
নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন খাল বিল নদী নালা ভরাটসহ প্রকৃতি পরিবেশ ও প্রতিবেশ বিরোধী নানা কর্মকাণ্ডের কারণে গোটা দেশই বিপর্যস্ত। বন ও বন্যপ্রাণী সবই দুর্দশাগ্রস্ত। এতে ভয়াবহ সব ধরনের প্রাকৃতির বিপর্যয় হওয়াটাই স্বাভাবিক। এখন তেমন কোন বিপর্যয় যেন না হয় সে জন্যে রাষ্ট্র সরকার ও দেশবাসীকে সচেতন হতে হবে। নইলে কোন ভাবেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না।

শাহ মতিন টিপু : সাংবাদিক, কলাম লেখক

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts