শাহ মতিন টিপু
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব/পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন/এর চোখে ধাঁধা করব,/ওর জল করে দেব কাদা/পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম।/অশান্তি চরমে তুলব, কাকচিল বসবে না বাড়িতে/তুমি ছুঁড়বে থালা বাটি, আমি ভাঙব কাঁচের বাসন/পাগলী, তোমার সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ জীবন কাটাব/পাগলী, তোমার সঙ্গে ৪২ কাটাব জীবন। (পাগলী, তোমার সঙ্গে)
চোখ, চলে গিয়েছিল, অন্যের প্রেমিকা, তার পায়ে।/যখন, অসাবধানে, সামান্যই উঠে গেছে শাড়ি—/বাইরে নেমেছে বৃষ্টি। লন্ঠন নামানো আছে টেবিলের নীচে, অন্ধকারে/মাঝে মাঝে ভেসে উঠেছে লুকোনো পায়ের ফর্সা আভা (একটি বৃষ্টির সন্ধ্যা)
যেভাবে বৃষ্টির জল তোড়ে বয়ে যায় ঢালুদিকে/সেইভাবে, আমার জীবন আজ অধোগামী।/সালোয়ার একটু উঁচু ক’রে
তুমি সেই জল ভেঙে ভেঙে রাস্তা পার হয়ে গেলে—/এত যত্নে, সাবধানে, যেন বা জলের গায়ে/আঘাত না লাগে!/
পড়ন্ত জীবন শুধু মনে রাখবে অপরূপ চলে যাওয়াটিকে।(এসেছিলে, তবু আসো নাই)
মিত্রা দিদি, তোমাকে নিয়ে কাব্য/লেখেনি কোন পুরুষ কোন দিন।/গলির মোড়ে বাজেনি সম্মিলিত/শীৎকার, বখাটে ছেলেদের।/তোমাকে দেখতে আসেনি পাত্রপক্ষ,/এসেছিল শুধু মেপে নিতে,/তোমার বুক, চুল, নিতম্ব/যাবতীয় সব শারিরিক।(ঝাউ গাছের পাতা)
এই হচ্ছে কবি জয় গোস্বামীর কবিতা। আজ এ কবির ৭০ তম জন্মদিন। ১৯৫৪ সালের ১০ নভেম্বর কলকাতা শহরে তার জন্ম। জীবনানন্দ পরবর্তী যুগে সেখানে তাকেই সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলা কবি ধরা হয়। তার কবিতা চমৎকার চিত্রকল্পে, উপমা এবং উৎপ্রেক্ষায় ঋদ্ধ।
তিনি দুবার আনন্দ পুরস্কার লাভ করেছেন। ‘বজ্রবিদ্যুৎ-ভর্তি খাতা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার অর্জন করেন।
তার কবিতার একটি বিখ্যাত পঙ্ক্তি ‘অতল তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে/হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে’।
জয় গোস্বামীর জন্ম কলকাতা শহরে হলেও ছোটবেলায় তার পরিবার রানাঘাটে চলে আসে। তখন থেকেই তার স্থায়ী নিবাস সেখানে। তার পিতা মধু গোস্বামী ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী রাজনীতি করতেন। তার যখন আট বছর পাঁচ মাস বয়স তখন পিতৃহারা হন। তার মা শিক্ষকতা করে তাকে লালন পালন করেন। প্রথম কবিতা লিখেছিলেন ১৩-১৪ বছর বয়সে। নিয়মিত কবিতা লিখতে শুরু করেন ১৬-১৭ বছর বয়সে। তিনি ছেলেবেলা থেকে খুব গান শুনতেন। গানের সুর থেকে বাণী তাকে খুব আকর্ষণ করতো। এই আকর্ষণেই তার অন্তর্জগতে কবিতার জন্ম হতে থাকে।ছেলেবেলায় এক অনুষ্ঠানে বনলতা সেন কবিতাটির আবৃত্তি শুনে কবিতার গঠন, রচনাশৈলী ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে তার প্রথাগত ধারণা আমূল বদলে যায়।
জয় গোস্বামীর প্রথাগত লেখা পড়ার পরিসমাপ্তি ঘটে একাদশ শ্রেণিতে থাকার সময়। সত্তরের দশকে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। সাময়িকী ও সাহিত্য পত্রিকায় তিনি কবিতা লিখতেন। এভাবে অনেক দিন কাটার পর দেশ পত্রিকায় তার কবিতা ছাপা হয়। এর পরপরই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কিছুদিন পরে তার প্রথম কাব্য সংকলন ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘ঘুমিয়েছ, ঝাউপাতা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। ২০০০ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে তিনি ‘পাগলী তোমার সঙ্গে’ কাব্য সংকলনের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
জয় গোস্বামীর ভাষায়, ‘আমার প্রতিদিনের জীবনে মনের ভেতর যে ভাষা জন্মায়, যে অভিজ্ঞতা জন্ম নেয়, তাকে ভাষা দেওয়ার চেষ্টা করি।’
তিনি বলেন, “আমার জীবন হচ্ছে ধারাবাহিক বিচ্ছেদের মালা গাঁথার ইতিহাস। আমার মাস্টার মশাই, আমার মা, আমার ভাই, আমার বন্ধু, নারী, সহকর্মী, যাঁরা আমার জীবনে এসেছেন, তারা কেউ আমাকে নিয়ে সুখী নন। তারা কোনো না কোনো কারণে হতাশ বা আমাকে নিয়ে ক্লান্ত।”
তার প্রথম কবিতার বই ‘ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে।এটি ছিল মাত্র আটটি কবিতার একটি ক্ষীণতনু কবিতা-সংকলন। মায়ের থেকে টাকা নিয়ে এই বইটির প্রকাশনা বাবদ মোট ১৪৫ টাকা ব্যয় হয়েছিলো তার। মায়ের টাকাতেই ১৯৭৮-এ তিনি প্রকাশ করেছিলেন ২য় কাব্য ‘প্রত্নজীব’। অতঃপর কবি শঙ্খ ঘোষ তাকে প্রকাশক জুটিয়ে দেন এবং ১৯৮১-তে তার তৃতীয় কাব্য ‘আলেয়া হ্রদ’ প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে তার অসংখ্যা কাব্য প্রকাশ হতে থাকে।
কবি তার একটি কবিতা সংগ্রহ বইয়ের ভূমিকায় লিখেন- “যদি সৌভাগ্যক্রমে এমন কোনও পাঠক পাই যিনি প্রথম খণ্ড থেকে ষষ্ঠ খণ্ড পর্যন্ত চুয়াল্লিশটি বই ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করে এলেন, তবে সে-পাঠক অবশ্যই বুঝতে পারবেন আমার কবিতাজীবন কতখানি অনিশ্চয়তায় ভরা! আমি স্থির নির্দিষ্ট পথ খুঁজে পাইনি কখনও, কেবলই পথ খুঁজেছি। এখনও খুঁজছি।”