টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই সনদ কার থাকবে- ভারতের না কি বাংলাদেশের?

ভারত সরকার টাঙ্গাইল শাড়িকে জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে সনদ দেওয়ার পর থেকে দুই বাংলায় এ নিয়ে আলোচনা যখন তুঙ্গে, তখন আলোচনার পালে নতুন হাওয়া লাগালো বাংলাদেশ সরকার।

আটই ফেব্রুয়ারি দুপুরে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্টস, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি জার্নাল প্রকাশ করে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দু’টো দেশ থেকে একই পণ্য জিআই সনদ পেতে পারে কি-না।

কিংবা, ভারত যদি এখন ডিপিডিটি থেকে প্রকাশিত এই জার্নালের বিরোধিতা করে, তাহলে কী হবে? অথবা, টাঙ্গাইল শাড়ি’র জিআই ফিরে পেতে বাংলাদেশের করণীয় কী হবে?

জিআই জার্নাল নং ৩২

এইসব প্রশ্নের উত্তর জানার আগে একটু জেনে নেয়া প্রয়োজন, সেই জার্নালে আসলে কী কী আছে।

কোনও পণ্যের জিআই সনদ পেতে হলে কোনও একটা সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানকে ডিপিডিটি বরাবর আবেদন করতে হয়। তাই, টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বীকৃতি পেতে গত ছয়ই ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম ডিপিডিটি’র কাছে আবেদন করেছিলেন।

তার আবেদনে সাড়া দিয়েই ডিপিডিটি টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে। এই শাড়ির ইতিহাস, ঐতিহ্য, বুনন পদ্ধতি ও নিজস্বতা তুলে ধরে প্রকাশ করে জার্নাল নং ৩২।

জেলা প্রশাসকের করা আবেদনপত্রে বলা হয়েছে যে টাঙ্গাইল শাড়ি মূলত চার প্রকার এবং এখানে এই শাড়ির বৈশিষ্ট্যকে মোট ছয়টি ভাগে ভাগ ধরা হয়েছে। সেগুলো হলো-

  • টাঙ্গাইল শাড়ি সম্পূর্ণ হাতে বোনা হয়। তবে বর্তমানে মেশিন তাঁতেও বুনন করা হয়ে থাকে।
  • টাঙ্গাইল জেলা যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীর পাশে অবস্থিত হওয়ায় এখানকার জলবায়ু শাড়ি বোনার উপযোগী।
  • নদীর পানির বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য সুতার প্রক্রিয়াজাতকরণ (যেমন- সুতা রঙ করা, মাড় দেওয়া) ভালো হয় এবং রঙের স্থায়িত্বের পাশাপাশি কাপড়ের স্থায়িত্ব ও গুণগতমান বৃদ্ধি পায়।
  • শাড়ির পাড়ের নকশায় বৈচিত্র্য রয়েছে। পুরো বুননের পর পাড়ের ও জমিনের কিছু কিছু নকশা আলাদাভাবে হাতে বুনন করা হয়।
  • আরামদায়ক একটি পরিধেয় বস্ত্র, যা যেকোনও ঋতুতে পরার উপযোগী।
  • টাঙ্গাইল শাড়ি মার্জিত, রুচিশীল ও আভিজাত্যপূর্ণ।

টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য ও শাড়ির বর্ণনা দেয়ার জন্য এই আবেদনপত্রে ঐ অঞ্চলে প্রচলিত বিভিন্ন প্রবাদও উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, ‘নদী চর খাল-বিল গজারির বন; টাঙ্গাইল শাড়ি তার গরবের ধন’ বা, ‘চমচম, টমটম, তাঁতের শাড়ি; এই তিনে মিলে টাঙ্গাইলের বাড়ি’।

শিল্প মন্ত্রণালয় ডিপিডিটি-তে জার্নাল প্রকাশের মাধ্যমে টাঙ্গাইল শাড়িকে প্রাথমিকভাবে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যদিও এই স্বীকৃতি পাওয়া মানেই সনদ পাওয়া না।

টাঙ্গাইল শাড়ি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে বিবেচিত হবে কিনা, সেটা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও অন্তত দুই মাস।

এই বিষয়টি স্পষ্ট করতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সনদ পাওয়ার জন্য এই পাবলিকেশন পর্যাপ্ত না। জার্নালে যাওয়ার মধ্য দিয়ে এটা এখন প্রাথমিক স্বীকৃতি পেল।”

“এরপর কারও কোনও অভিযোগ থাকলে তাদের আপিল করার সুযোগ থাকবে। আপিল না করলে দুই মাস পর টাঙ্গাইল শাড়ি জিআই সনদ পাবে। কিন্তু আপাতত স্বীকৃতিটা আমরা দিয়ে দিয়েছি।”

অর্থাৎ, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জার্নাল প্রকাশ হওয়ার পর সর্বোচ্চ দুই মাস সময় থাকে। এই সময়ে ঐ পণ্যের সাথে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনও দেশ বা জেলা, এমনকি প্রতিষ্ঠানও অভিযোগ জানাতে পারে।

কিন্তু, বিরোধিতা করার জন্য দুই মাস থাকা সত্ত্বেও ভারতের আবেদনের বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে কেন কোনও অভিযোগ জানানো হলো না; ঘুরে-ফিরে এই প্রশ্নটি বারবার সামনে আসছে।

এ প্রসঙ্গে ডিপিডিটি জানিয়েছে, এই বিষয়টির ওপর জেলা প্রশাসনের লক্ষ্য রাখা উচিৎ ছিল।

তবে ভারতে জার্নাল প্রকাশের বিষয়টি জানা ছিল না উল্লেখ করে টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক কায়ছারুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “জার্নালে (ভারতের) প্রকাশ হওয়ার বিষয়টা আমার জানা নেই। ভারত স্বীকৃতি দিয়েছে, আমি জানতে পারি দোসরা ফেব্রুয়ারি। তাদের ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে।”

কিন্তু তাড়াহুড়ো করে তারা এখনই কেন আবেদন করলো, এমন এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরও বলেন, “টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে আমাদের ডকুমেন্টেশন রেডি হয়ে গেছিলো। রেফারেন্সিংয়ের কাজ চলছিলো। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মাঝে আমরা এমনিতেই এটি জমা দিতাম।”

মি. ইসলাম জানান, শুধুমাত্র টাঙ্গাইল শাড়ি না, টাঙ্গাইলের আরও কিছু পণ্যের জিআই স্বীকৃতির জন্য টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসন অনেকদিন ধরেই কাজ করছে।

এদিকে ভারত সরকারের টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই সনদ দেয়া প্রসঙ্গে গত ছয়ই ফেব্রুয়ারি ডিপিডিটি মহাপরিচালক মো. মুনিম বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, “জি আই সার্টিফিকেশনটাকে একটা পণ্য হিসেবে দেখতে পারেন। এখন আপনি (কোনও সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান) যদি আমার (ডিপিডিটি) কাছে না আসেন, তাহলে আমি তো আপনাকে দিয়ে দিতে পারবো না।”

যদিও দেশের সকল ঐতিহ্যবাহী পণ্যের জিআই রক্ষার জন্য একমাত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ডিপিডিটি।

বিবিসি নিউজ

Print Friendly

Related Posts