আদিবাসীদের মাঝে শিক্ষা বিস্তারের অগ্রদূত ভেন. প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো ও লেখক দীপা বংশ ভিক্ষু (সুশীল চাকমা)
● দীপা বংশ ভিক্ষু (সুশীল চাকমা)
২০২৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। একটি দিন। একটি সময়ের সন্ধিক্ষণ। এ দিন ৭২ পেরিয়ে ৭৩-এ পা রাখলেন আদিবাসীদের মাঝে শিক্ষা বিস্তারের অগ্রদূত ভেন. প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো। ১ ফেব্রয়ারি আমার কাছে কেবলই একটি তারিখ নয় বরং একটি দীপ্তিদায়ক দিন কারণ এদিন এমন এক গুণী মানুষের জন্মদিন যাকে খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। একাধারে তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় পরমকল্যাণমিত্র, মানবতাবাদী, প্রজ্ঞাবান, মহানকর্মবীর, পরোপকারী।
আমার জানা মতে, এই মহান বৌদ্ধ সন্ন্যাসী নিরহংকারী, ত্যাগী ও দয়ালু। পরম পূজনীয় শ্রদ্ধেয় প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো বহু প্রতিষ্ঠানের রূপকার। তিনি একজন সমাজ সেবক এবং চাকমা জাতির বা আদিবাসীদের দিকপাল। সৌভাগ্যবশতঃ দীর্ঘদিন যাবত এমন গুণী মানুষের সান্নিধ্য পেয়ে নিজেকে খবই ধন্য মনে করি।
শ্রদ্ধেয় প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো চট্টগ্রামের ইতিহাসে আদিবাসীদের জন্য একজন মহাপুরুষ যিনি যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে শিক্ষার আলো বিলিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদে মাঝে। এক্ষেত্রে প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো আদিবাসী সমাজের জন্য শিক্ষা বিস্তারের অগ্রদূত, আলোকবর্তিকা এবং একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র যাকে বলা যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জন্য ইতিহাসের ভেতর আরও একটি ইতিহাস।
তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষিত করতে পারলে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে দক্ষ করতে পারলে এবং তরুণদের জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করতে পারলে একটি জাতি উন্নতির র্শীষে অবস্থান করে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের রক্ষা, কল্যাণ, উন্নতি এবং আদিবাসী জাতির ঐতিহ্যকে রক্ষার জন্য আজ তরুণ প্রজন্মকে শ্রদ্ধেয় প্রজ্ঞানন্দ ভান্তের দর্শন, চিন্তা-চেতনা, তাঁর নিঃস্বার্থ অবদান মনেপ্রাণে ধারণ করা অনস্বীকার্য। আমি মনে করি, এই মহান মানুষ আমাদের মাঝে না এলে আমরা আজও অনেক পিছিয়ে থাকতাম, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা। আমরা পেতাম না শ্রদ্ধেয় ভান্তের হাতে গড়া অনেক প্রতিষ্ঠান।
সুজলা-সুফলা, শস্য শ্যামলা শোভিত পৃথিবীর এক অপূর্ব সৌন্দর্য্য ভরা দেশ বাংলাদেশ। এ দেশে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত তিন পার্বত্য জেলা-রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। শ্রীমৎ প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরোর জন্ম ১৯৫২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, খাগড়াছড়ি জেলাধীন দীঘিনালা উপজেলার বাবুছড়ায়। আলোকিত মানুষ ভেন. প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরোর পারিবারিক নাম বলেন্দ্র দেব চাকমা। তাঁর পিতা প্রয়াত নরেন্দ্র লাল চাকমা ও মাতা প্রয়াত ইন্দ্রপতি চাকমা।
ভেন. ১৯৬৮ সালে দীঘিনালা উচ্চ বিদ্যালয় হতে মাধ্যমিক ও ১৯৭২ সালে হাটহাজারী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৭৮ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় হতে এমএ ডিগ্রি লাভ অর্জন করেন। ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পালি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। শ্রদ্ধেয় প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো ১৯৬৮ সালে মাধ্যমিক পাশ করার পর সদ্ধর্মাদিত্য ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাথের মহোদয়ের নিকট শ্রামণ্য ধর্মে দীক্ষিত হন এবং পরে উপসম্পদা গ্রহণ করেন। তাঁর দীক্ষাগুরুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজেকে মানবতার সেবায় আত্মনিবেদিত হয়ে পাবর্ত্য অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি বিশেষত অনাথ, অসহায়, হত-দরিদ্র, ছিন্নমূল ও দুঃস্থ শিশুদের কল্যাণ ও শিক্ষা বিস্তারের মহান ব্রত নিয়ে কাজ করেছেন।
ছাত্রাবস্থায় তাঁর দীক্ষা গুরুর নির্দেশক্রমে তিনি অধুনালুপ্ত পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে মোনঘর প্রতিষ্ঠা করা হলে তিনি এর সাধারণ সম্পদক হন। মোনঘর পরিচালনা পর্ষদে প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে দীর্ঘদিন ধরে মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি দায়িত্ব পালন করেন। শ্রদ্ধেয় ভান্তে ২০০৪ সালে রাজধানী মিরপুরে বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
২০২৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, এ মহান ব্যক্তির ৭৩তম শুভ জন্মদিন। এদিন ভান্তে ৭২ পেরিয়ে ৭৩ বছর বয়সে পর্দাপণ করলেন। যদিও পরম পূজনীয় শ্রদ্ধেয় ভান্তে এইসব বিষয়ে এতো আন্তরিক নন তারপরও সবার অনুরোধে খুবই সাদামাটাভাবে শ্রদ্ধেয় ভান্তের ৭৭তম শুভ জন্মদিন পালন করা হলো। ক্ষুদ্র পরিসরে ভক্ত বা শিষ্যরা মিলে অমরা ক’জন অনুষ্ঠানে শামিল হলাম।
নিজের হাজারো ত্যাগ তিতিক্ষাকে স্বীকার করে আমাদের ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত হয়ে ’প্রকৃত পক্ষে মানব’ হওয়ার শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন ভেন. প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো। আজ এই মহান সময়ে আপনার আজীবনকার মেধা, কর্মশক্তি আমাদের সবার কল্যাণের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন তাই আমরা আপনার কাছে চিরঋণী। পাশাপাশি আপনার সুদীর্ঘ মানবজীবন চর্চিত সকল কুশল ও পূণ্যময় কর্মপ্রবাহ জন্ম জন্মান্তর আমাদের চলার পথে পাথেয় হোক; আমরা যেন আপনার মানবতার শক্তিকে ফুলে ফসলে সুশোভিত করতে পারি এই আর্শীবচন একান্তভাবে কামনা করছি। পরিশেষে আপনি আমৃত্যু নিরোগ সুস্থ জীবন লাভ করে ধন্য হোন তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধের অনন্ত কর্মশক্তির কাছে কায় মন বাক্যে প্রার্থনা করছি।
লেখক পরিচিতি:
দীপা বংশ ভিক্ষু (সুশীল চাকমা)
প্রভাষক-বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ এবং সচিব-একাডেমিক কাউন্সিল।