বিশিষ্ট সাংবাদিক লেখক, কলামিস্ট ও কথাসাহিত্যিক ফাইজুস সালেহীনের উপন্যাস বিরহ বিজয় তৃতীয় সংস্করণ বেরিয়েছে। একটি উপন্যাসের তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হওয়া; এটাই তো একটা বড় ব্যাপার। বইটি পড়লাম। শতাধিক পৃষ্ঠার উপন্যাসটি শুরু করে মনে হয়েছিলো পড়া শেষ করেই উঠবো। এই গদ্যশিল্পীর গল্প বলবার ঢংটাই এমন যে, পাঠককে স্রোতের মতো টেনে নিয়ে যায়।
২০১০ সালে মেলা প্রকাশনী থেকে প্রথম সংস্করণ বেরুলে তখনও একবার পড়েছি। তখন বইয়ের কলেবর অনেকটাই ছোট ছিলো। তৃতীয় সংস্করণে বেশ কয়েকটি নতুন অধ্যায় যোগ করা হয়েছে। কাজেই দুই বসায় পড়তে হলো। বিরহ বিজয় উপন্যাসের একটি অসাধারণ চরিত্র রেবেকা। ঘটনাচক্রে বই বেরুবার আগেই আমি রেবেকার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম, একটি মাত্র সংলাপের জন্যে। তার পেছনেও একটা গল্প আছে। সেই গল্পটা বলি, ২০০৯ সালে নভেম্বরে কী ডিসেম্বরের এক বিকেলে কথাসাহিত্য কেন্দ্রের আসর বসেছিলো গল্প পাঠের। ফাইজুস সালেহীন আসরে পড়ার মতো কোনো গল্প সাথে আনেননি। তার ব্যাগে ছিলো, বিরহ বিজয় উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। তিনি বললেন, আসরের অনুমতি পেলে বিরহ বিজয় উপন্যাসের একটা ছোট অংশ তিনি পড়ে শোনাতে পারেন। সবাই বললো, তবে তাই হোক। আমরা শুনলাম সেই অংশটি- নূরুল আর রেবেকার মান-অভিমানের অধ্যায়। সেই অধ্যায়ের একটা সংলাপ; রেবেকা বলছে নূরুলকে, তুই তো একটা মিরমিরা ঘোড়া, কেলাই খাইবার জম।’ এই ডায়লগ শুনে আসরের সবাই হো হো করে হেঁসে উঠলো। এরকম ডায়লগ এর আগে আমরা কেউ কখনও শুনিনি।
অসাধারণ সেই ডায়লগের জন্যেই বোধহয় রেবেকাকে আমার অসম্ভব ভালো লেগেছিলো। সত্যি বলতে কী; রেবেকার টানেই আমি বিরহ বিজয় বইয়ের পাতা খুলেছিলাম। তারপর ধীরে ধীরে পরিচয় হলো মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কাহিনীর ডালপালায় আরও অনেক চরিত্রের সাথে, যাদের প্রত্যেকেই নিজের নিজের মতো সুন্দর, বিষন্ন ও প্রাণবন্ত। প্রতিটি চরিত্র যুদ্ধমগ্ন সময়ের অস্থির জীবন থেকে যেন বা তুলে আনা হয়েছে অবিকল।
বিরহ বিজয়, গভীর বেদনা ও সুগভীর ভালবাসার এক অনন্য সাধারণ উপন্যাস। এই উপন্যাসের পাতায় পাতায় ছড়ানো সংগ্রাম-সাধনা, যুদ্ধ, প্রেম ও বিরহের ছোপ ছোপ আনন্দ-বেদনা। পাঠকের চোখ ভিজে ওঠে নিজের অজান্তে। হু হু করে ওঠে সংবেদনশীল পাঠকের বুকের ভেতরটা। রেবেকা ও নুরুলদিন, শেফালি ও ইকবাল, শিলা ও শরাফ উদ্দিনের ভালবাসা শেষাবধি পড়ে থাকে ঝরা বকুলের মতো। এত প্রেম , এত ভালোবাসা ; অথচ বিরহ বিজয় উপন্যাসের কোথাও পাঠক ভালবাসা শব্দটি খুঁজে পাবেন না। এই উপন্যাসে কোনো প্রেমিক অথবা প্রেমিকা ভুল করেও কখনও বলে না, আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু পাঠকের বুঝতে মোটেও অসুবিধা হয়না রেবেকা, শেফালি, শিলা, নুরুলদিন, ইকবাল কিংবা শরাফ উদ্দিনের পারস্পারিক প্রণয়গভীর অনুরাগের বিষয়। এই জায়গাটায় অবাক করা মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায় কথাশিল্পী ফাইজুস সালেহীনের।
বিরহ বিজয় উপন্যাসের কাহিনীর কাল পরিসর ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান থেকে ১৯৭২ সালের মধ্য জানুয়ারি পর্যন্ত। এই সময়পরিসরে নূরুলদিনের মাধ্যমে ঔপন্যাসিক রেখে যান নানান প্রশ্ন ; যার কোনো উত্তর নেই। বিরহ বিজয় উপন্যাসের চরিত্রগুলো তুলে আনা হয়েছে ময়মনসিংহের যুদ্ধমগ্ন পল্লী জীবন থেকে। পাত্রপাত্রীরা কথা বলে ময়মনসিংহের আঞ্চলিক শব্দের সাথে নাগরিক ভাষার সংমিশ্রণে। কখনও কখন নিরেট আঞ্চলিক ভাষায়। এর মধ্যদিয়ে সংলাপগুলো হয়ে উঠেছে আরও বেশি প্রাণবন্ত।
এই উপন্যাসের দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদের ফ্ল্যাপে অল্পকথায় খুব সুন্দর করে কাহিনীসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে। পাঠকের জন্যে সেই লেখাটুকুই তুলে দিলাম হুবহু –
‘নিরুদ্দেশ ভাইকে খুঁজতে গিয়ে নিজেই হারিয়ে যায় নূরুলদিন। অন্যরকম দেবদাস হয়ে হঠাৎ একদিন ফিরে আসে রেবেকার কৈশোরের ভালবাসা। যুদ্ধেমগ্ন ইকবাল ও তার বন্ধুরা। আনচান করে শেফালির মন। গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে ছারখার। নদীজলে ভেসে যায় লাশের পর লাশ। মজিবুর স্যার নিহত। ‘তবু মাথা নোয়াবার নয়’ পল্লীবাংলার মানুষ। স্যারের বুকে বিছিয়ে দেয়ার জন্য বাংলাদেশের ছোট একটি পতাকা নিয়ে আসে মকসুদ খলিফা। অদেখা সন্তানের কবরের পাশে পৌষের রাতে নিশ্চুপ বসে থাকে যুদ্ধফেরত শরাফ উদ্দিন। বালক মজনু শাহ ব্রহ্মপুত্রে সদ্য জেগে ওঠা ভেজা বালুচরে একাকি ঘুরে বেড়ায়। চরজুড়ে ছড়ানো ছিটানো অসংখ্য মানুষের মাথার খুলি, হাড়গোড়। ও অপেক্ষায় প্রহর গুনে কখন ফিরে আসে নিরুদ্দেশ ভাইয়েরা। জীবন দিয়ে দেশের জন্য ভালবাসার ঋণ শোধ করে যোদ্ধা ইকবাল। পাওয়ার আগেই নিঃস্ব হয়ে যায় বাগদত্তা শেফালি। মধুপুরগড়ে করিম দারোগার সাথে দেখা হয়ে যায় নুরুলদিনের। স্মৃতির জানালায় উঁকি মারে উনসত্তরের সংগ্রাম, একাত্তরের অসহযোগ। স্বামীহারা রেবেকাকে সাথে বাড়ি ফিরে আসে মুক্তিযোদ্ধা নূরুলদিন। ফিরে আসে স্মৃতিভ্রষ্ট শরাফ উদ্দিন। পাকিস্তানের জিন্দানখানা থেকে স্বদেশে পা রাখেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।সমস্ত বেদনা-বিরহ পেছনে ফেলে চূড়ান্ত বিজয় আসে অবশেষে। এই গল্প একাত্তরের।
বিরহ বিজয় উপন্যাসে জীবন্ত হয়ে ওঠে অশেষ বেদনা, নিরূপম ভালবাসা, গৌরব ও সাহসে ভরা সেই দিনগুলো।’
ফাইজুস সালেহীনের কলমে বিরহ বিজয় উপন্যাসে প্রতিটি চরিত্র ধরা পড়ে অবিকল। ইতিহাস যাদের কথা লেখে না, যেখানে সে অন্ধ-বধির, সেখানে আলো ফেলেছেন এই কথাশিল্পী। ছোট কলেবরের এ এক অনন্য সাধারণ বৃহৎ উপন্যাস।বরেণ্য নাট্য প্রযোজক আতিকুল চৌধুরী যথার্থই লেখেন, বিরহ বিজয় মুক্তিযুদ্ধের এক নান্দনিক দলিল।বইটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেছে বইঘর । এবারের বইমেলায় বিরহ বিজয় উপন্যাসটি পাওয়া যাবে ২৬০-২৬১ নম্বর স্টলে।