গুলশান-ই-ইয়াসমীন এর ধারাবাহিক ফিকশন ॥ পর্ব ২১-৩০

পর্ব-২১

অবাক চোখে স্তদ্ধ তুয়া বলে,

“আমি তুয়া আমি তুয়া
কে আছো কোথায়
বাংলা ভাষা যাবে খোয়া
কে আছো কোথায়
বলছি আমি তুয়া।
আমার মায়ের ভাষা যাবে
যাবে না যে খোয়া
বাংলা ভাষায় আছে যে
আছে যে আমার মায়া।
বাংলা ভাষা যেতে দিব
দিব না আমি খোওয়া
এই আমাদের এই আমাদের
একটি মাত্র চাওয়া।”

পর্ব-২২

মিসেস টাইম এর খুব মায়া হয় ছোট্ট মেয়েটির জন্য, নিজ ভাষার প্রতি ভালবাসা দেখে। মিসেস টাইম মি. ফসিল এর কাছে যায়। চারপাশ থেকে সৈন্য সামন্ত অভিবাদন করে। অবাক হয়ে যায় সবাই। মিসেস টাইম কখনও তো মি. ফসিল এর দরবারে কোন আর্জি নিয়ে আসেনি। রাজার দরবারের অনেক নিয়ম কানুন আছে। আর তাই রাজকীয় নিয়ম নিয়ে হাতে তাল পাতার উপর লিখিত পত্র নিয়ে পেশ করবে রাজদরবারে। কিশোরী মেয়েটি বাংলাদেশ থেকে কিভাবে যেন এসে গেছে। তাকে বাংলা ভাষা জানার অপরাধে বন্ধী করা হয়েছে। এত বড় অন্যায়!

মি. ফসিল মাঝে মাঝে এভাবে অন্যায় করে ফেলেন। তা তারও ক্ষমতা অনেক বেশি। এই ক্ষমতার গুণে সে দিন রাত অন্যায় করে।

তুয়া যেন আর শক্তি পায় না। লম্বা লম্বা লোহার দন্ডের দিকে তাকিয়ে বলে,

“হে লৌহ দন্ড
তোমরা হয়ে যাও
লন্ড ভন্ড।
করো প্রভু বিচার
ন্যায়ের খুলো খুলো দ্বার।”

এক সময় নিস্তেজ হয়ে যায় তুয়া মনি। মেঝের এক কোণে নিস্তেজ হয়ে বসে পড়ে।

পর্ব-২৩

মিসেস টাইম এর অন্যায় একদম পছন্দ না। আর তাই সে সত্যের সন্ধানী। সত্য পথে পৃথিবীকে রক্ষার জন্য সব রকম সবাইকে সাহায্য করেছে। বাংলাদেশ একটা ছোট দেশ। যেখানে ভাষার জন্য অনেকে প্রাণ দিয়েছে। সেই দেশের ছোট্ট কিশোরী প্রাণ দিয়ে ভালবাসে বলে তাকে বন্দীশালায় কেন বন্দী করা হবে। আর তা বরদাস্ত করা হবে না।

মিসেস টাইম মনে প্রাণে অনেক ক্ষেপে উঠেন। ততক্ষণে মি. ফসিল এর দরবারে মিসেস লিখিত পত্র নিয়ে হাজির হয়ে যায়। মিসেস টাইম মি. বিজ্ঞানী ফসিলকে ভয় পায় না। কিন্তু প্রশাসনিক আচার ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে তাকে অগ্রসর হতে হবে। ঐ দূরে তার দরবারে হাজিরের পর কি হবে জানে না। তবে মেয়েটিকে বাঁচানোর জন্য অনুরোধ করতে হবে। হয়তো মিসেস টাইমের অনুরোধ জানাতে পারে না। তা মিসেস টাইমের ব্যাপার।

মি. বিজ্ঞানী ফসিল ক্ষেপে বলে-

“হে হে হে
এসেছেন হেথায়
কোন ব্যাপার নিয়ে
হে হে হে।”

মিসেস টাইম বলে,
“কি ব্যাপার কি ব্যাপার
দরকার নেই ক্ষ্যাপার
দরকার নেই ক্ষ্যাপার।”

পর্ব-২৪

মি. ফসিল মি. টাইমকে অভিবাদন জানান। মিসেস টাইম তার নিজস্ব চেয়ারে উপবিষ্ট হন। চেয়ারে উপবিষ্ট হয়ে সে তার আর্জি মি. ফসিলকে জানায়।

মি. ফসিল বলে উঠে- মেয়েকে মুক্তি দেওয়ার কোন যুক্তি নেই।
মিসেস টাইম বলে, কেন স্যার?
মি. ফসিল বলে, বাংলা কোন রাজ ভাষা নয়। এই ভাষার কোন ফসিল নেই।

মিসেস টাইম খুব ক্ষেপে যান। বলে উঠেন- ও, এই জন্য- কোন ভাষাকে কেউ ভালবাসতে পারবে না?
মিসেস টাইম ক্ষেপে গেলে তার মুখ দিয়ে ছন্দ বের হয়, বলে উঠে-
“ বাংলা ভাষা ধণ্য
বাংলা ভাষা ধণ্য
ধণ্য সবার জন্য।”

ফসিল মুখ দিয়ে নানা রকম শব্দ করে। তখন মিসেস টাইম ক্ষেপে গিয়ে বলে,
“বাংলা ভাষা ধণ্য
বাংলা ভাষা ধণ্য
তুমি নও গণ্য
তুমি নও গণ্য।”

পর্ব-২৫

মিসেস টাইম বলে উঠেন- এই মেয়ে যুক্তি তর্কে কোন দিন যদি প্রমাণ করতে পারো বাংলা ভাষার কোন স্বয়ং সম্পূর্ণ সামান্যতম ফসিল আছে তবে সে মুক্তি পাবে?

মি. ফসিল বলে, কেন না, কেন মুক্তি পাবে না। অবশ্যই মুক্তি পাবে। তবে তার সাথে মুক্তির গান বাংলা ভাষায়-ই আমি গাইব। এ গানের জন্য তুমি স্বাক্ষী থাকবে। আমি বাংলায় গান গাইবো, যদি মেয়েটি কিছুটা ফসিল সংগ্রহ করে।

মিসেস টাইম দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বলে, আমি দেখবো স্যার ব্যাপারটা, তবে বাংলা ভাষা ভালবাসার ব্যাপারে দারুন শাস্তি দিয়েছেন। গড ব্লেস হার! মি. ফসিলের শেষের কথাগুলি মিসেস টাইমের বেশ ভাল লাগলো। মেয়েটিকে যেমন করে হোক রক্ষা করতে হবে। মনে মনে ভাবে-

“মি. বিজ্ঞানী ফসিলকে
দিয়েছো যে ধাক্কা
করতে হবে রক্ষা
করতে হবে রক্ষা
মি. বিজ্ঞানীকে দিয়ে ধাক্কা
দিয়ে ধাক্কা
করতে হবে রক্ষা
করতে হবে রক্ষা।”

পর্ব-২৬

মিসেস টাইম তুয়ার জন্য দারুণ ব্যথা অনুুভব করে। এই ছোট্ট মেয়ে কিভাবে এখানে এসে পড়েছে, তাও আবার মি. ফসিল এর মতো অসত্ লোকের হাতে। এ অনেক কঠিন ব্যাপার। কিভাবে মি. ফসিলকে খুশি করবে তাও আবার বাংলা ভাষার ব্যাপারে। অদ্ভুত জেদ এই মি. ফসিল এর। কিভাবে তাকে খুশি করবে।

মিসেস টাইম মনে মনে ভাবে মি. সেভ এর কাছে সাহায্য এর জন্য যাবে। সেই কতদূর থাকে মি. সেভ। তার পরে মি. সেভ একটু নিষ্ঠুর টাইপের। সহজে খুশি হতে জানে। মিসেস টাইম পৃথিবীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আছেন, কোন সন্দেহ নাই। মি. টাইম তার সকল ক্ষমতা মিসেস টাইমকে দিয়ে বসে থাকে। দূর আকাশের চাঁদ দেখে। আর ফসিল তৈরীর ইতিহাসকে লিপি বদ্ধ করে মিসেস টাইম দেখায়। মিসেস টাইম সেগুলো ফাইনাল রিপোর্ট হিসেবে জমা দেয়।

মিসেস টাইম মি.সেভকে বলে,
“মি. সেভ মি. সেভ
মেয়েটিকে করো রক্ষা
মেয়েটিকে করো রক্ষা
মি. ফসিল মেরেছে তাকে
দিয়েছে যে ধাক্কা
দিয়েছে যে ধাক্কা
মেয়েটিকে করো রক্ষা
মেয়েটিকে করো রক্ষা।”

পর্ব-২৭

মিসেস টাইম পৃথিবীতে হাজার হাজার ফসিলের তৈরীর গোপন রহস্য। কিন্তু বিশ্ব-বিধাতার কাছ থেকে মহা শক্তি পেয়ে বিজ্ঞানী ফসিল আজ খুঁজে বেড়ায় যে পৃথিবীতে কোন কিছুর ফসিল না থাকলে যেন নিজেকে উপযুক্ত একজন ফসিল বিজ্ঞানী মনে করে না। আর তাই মিসেস টাইম যেন মহা বিপদে পড়েছেন। আজ নিরুপায় হয়ে মিসেস টাইম যেন মি. সেভ এর কাছে যাবে। যদি মি. সেভ বাংলাদেশের তুয়া নামক মিষ্টি মেয়ের উপকার করতে পারেন। রক্ষা করতে পারেন।
মিসেস টাইম মনে মনে বলেন, এই পৃথিবীতে মেয়েরা মেয়ের জন্য রক্ষা করে। এখানে নারীত্বের একটা সম্পর্ক আছে। আহা সুইট মেয়ে তুয়া। তোমাকে আমি তোমার মর্যাদা আজ দিবো। তুমি তোমার সাহসিকতা দিয়ে আজ যেন হৃদয় কেড়ে নিয়েছো। ঐ আকাশে হাজার তারা যেন থাকে তেমনি তোমার ভাষা প্রেম একটা নক্ষত্র হয়ে থাকবে। ঐ নক্ষত্রে আমি সময়ের পুঞ্চ ঘোষনায় সদা ব্যস্ত থাকি। আজ এতো ব্যস্ততায় আমি তোমাকে বরণ করেছি। আমি তোমাকে জয়ী হিসেবে দেখতে চাই।
মিসেস টাইম মায়া মমতায় বলে উঠে-
“ছোট্ট মেয়ে তুয়া
ফেলেছো মনে ছায়া
ফেলেছো মনে ছায়া
ছোট্ট মেয়ে তুয়া
ছোট্ট মেয়ে তুয়া
আমার মনে তোমার কায়া
আমার মনে তোমার কায়া।”

পর্ব-২৮

মিসেস টাইম ভাবতে ভাবতে মি. সেভ এর এলাকায় চলে আসে। গেটে পাহারাদার। এর মাঝে মিসেস টাইমকে দেখে খুশিতে হৈ চৈ করে উঠে। সবাই তাকে আপ্যায়ণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দূরে তাদের নেতা মি. সেভ দরবারে বসে আছেন। তিনি মানুষ খুব ভাল না হলেও মিসেস টাইমের বন্ধুত্বে উৎসাহী। মিসেস টাইম মনে মনে বলে আমি নিকুচি করি অমন বন্ধুত্বের। জীবনে মি. সেভ এর কাছে কোন শলা-পরামর্শের জন্য আমি মোটেও আসতাম না কি? মোটেও না। বন্ধুত্বের একটি কোয়ালিটি আছে। আর তাই বন্ধুত্ব সবার সাথে হয় না। ছোট মেয়েটি নেহাত বিপদে আছে। তাই তাকে রক্ষা তো করতেই হবে।
মিসেস টাইমকে উচ্ছসিতভাবে অভিনন্দন দেয়, হ্যালো বলে। দূরাকাশে যেন বাতাস মিসেস টাইমকে বলে রক্ষা করতে হবে। ওদেরকে রক্ষা করতে হবে। পৃথিবীর মাঝে বাংলা ভাষাকে অস্তিত্বদান করতে হবে।
মিসেস টাইম বলে,
“ বাংলা ভাষার দাও মান
বাংলার অস্তিত্ব করো দান
বাংলার অস্তিত্ব করো দান
বাংলায় গাও গান
বাংলায় গাও গান।”
পর্ব-২৯

মি. সেভ বলে, তা কি মনে করে মিসেস টাইম। আমাদের মতো গরীব এলাকায়।
মিসেস টাইম বলে, আপনি ভালভাবে জানেন বিনা দরকারে টাইমের আগমন হয় না।
মি. সেভ বিশ্রীভাবে হেসে বলে, তা মিসেস টাইম তোমার চাকুির যেমন আমার চাকুির তেমন। আমাদের বিধাতা সমমানের সমঅধিকার দিয়েছেন। আমরা স্ব স্ব ভাবে মানুুষের উন্নতি করে যাব। কোন সমস্যা নেই। এতক্ষণে মিসেস টাইম ভাল কথা শুনে হেসে উঠল। যাক মন্দ ভালো নিয়ে মি. সেভ ভাল কথা বলেছেন। মিসেস টাইমের মনে কিছু আশার ঢেউ খেলে যায়, এখানে কিছু সম্ভব।
মিসেস টাইম বলে উঠে-
“একটি ভাষা, বাংলা ভাষা
লক্ষ মনের লক্ষ আশা
কিন্তু দুরাশা, দুরাশা
মি. ফসিল করেছে সমস্যা।”
মি. সেভ বলে,
“কি সমস্যা
কি সমস্যা”
মিসেস টাইম বলেন,
“বাংলা ভাষার
ফসিল চাই
নয় সমাধান
নয়তো নয়।”
পর্ব-৩০

ফুলের তোড়া দিয়ে মিসেস টাইমকে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। আজ যেন মি. সেভকে নতুন এক মূর্তি হিসেবে দেখলো। দূর আকাশের সকল মমতা বোধ যেন মি. সেভ তার আচরণে প্রকাশ করেছেন। মিসেস টাইম আবার সৃষ্টি কর্তাকে খুব মানেন। তিনি মনে মনে অনেক খুশি হয়ে যান।
একসময় বলে, আমি একটি কঠিন কাজ নিয়ে এসেছি। সুদূর বাংলাদেশ থেকে এক কিশোরী মেয়ে এখানে এসেছে। ঘটনা চক্রে বিজ্ঞানী ফসিলের খপ্পরে পড়ে গেছে। বিজ্ঞানী ফসিল মেয়েটিকে বন্ধী করে রেখেছে।
মি. সেভ বলে উঠলেন- মেয়েটির অপরাধ কি?
মিসেস টাইম ক্ষুব্ধ হয়ে বলে, মেয়েটি বাংলা ভাষা জানে।
মি. সেভ বলে, তা পৃথিবীতে কত রকম ভাষা আছে তার মধ্যে বাংলা ভাষা একটা ভাষা, তাতে অপরাধ কি?
তার অপরাধ হলো সে বাংলা ভাষার ফসিল জানতে চাচ্ছে।
মি. সেভ বলে, তা মুশকিল বটে, তা মুশকিল বটে।
কিছুক্ষণ নিজ নিজ মনে ভাবতে থাকে। এই কিশোরী বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিবে অসভ্য বিজ্ঞানী ফসিলের হাতে। লোকটা ফসিল স¤্রাট হয়েছে তো হয়েছে, অসুবিধা কোথায়। তাই বলে সুন্দর একটা ভাষা বাংলা ভাষা, তার অসম্মান করবে, এ হয় না। এ অনেক অসম্মান।

(চলবে)

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts