পানথুমাইর রাজকীয় রাজহাঁস ও সীমান্তসুন্দরী মায়াবতী ঝর্ণা

শিউল মনজুর

এক.
জ্যৈষ্ঠের কাঁঠালপাঁকা গরমকে উপেক্ষা করে সিলেটের গোয়াইঘাট উপজেলার দর্শনীয় স্থান পানথুমাই দেখার জন্যে মে মাসের শেষদিন সকাল ১১ টায় সিলেট শহরের সোবহানীঘাট বাসস্টপ থেকে জাফলংগামী একটি বাসে ওঠে বসি।
বেশ কিছুদিন ধরে বিশেষ কোন জায়গায় যাওয়া হচ্ছে না। শহরের কোলাহলে থাকতে থাকতে মনের ভেতর একঘেয়েমি সৃষ্টি হয়েছে আর তা দূর করার জন্যই একটা সহজ ও নতুন জায়গা দেখার বাসনা থেকেই আজ গোয়াইনঘাটের এই দর্শনীয় স্থান দেখার জন্যে বেরিয়ে পড়ি।

অবশ্য যাত্রাশুরুর আগে গোয়াইনঘাট এর সুহৃদ অধ্যাপক আলতাফ সাহেবের নিকট থেকে পানথুমাই যাবার পথঘাট জেনে নেই। সেই সাথে বেড়ানোর জন্যে সফরসঙ্গী হিসেবে ফেঞ্চুগঞ্জ ডটকমের সম্পাদক রাজা সায়মনকে পেয়ে যাই। দুজনের জন্যে জায়গাটি নতুন এবং লোভনীয় এই জায়গাটি দেখার উদ্দেশ্যে আজ আমাদের যাত্রা।

বাসছাড়ার দেড়ঘন্টা পর ঠিক সাড়ে বারটার দিকে জৈন্তা থানার সারিঘাট নামক স্থানে এসে নামি। রাজা সায়মন এদিকটায় কখনো আসেনি। এদিকটায় আমার আসা হয়েছে অনেকবার। বলা যায় ছোটবেলা থেকেই আসছি। নানা সাহাব উদ্দিন চৌধুরী চাকুরী করতেন লালাখাল চা বাগানে। একটা সময় সারিঘাট থেকে নৌকাযুগে লালাখাল চা বাগানে যেতে হতো। এখন অবশ্য লালাখাল চা বাগানে যাবার ভিন্ন ভিন্ন রাস্তা রয়েছে। এই সারি নদীর সৌন্দর্য চোখে পড়ার মতো। নদীর স্বচ্ছ জলের গভীরতা পেরিয়ে নদীর তলদেশ পর্যন্ত দেখা যায়। সেই সাথে নদীর তীর থেকে সামান্যদূরে ভারত সীমান্তের মেঘালয় রাজ্যের হাজার হাজার ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট সবুজ বনের পাহাড় দেখে যে কারোর মন ভরে যায়।

দুই.
সারিঘাটে নেমে সারিনদীর তীরে এসে দাঁড়াই। সায়মন নদী দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। বললো, আজ সারি নদী ঘুরে বেড়াব। আরেকদিন পানথুমাই যাব। তাকে শান্তনা দিয়ে বললাম, সারিনদী ঘুরে বেড়াবো যে কোন দিন। আজ পানথুমাই মিস্ করবো না। অবশ্য সায়মন সারিনদীর তীরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে ভুল করলো না। অতঃপর

siul-2

সারিঘাটের একটি বটবৃক্ষতলে টি-স্টলে বসে দুজন দারচিনি ও এলাচী মেশানো চা পান করে ভীষণ তৃপ্তি পাই। মনে হলো এমন চা জীবনে প্রথম খেলাম। বিল পরিশোধ করতে গিয়ে অবাকই হলাম। এমন স্বাদের চায়ের মূল্য প্রতিকাপ মাত্র তিন টাকা। এখানে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করি।

তিন.
সারিঘাট থেকে গোয়াইনঘাট উপজেলার গাড়িতে চেপে বসি। এখান থেকে গোয়াইনঘাটের দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার। গোয়াইনঘাট পৌঁছুতে আরো ঘন্টাখানেক অর্থ্যাৎ দুটোর সময় উপজেলা বাসস্ট্যান্ড গিয়ে নামি। অধ্যাপক আলতাফ সাহেবের পরামর্শ মোতাবেক বাসস্ট্যান্ড থেকে একটি সিএনজি অটোরিক্সা নিয়ে মাতুরতল যাত্রা শুরু করি।

ছোট রাস্তা। দুটি ছোটগাড়ি ক্রস করতে পারে এমন প্রশস্থ। আবার রাস্তাটি বহুদিন ধরে নির্মাণ না হওয়ায় ভেঙ্গে পড়েছে। এবড়ো থেবড়ো রাস্তা। তবে রাস্তার দুদিকে খাল বিল আর ঐদূরে মেঘালয় পাহাড় দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে যাই মাতুরতল। গোয়াইনঘাট থেকে মাতুরতলের দূরত্ব মনে হলো আট থেকে দশ কিলোমিটার হবে। যেখানে আমরা নামি সেটি মাতুরতল বাজার।

১৫/১৬ টি দোকান নিয়ে মাতুরতলবাজার। এই বাজার থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সীমান্তবর্তী পাহাড়ের ছবি। মনে হয় হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। অপূর্ব দৃশ্য। কিন্তু সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। ঘড়ির কাটা তিন ছুঁই ছুঁই করছে। ক্ষুধা জানান দিচ্ছে পেটখালি। ক্ষুধাকে বাড়তে দেয়া যাবে না। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিল, ভাতের হোটেল। হোটেলটি বাড়ির মতো। ভেতরে পাতানো চেয়ারে বসতেই ছুটে এলো হোটেল বয়। জানালো ভাতের সাথে মোরগের মাংস আছে। আর কোন তরকারী নেই। বললাম, আল হামদুলিল্লাহ, আমাদের এতেই চলবে।

খাবারের প্রতি সায়মনের তেমন আগ্রহ নেই। কতক্ষণে পানথুমাই পৌঁছাবে সে জন্যে উসখুশ করছে। হোটেল বয়কে জিজ্ঞেস করলাম, পানথুমাই আর কতদূর। সে জানালো পাঁয়ে হেঁটে গেলে ২৫/৩০ মিনিট লাগবে। সি এন জিতে গেলে ১০ মিনিট। খাবার শেষ করে আমরা দ্রুত পেরিয়ে পড়ি।

চার.
শেষ পর্যন্ত সি এন জি অটোরিক্সা নিয়ে মাতুরতল থেকে পানথুমাই যাত্রা করি। হোটেল বয়ের কথাই ঠিক। মাত্র ১০ মিনিটে পৌঁছে যাই আজকের অতিকাঙ্খিত পানথুমাই। গাড়ি থেকে নেমে সবুজ পাহাড়ের দীর্ঘসারি আর ঠিক যেনো তার নিচেই আমরা দাঁড়িয়ে আছি। দেখে মনপ্রাণ ভরে গেল।

একদিকে সীমান্তবর্তী ভারতের সবুজ পাহাড় রাজ্য আর পাহাড়ের মধ্য থেকে নেমে আসা ঝর্ণাজলের দুধশাদাদৃশ্য মনের ভেতর বেহেশত বাগানের ছবি অংকিত হয়ে গেল। সেই সাথে একটি কথা মনে হলো, পৃথিবীতে যে সাগর-পহাড় দেখেছে তার কাছে সৃষ্টিকর্তার মূল্য অপরিসীম। ভারতের পাহাড় থেকে নেমে বাংলাদেশের অপেক্ষাকৃত সমতল ভূমিতে নেমে আসা এই ঝর্ণার নাম মায়াবতী ঝর্ণা এবং সবুজ পাহাড়ের নাম বড়হিল। এই বড়হিল পাহাড় ঘেষে যে রাস্তাটি পানথুমাই থেকে দেখা যায় তা সিলেট ও শিলং শহরকে যুক্ত করেছে। মূলত বড়হিল পাহাড়ের মায়াবতী ঝর্ণা সিলেটের পানথুমাই গ্রাম ছুঁয়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। অতঃপর পানথুমাই গ্রামের নৌকাচালক শিশু গুলজার আহমদ তার ছোট্ট নৌকা দিয়ে আমাদেরকে ঘুরে দেখালো পাহাড় থেকে নেমে আসা মায়াবতী ঝর্ণার বিরলদৃশ্য।

আর এই বিরলদৃশ্যকে রঙে রঙে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে পানথুমাই গ্রামের শতশত রাজহাসের রাজকীয় যাপন। যাদের কাছে জিরো পয়েন্ট বলে কিছুই নেই।
শিউল মনজুর   কবি ও কথাসাহিত্যিক।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts