টাইমড আউটে ঐতিহাসিক হয়ে থাকলো বিশ্বকাপের লংকাবাংলা ম্যাচ

নানা কারণে ঐতিহাসিক হয়ে থাকলো বিশ্বকাপের লংকাবাংলা ম্যাচ। বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেলেও দুই দলের জন্যই ম্যাচটি ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলার টিকিট পেতে হলে পয়েন্ট টেবিলে সেরা আটের মধ্যে থাকা চাই।

এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে ৩ উইকেটে হারিয়েছে বাংলাদেশ। এই জয়ে ২০২৫ সালে অনুষ্টিতব্য আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আশা বাঁচিয়ে রাখল সাকিব আল হাসানের দল।

বিশ্বকাপের ৩৮তম ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে চারিথ আসালাঙ্কার সেঞ্চুরিতে ভর করে ৪৯.৩ ওভারে অলআউট হওয়ার আগে ২৭৯ রান করে শ্রীলঙ্কা। জবাবে নাজমুল শান্ত-সাকিব আল হাসানের লড়াকু জুটির পর খেই হারালেও শেষ পর্যন্ত ৪১.১ ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে জয়ের বন্ধরে পৌঁছে যায় টাইগাররা। এই জয়ে পয়েন্ট টেবিলের সাতে উঠে এল টাইগাররা।

সোমবার (৬ নভেম্বর) দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কার দেয়া ২৮০ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে আরও একবার উদ্বোধনী জুটিতে বড় রান পায়নি বাংলাদেশ। তানজিদ হাসান তামিম এদিন ফেরেন তৃতীয় ওভারের প্রথম বলেই। ৫ বলে ২ চারে ৯ রান করে আউট হন তিনি। আরেক ওপেনার লিটন দাসও নিজের রানটা বড় করতে পারেননি।

তামিম-লিটনের বিদায়ের পর দুর্দান্ত এক জুটি গড়ে তোলেন সাকিব আল হাসান ও নাজমুল হোসেন শান্ত। তৃতীয় উইকেটে ১৪৯ বলে ১৬৯ রানের জুটি গড়েন তারা। তবে দুর্দান্ত ব্যাটিং করা সাকিব ৬৫ বলে ২ ছক্কা ও ১২ চারের ইনিংসে ৮২ রান করে আউট হয়ে যান।

টাইগার এই অলরাউন্ডারকে আউট করার পর হাতে ঘড়ি দেখানো উদযাপন করেন ম্যাথুস, প্রথম ইনিংসে হওয়া ‘টাইমড আউট’ নিয়ে খোঁচা দেন তিনি। সাকিবের মতো শতক হাঁকানোর সুযোগ থাকলেও সেই ম্যাথুসের বল নার্ভাস নাইন্টিজে আউট হন শান্ত।

এরপর দলের হাল ধরার চেষ্টা করেন রিয়াদ ও মুশফিক। তারা দুজনে মিলে দলকে সহজ জয়ের পথেই রেখেছিলেন। তবে দ্রুতই ৩ উইকেট হারিয়ে পরাজয়ের শঙ্কা তৈরি করে দিয়েছিল বাংলাদেশ দল। ৭ বলে ১৫ রান করে দলের জয় নিশ্চিত করে মাঠ ছাড়েন তাওহীদ হৃদয়।

এর আগে টস জিতে প্রথমে বোলিংয়ে নেমে ইনিংসের শুরুতেই উইকেটের দেখা পেয়ে যায় বাংলাদেশ। শরিফুল ইসলামের করা প্রথম ওভারের শেষ বলে লঙ্কান ওপেনার কুশল পেরেরার ব্যাটের কানায় লাগলে উইকেটকিপার মুশফিকুর রহিম বাম সাইডে লাফিয়ে দুর্দান্ত ক্যাচ লুফে নেন। এতে মাত্র ৫ রান করে সাজঘরে ফেরেন এই ব্যাটার।

এরপর পাথুম নিসাঙ্কা ও অধিনায়ক কুশল মেন্ডিসের ব্যাটে ঘুরে দাঁড়ায় লঙ্কানরা। দ্বিতীয় উইকেটে তারা দুজনে মিলে ৬১ রানের জুটি গড়ে বড় সংগ্রহের ইঙ্গিতও দেন। তবে পরপর দুই ওভারে এই দুই সেট ব্যাটারকে ফিরিয়ে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে টাইগাররা। উড়তে থাকা মেন্ডিসকে শরিফুলের ক্যাচ বানিয়ে ১৯ রানেই ফেরান সাকিব। পরের ওভারেই ৩৬ বলে ৪১ রান করা নিশাঙ্কাকে বোল্ড করেন জুনিয়র সাকিব।

এরপর সামারাবিক্রমা ও চারিথ আসালাঙ্কার ঝোড়ো ব্যাটিংয়ে শুরুর সেই ধাক্কা সামাল দেয় শ্রীলঙ্কা। সামারাবিক্রমাকে ফিরিয়ে লঙ্কান ঝড় থামান সাকিব। তার দ্বিতীয় শিকারে দলীয় ১৩৫ রানের মাথায় চতুর্থ উইকেট হারায় তারা। সামারাবিক্রমা থামেন ব্যক্তিগত ৪১ রানে। তার আউট হওয়ার পর অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস টাইমড আউটের কবলে পড়েন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এই প্রথমবার এমন আউটের ঘটনা ঘটে।

একপ্রান্ত আগলে রেখে সেঞ্চুরির দেখা পান আসালাঙ্কা। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি তুলে ১০৫ বলে ১০৮ রান করে তানজিম হাসান সাকিবের বলে লিটনের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন তিনি। তাকে সঙ্গ দেওয়া ধনঞ্জয় ডি সিলভা ৩৪ ও মাহেশ থিকশানা ২২ রান করলে ২৭৯ রানে শেষ হয় শ্রীলঙ্কার ইনিংস।

বোলিংয়ে বাংলাদেশের হয়ে ১০ ওভারে ৮০ রান দিয়ে সর্বোচ্চ ৩ উইকেট শিকার করেন তরুণ পেসার তানজিম হাসান সাকিব। সাকিব আল হাসান ও শরিফুল ইসলাম প্রত্যেকে পান ২টি করে উইকেট। এছাড়া অফস্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজ নেন ১টি উইকেট।

ম্যাথুসের আউট

অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের বিপক্ষে ইনিংসের ২৫তম ওভারে আউট হয়ে ক্রিকেটের ইতিহাসের রেকর্ডবুকে জায়গা করে নিয়েছেন ম্যাথুস। কোনো বল খেলার আগেই টাইমড আউট হয়ে গেছেন তিনি। প্রায় দেড়শ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘টাইমড আউট’ হয়েছেন শ্রীলঙ্কার অলরাউন্ডার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস।

ব্যাটিংয়ে যে হেলমেট নিয়ে নেমেছিলেন, তাতে পুরো নিরাপদ বোধ করেননি ম্যাথুস। ফলে আরেকটি হেলমেট আনা হয়, কিন্তু সেটিও উপযুক্ত মনে করেননি এই ব্যাটার। এসবের মাঝে সময় গড়াতে থাকে, ফলে টাইগার অধিনায়ক সাকিব আবেদন করলে আম্পায়াররা আউট ঘোষণা দেন।

এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ম্যাচের চতুর্থ আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করা আদ্রিয়ান হোল্ডস্টক, ‘এমন টুর্নামেন্টে এমসিসির ক্রিকেট আইনের জায়গায় আইসিসির বিশ্বকাপ প্লেয়িং কন্ডিশন প্রাধান্য পাবে। টাইমড আউটের ক্ষেত্রে, নতুন ব্যাটসম্যানকে দুই মিনিটের মধ্যে বল খেলার জন্য তৈরি থাকতে হবে।’

আদ্রিয়ান হোল্ডস্টক আরও বলেন, ‘টিভি আম্পায়ার এই দুই মিনিট সময়ের খেয়াল রাখেন এবং তা মাঠের আম্পায়ারদের জানান। ম্যাথিউসের এই ঘটনায় হেলমেটের স্ট্র্যাপ নিয়ে সমস্যায় পড়ার আগেই দুই মিনিট পেরিয়ে গিয়েছিল এবং ব্যাটসম্যান বল খেলার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। দুই মিনিট সময় আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। প্লেয়িং কন্ডিশন অনুযায়ী, ফিল্ডিং দলের অধিনায়ক মাঠের আম্পায়ারের কাছে টাইমড আউটের আবেদন করেছিলেন।’

হোল্ডস্টক এরপর বলেছেন, ‘ব্যাটসম্যান হিসেবে আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে আপনার সব সরঞ্জাম ঠিকঠাক আছে। আপনাকে দুই মিনিটের মধ্যে বল খেলার মতো প্রস্তুত থাকতে হবে। ফলে কৌশলগতভাবে আসলে আপনাকে ১৫ সেকেন্ডের মধ্যেই মাঠে চলে যেতে হবে, যেন বল খেলার জন্য তৈরি হতে পারেন।’

এখন পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ছয়বার টাইমড আউটের ঘটনা ঘটেছে। চলুন জেনে নিই সে আউটগুলোর ঘটনা সম্পর্কে-

অ্যান্ড্রু জর্ডান : প্রথম ঘটনাটি ঘটে ১৯৮৭-৮৮ মৌসুমে। দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রথমবার টাইমড আউটের ঘটনা ঘটে। ইস্টার্ন প্রভিন্স ও ট্রান্সভালের মধ্যকার ম্যাচে অ্যান্ড্রু জর্ডান শূন্য রানে দিনের খেলা শেষ করেছিলেন। কিন্তু রাতে অতি ভারী বর্ষণে রাস্তার অবস্থা এতো খারাপ হয়ে পড়েছিল যে, পরদিন তিনি খেলা শুরুর পর সময়মতো উপস্থিত হতে পারেননি। তাকে টাইমড আউট ঘোষণা করেন আম্পায়ার।

হেমুলাল যাদব : দ্বিতীয় ঘটনাটি ১৯৯৭ সালে ভারতের। কটকের বারাবাটি স্টেডিয়ামে ত্রিপুরা ও উড়িষ্যার মধ্যকার ম্যাচে ঘটেছিল ঘটনাটি। উড়িষ্যার বিপক্ষে ব্যাটিংয়ে নেমে ত্রিপুরা নবম উইকেট হারানোর পর আম্পায়ার পানের বিরতি দেন। ত্রিপুরার ১১ নম্বর ব্যাটার হেমুলাল যাদব পানের বিরতি শেষ হয়ে গেলেও ক্রিজে উপস্থিত হননি। তিনি তখনও বাউন্ডারি লাইনের বাইরে দলের ম্যানেজারের সঙ্গে গভীর আলোচনায় মগ্ন ছিলেন। আম্পায়ার আউট দেন তাকে।

ভাসবার্ট ড্রেকস : তৃতীয় ঘটনাটিও দক্ষিণ আফ্রিকায় ঘটে। ২০০২ সালে বর্ডার বনাম ফ্রি স্টেটের ম্যাচে ভাসবার্ট ড্রেকস। ‘টাইমড আউট’ হন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ম্যাচ খেলে কলম্বো থেকে ফিরছিলেন। কলম্বো থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার ইস্ট লন্ডনের দূরত্ব ৪,৪০০ মাইল। ম্যাচটি শুরু হয়ে গেলেও তখনও বিমানেই ছিলেন ড্রেকস। বিমানের বিলম্ব দেখে এই ক্যারিবিয়ানের ব্যাটিং অর্ডার বেশ পিছিয়েও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপরও তিনি উপস্থিত হতে পারেননি। মাঝ আকাশে আউট হওয়া একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে নাম লেখান ড্রেকস।

এজে হ্যারিস: ২০০৩ সালে কাউন্টি দল নটিংহাম্পশায়ার বনাম ডারহামের ম্যাচে ‘টাইমড আউট’ হয়েছিলেন এজে হ্যারিস। ডারহামের বিপক্ষে নটিংহাম্পশায়ার দারুণ ব্যাটিং করছিল। তাদের ১১ নম্বর ব্যাটার অ্যান্ড্রু হ্যারিস গ্রোয়েন ইনজুরিতে ভুগছিল কিন্তু তার নামার প্রয়োজন পড়বে না মনে করে তৈরিও ছিলেন না। কিন্তু হঠাৎ করেই নটিংহাম্পশায়ারের মিডলঅর্ডারে ধস নামে এবং হ্যারিসের ব্যাটিংয়ে নামার ডাক আসে। তড়িঘড়ি করে তিনি কাপড় বদলে তৈরি হচ্ছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে অনবেক দেরি হয়ে গেছে। তার সঙ্গী ক্রিস রিড বিষয়টি নিয়ে খুশি হতে পারেননি। কারণ, তখন তিনি ৯৪ রানে ব্যাট করছিলেন।

রায়ান অস্টিন: সেন্ট ভিনসেন্টে কম্বাইন্ড ক্যাম্পাস ও কলেজ বনাম উইন্ডওয়ার্ড আইল্যান্ডের ম্যাচে ২০১৩-১৪ মৌসুমে এই ঘটনা ঘটে। ক্যারিয়ারের সেরা বোলিংয়ে ৮ উইকেট নেওয়ার পর পঞ্চম ব্যাটার হিসেবে কম্বাইন্ড ক্যাম্পাস ও কলেজের রায়ান অস্টিন পঞ্চম ব্যাটার হিসেবে ‘টাইমড আউট’-এর খাতায় নাম লেখান। বোলিং ওপেন করতে নেমে ৬৪ রানে ৮ উইকেট নিয়েছিলেন অস্টিন। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে যখন তার ব্যাটিংয়ে নামার ডাক আসে, তিনি মাঠে নামতে ব্যর্থ হন।

চার্লস কুঞ্জে: ২০১৭ সালে জিম্বাবুয়ের বুলাওয়ে’তে এই ঘটনা ঘটে। মাউন্টেনার্স বনাম তুস্কার্সের ম্যাচে চার্লস কুঞ্জে ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে টাইমড আউট হয়ে সাজঘরে ফেরেন।

 

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts