আফরোজা পারভীন
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণ করলাম । এ আমার জীবনের এক পরম পাওয়া ! রাষ্ট্রীয় বেগম রোকেয়া পদক, অনন্যা সাহিত্য পুরস্কারসহ দেশ বিদেশের ৩০ টির বেশি পুরস্কার পেয়েছি। সব পুরস্কারই আমার কাছে সমান, বড় ছোট নেই। তবু যেন কোথায় অতৃপ্তি ছিল। অনেকে বলেন, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লেখক স্বীকৃতি। আসলেই কি তাই? কত বড় বড় লেখক পুরস্কার পাননি! তারা পাঠকের মন জুড়ে আছেন। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টজনদের জন্য অস্কার আরাধ্য। বাংলা একাডেমি পুরস্কার নাকি বাংলাদেশের লেখকদের জন্য অস্কার সমতু্ল্য। তা সেই পুরস্কার পাচ্ছিলাম না। প্রতিবছর শুনতাম পুরস্কার পাচ্ছি, একবার শুনেছিলাম নাম চূড়ান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু পেলাম না! মন কেমন করত, কষ্ট হতো! যাক অবশেষে পেলাম, এটাই আনন্দের !
পুরস্কারের জন্য লিখি না, পুরস্কার না পেলেও লিখব । দশকের পর দশক পুরস্কার না পেয়েই লিখেছি । পাঠকের প্রতিক্রিয়াই ছিল আমার কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার। সে পুরস্কার পেতাম বিস্তর। এখনও পাই। পুরস্কার পেতাম না বলে বন্ধু-বান্ধবের কটুক্তিও শুনেছি। বেশি লিখি বলে ঠাট্টা তামাশায়ও হজম করতে হয়েছে। যেন বেশি লেখা, বেশি লিখতে পারা অপরাধ।
পুরস্কার ঘোষণার পর থেকে বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙক্ষীরা মোবাইল ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে অফুরান শুভেচ্ছা, ভালবাসা, অভিনন্দন জানিয়েছেন। আমি তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। গভীর ভালবাসা জানাই। আমি কৃতজ্ঞ বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী, সন্তান ( ৪ জন) ভাগনে ভাগনি, শ্বশুরকূলের আপনজন, আত্মীয়স্বজন আর কয়েকজন বন্ধুর প্রতি। এরা সবাই আমাকে লেখা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। বলেছেন, ‘লেখ, তুমি পারবে।’ কৃতজ্ঞ সম্পাদকদের প্রতি যারা যত্ন করে আমার লেখা ছেপেছেন। যারা ছাপেননি , আমাকে একঘরে করে রেখেছেন তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞ। আপনাদের অবমূল্যায়ন আমাকে জেদি করেছি, ক্রোধী করেছে, প্রতিজ্ঞায় কঠোর করেছে। আপনাদের অবহেলায় আমার আত্মজীবনীতে যুক্ত হয়েছে অনেক উপাদান। কৃতজ্ঞ প্রকাশকদের প্রতি, যারা যত্ন করে আমার বই ছেপেছেন।
অনেক বন্ধু -বান্ধব যেমন আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, তেমনই যাদের খুব কাছের জানি, যাদের কাছে আশা করেছিলাম বেশি, এমন কেউ কেউ জানাননি। এমনকি দু’ একজন ফোন করার পর ফোনও ধরেননি। পুরস্কার কী বন্ধুদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ায়? ঈর্ষার সূক্ষ্ম জাল বিস্তার করে! সেটা হলে বড় কষ্টের! এদের প্রতিও কৃতজ্ঞ। এ ঘটনা আমাকে নতুন গল্প লিখতে সাহায্য করেছে। আসলে জীবনে কোনটাই তুচ্ছ না, না ভালবাসা, না হিংসা , না নিন্দা ।
অনেকে বলেছেন, কথাসাহিত্যে পুরস্কার না পেয়ে আমি কেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় পেলাম। আমি কথাসাহিত্য দিয়ে শুরু করেছিলাম ঠিকই, পর্যায়ক্রমে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছি সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রে। আমার প্রকাশিত ১২৫ টি বইয়ের মধ্যে ৩২ টি মুক্তিযুদ্ধের। আমি পরিশ্রমী। শ্রমিকের মতো কাজ করি। লেখা আমার সাধনা, বেঁচে থাকার পথ। তৃণমূল গবেষণায় আমি আনন্দ পাই। তাছাড়া একজন শহিদ পরিবারের সদস্য হিসেবে পুরস্কারের সাথে “মুক্তিযুদ্ধ” শব্দটি যুক্ত থাকা আমার জন্য গৌরবের। এই ক্ষেত্রে পুরস্কার পেয়ে আমার লাভ বৈ লোকসান কিছু হয়নি। পাঠকরা জানেন, আমি কথাসাহিত্য নিয়ে কাজ করি। এবার তারা আরও ভালো করে জানলেন, আমি একজন নিবিষ্ট গবেষকও। কথাসাহিত্যের মতো গবেষণার বিষয়টি সবার গোচরে থাকে না। তাই এ পুরস্কার পেয়ে আমি খুশি।
সবশেষে কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জুরি বোর্ডকে যারা আমাকে যোগ্য মনে করেছেন। আমার লেখক জীবনের এই লম্বা জার্নিতে যারা পাশে ছিলেন, আছেন, থাকতে পারেননি আবারো সবার প্রতি শ্রদ্ধা , ভালবাসা, সম্মান। দোয়া করবেন যেন আমৃত্যু লিখে যেতে পরি। লিখতে লিখতেই চলে যেতে পারি। শুভরাত্রি।