লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন

ইটালিয়ান বিখ্যাত সাংবাদিক ওরিয়ানা ফাল্লাচির উপন্যাস ‘লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন’ একটি পাঠক সমাদৃত উপন্যাস। এটি নাটক হিসেবেও মঞ্চে এসেছে একাধিকবার। ওরিয়ানা ফাল্লাচি (১৯২৯-২০০৬ ) একজন আপোষহীন লেখিকা। উপন্যাসটির মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে অপ্রত্যাশিত ভ্রণের অস্তিত্বে আলোড়িত এক মাতৃসত্তা। ধীরে ধীরে প্রাণের মাঝে আরেক প্রাণের অস্তিত্ব। অনাগত এই প্রাণের বৈধ-অবৈধতার প্রশ্নে সমাজ কাঠামো অসভ্যরূপে দৃশ্যমান। মায়ের উদরে মনুষ্যাকৃতি নিতে থাকা ভ্রুণের সঙ্গে কথোপকথন চলে মায়ের। সেই কথোপকথনে দৃশ্যমান হতে থাকে সমাজের ভিন্ন এক রূপ। একাকিত্বের লড়াইয়ে ক্লান্ত হতে হতে উদরশূন্য মায়ের আহাজারি দেখা যায় শেষ পর্যন্ত। উপন্যাস আর স্মৃতিকথা লিখলেও ইতালিয়ান এই আপসহীন লেখিকা রাজনৈতিক সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী হিসেবেই অধিক পরিচিত।

তিনি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার, উইলি ব্রান্ডিড, জুলফিকার আলী ভুট্টো, আয়াতুল্লাহ খোমেনি, ওল্টর ক্রনকিট, ওমর খাদাফি, ইয়াসির আরাফাত, ইন্দিরা গান্ধী, শন কানারি, ফেডরিকো ফেলিনি প্রভৃতি প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের।

ভিয়েতনামের উপর লেখা ‘নাথিং অ্যান্ড সো বি ইট’ অনাগত সন্তানের সাথে কথোপকথন ‘লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন’ এবং প্রেমিক অ্যালেক্রান্ডার প্যানগোউলিসকে নিয়ে লেখা ‘এ ম্যান’ তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

বিবাহ বহির্ভূত সন্তান জন্ম দেওয়া আমাদের মতো রক্ষণশীল সমাজে যেমন চোখের বালি ঠিক তেমনি ইউরোপের মতো মুক্তমনাদের চারণভূমি খ্যাত দেশগুলোতেও একই অবস্থা। সেখানে এই ধরনের গর্ভধারণ যেমন প্রেমিক স্বীকার করতে চায়না, সবচেয়ে কাছের বন্ধুটিও এটিকে এড়িয়ে যেতে বলে। শুধুমাত্র কাছে থেকে সাহস যোগায় গর্ভধারিণী মা। এ রকমই ঘটনা প্রবাহের মধ্যে এগিয়েছে ‘লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন’।

লেখকের ভাষায় ‘নিজের শরীরের ভেতর আরেকটি জীবন লালন করার মধ্যে এক ধরনের গর্ব আছে, গর্ব আছে একজনের ভেতর দু’জনকে অনুভব করার মধ্যে।’ পৃথিবীতে নবাগত সন্তান মেয়ে হলে যেমন সময়ের ব্যবধানে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ঠিক তেমনি ছেলে হলেও পোহাতে হয় নানা ঝামেলা। যদিও লেখক এতে মেয়ে সন্তানের সমস্যা বেশি-ই বলে উল্লেখ করেন।

‘লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন’ বিবাহ বহির্ভূত উপায়ে গর্ভে ধারন করা এক মা এবং অনাগত সন্তানের দীর্ঘ আলাপন। কঠিন বাস্তবার মাঝেও দৃঢ় আবেগ এবং প্রচলিত নিয়ম ভাঙার এক সাহসী উচ্চারণ ছুটে বেড়ায় ’লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন’ -এর। এটি মূলত বর্ণনা প্রধান রচনা। বর্ণনার ঢঙে কথা বলার সময় সন্তানের হয়ে নিজে প্রশ্ন করে নিজে উত্তর দেওয়ার একটি অভিনব বিষয় লক্ষ্য করা যায়। শুধু কি তাই? প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে একজন পুরুষ ও একজন নারীর শারীরিক সম্পর্ক একটি মানব শিশুর জন্ম দেয়, মানবসৃষ্ট সমাজে বৈধ কিংবা অবৈধ বলে যাদের পরিচিতি। আবার এ প্রশ্নও আসে এবং কোন কোন সমালোচক এ ধরনের প্রশ্ন করেছেনও। সব সমাজ যদি এ ধরনের বিষয়কে সহজে মেনে নেয় তাহলে কোথায় যাবে মানব সভ্যতা, সমাজ কি টিকে থাকবে ইত্যাদি ইত্যাদি। বিবাহকে কেউ কেউ বলেছেন ‘লিগ্যাল প্রস্টিটিউশন’। তারপরেও সেই বিবাহ নামক মন্ত্র কিংবা বন্ধন কিংবা সামাজিক নিয়মই তো সমাজকে এক অজানা সূতোয় আটকে রেখেছে, গড়েছে পরিবার।

একজন পুরুষ ও নারী দুজন দুজনকে ভালবাসে, একসাথে বসবাস করে। এক পর্যায়ে নারী উপলব্ধি করে সে সন্তানসম্ভবা। পুরুষসঙ্গী তার এই সন্তান ত্যাগ করার জন্য চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। পেটে সন্তানের বয়স বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে নারীর লাইফস্টাইলে বিশৃংখলা চলে আসে। এই নারী তার জীবন নিয়ে যেমন গৌরববোধ করেন আবার ঘৃণাও করেন। যে সমাজে তিনি টিকে থাকতে চেয়েছেন পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে, একজন মানুষের অধিকার নিয়ে, সেই সমাজ তাকে বারবার কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দেয়। সম্পর্কের টানাপোড়েন ও মানসিক চাপের মধ্যে তার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। একটা সময় পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া তার কাছে পাপের মতো মনে হয়। শেষ পর্যন্ত নিজেকে শেষ করে দেওয়ার খেলায় মেতে ওঠে আবার শোধরাতে চায় নিজের ভবিষ্যত সন্তানের কথা ভেবে, মাতৃহৃদয়ের আকুতি তার মনে উঁকি দেয় বারবার। সমস্যায় জর্জরিত আমাদের যাপিত জীবন। ক্ষুধা, দারিদ্র, অপমান, বঞ্চনা, কপটতাপূর্র্ণ এ পৃথিবীতে একজন নতুন মানুষ নিয়ে আসা কী ঠিক?’ তাই এত সমস্যার মাঝে অনাগতের আগমনকে ভয়ের চোখেই দেখতে বাধ্য হচ্ছেন মা। সন্তানের বয়স বাড়তে থাকলে আকৃতিও পরিবর্তন হয়। এতে মায়ের পেটের আকারেও স্বাভাবিকের চেয়ে পরিবর্তন আসে। অবিবাহিত নারীর এমন পরিবর্তন সমাজ মানতে নারাজ। যার কারণে মা হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করা হয় সে পুরুষও পর হয়ে যায়। ডাক্তারও ভাল চোখে দেখেন না এমন রোগীকে। এখানেই একাকার হয়ে যায় প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের সরলরেখা। এতে একটি বিষয়ই প্রতীয়মান তত্ত¡ আর তথ্য এক বিষয় নয়।

শীতের আগমনে মায়ের মনে আশার সঞ্চার করে। কারণ ‘শীত শুরু হয়ে ভাল হয়েছে। বড় ওভারকোটের নিচে উঁঁচু পেট আর মানুষে চোখে পড়বে না। আমিও আর অস্বস্তিতে পড়ব না।’ ঘটনা এবং বর্ণনায় প্রসঙ্গক্রমে উঠে এসেছে নানা কুসংস্কার। যা আমাদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় চোখে পড়ে হরহামেশা। বিছানার উপর ফুল অশুভ চিহ্ন। শুধুমাত্র মৃতের বিছানাতেই ফুল রাখা যায়। অনেকে বলে বাচ্চা জন্মানোর আগে দোলনা কেনা নাকি অমঙ্গলের লক্ষণ। এমনই নানা কুসংস্কার উঠে আসে বিভিন্ন জায়গায়। অসতর্কতার কারণে যে সন্তান মায়ের গর্ভে চলে এসেছে তা নীরবে অনেকটা অভিমানেই হারিয়ে গেছে জগত থেকে। রেখে গেছে স্মৃতির পদচিহ্ন। দিয়েছে প্রশ্ন ছুড়ে সুখ, স্বাধীনতা, ভালবাসা-খুঁজে পেয়েছ তুমি?’

মা সন্তানকে সম্বোধন করে দীর্ঘ এক চিঠি লেখেন, লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন। এক পর্যায়ে তার গর্ভস্থ ভ্রুণ বিকশিত না হয়ে নষ্ট হয়ে যায়, ফলে তার প্রতিক্রিয়া আরও ঘণীভূত, আরও বেদনাবিধুর হয়।

ওরিয়ানা ফাল্লাচি সাহসী নারী ও পেশাগত ব্যক্তিত্ব। ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ, সংষ্কার সম্বন্ধে তার রয়েছে গভীর, বলিষ্ঠ ও বিরূপ অভিমত। তিনি তাঁর গর্ভস্থভ্রুণকে জীবনবিমুখ ধারণা দিতে থাকেন, তার সামনে মেলে ধরতে থাকেন ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ ও সংষ্কারের জটিল গ্রন্থিসমূহ। এ পর্যায়ে তার কথাবার্তা অত্যন্ত আবেগাক্রান্ত ও দুশ্চিন্তা উদ্রেককারী।

তিনি সন্তানকে একবার বলছেন, Life is such an effort, Child. It’s a war that is renewed each day, and its moments of joy are brief parentheses for which you pay a cruel price. এটি ভয়ংকর নিয়তির অশুভ ইঙ্গিত, নয় কোন আশার বাণী, নয় ভরসার কথা। পৃথিবীর কঠিন ও নিষ্ঠুর বাস্তবতা মা তার অনাগত সন্তানকে শোনাচ্ছেন। আবার চিন্তা করছেন এই নিষ্ঠুর, এই কঠোর পৃথিবীতে তার আগমন কতটা সুখের হবে, তার চেয়ে এখানে না আসাই তো ভাল ইত্যাদি চিন্তা-ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে।

আবার অন্য এক সময় তিনি শিশুটিকে বলছেন, You belong neither to God nor the state nor me. You belong to yourself and no one else. এটি চরম হতাশার কথা কারণ যে শিশু সঠিক পার্থিব নিয়ম অনুযায়ী ভ্রণে আসেনি, তাকে কেই স্বাগত জানাবে না, স্রষ্টাকে তিনি বলতে চাচ্ছেন যে তিনিও হয়তো এই সন্তানকে সেভাবে দেখবেন না। তাই শিশুকে বলছেন তুমি তোমার নিজের। সন্তানের প্রতি মায়ের গভীর ও অকৃত্রিম ভালবাসা ও অনুভ‚তি সেটির প্রকাশ এভাবে ঘটেছে। সম্ভবত জীবন ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই নিহিত রয়েছে উপন্যাসটির শক্তি আর তাই এটি পৃথিবীব্যাপী জনপ্রিয়। অনূদিত হয়েছে বহু ভাষায়। অতিক্রম করেছে মনুষ্যতৈরি বর্ডার, পৌঁছে গেছে বিশ্বের সর্বত্র।

masumbillah65@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts