শাহ মতিন টিপু : প্রবাল চৌধুরী বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক। তিনি তার অসাধারণ গায়কি ও সুষমামণ্ডিত কন্ঠসুধায় সুরের আকাশে ধ্রুবতারার মত দেদীপ্যমান হয়ে ওঠেন। আধুনিক বাংলা গানকে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে গেছেন সুরের এই বরপুত্র। তার সুর হৃদয়কে স্পর্শ করে। শুধু গান গেয়েই তিনি কিংবদন্তি।
জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৫ আগস্ট ১৬, রহমতগঞ্জ ‘মনোলীলা’ দেওয়ানজী পুকুর লেনের নিজস্ব বাসভবনে। পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রামের রাউজানের বিনাজুরি গ্রামে। তার ডাক নাম রতন। পিতা বিশিষ্ট সমাজসেবক প্রকৌশলী মনমোহন চৌধুরী। মাতা বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব লীলাবতী চৌধুরী।
শৈশবে পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রামের জামাল খান রোডের সেন্ট মেরী’স স্কুল, পাথরঘাটার সেন্ট প্লাডিস হাইস্কুল ও মিউনিসিপাল হাইস্কুলে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হওয়ায় ক্লাসে ডবল প্রমোশন পেতেন তিনি। কলেজ জীবন কেটেছে তার চট্টগ্রাম সিটি কলেজে।
শৈশব ও কৈশোরে নাচের জন্য খ্যাতি ছিল প্রবাল চৌধুরীর। বাড়ির কাছাকাছি কোনো অনুষ্ঠান হলে সেখানে নাচের জন্য ডাক পড়ত। তবে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাচের চেয়ে গানের দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি।
সঙ্গীতে তিনি তালিম নেন বিখ্যাত কন্ঠশিল্পী কলিম শরাফীর কাছে। পাশাপাশি বড় বোন বীর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণী ঘোষ, মিহির নন্দী, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চৌধুরীর কাছেও গান শিখেন।
১৯৬৬ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশ বেতারে গান গাওয়া শুরু করেন। চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীন প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক আনোয়ার পারভেজের সুরে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেন। পরবর্তীতে মোহনলাল দাস, সুজেয় শ্যাম, শেখ সাদী খানের সুর ও সঙ্গীতে গান পরিবেশন করেন প্রবাল চৌধুরী।
১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাল চৌধুরী মুজিবনগর সরকারের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তাঁর দুই ভাইবোনসহ যোগদান করে পঞ্চাশটিরও বেশি দেশাত্মবোধক গানে অংশগ্রহণ করে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
এছাড়াও ড. সনজীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, আলমগীর কবির, সাহিত্যিক অন্নদাশংকর রায়, দীপেন বন্দোপাধ্যায়, মোস্তফা মনোয়ার ও জহির রায়হানের নেতৃত্বে গঠিত ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ তাঁর বড় বোন মুক্তিযোদ্ধা ও শব্দ সৈনিক কল্যাণী ঘোষের পরিচালনায় ‘বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী গোষ্ঠী’ এবং তিন ভাইবোন কল্যাণী ঘোষ, প্রবাল চৌধুরী ও উমা খানসহ কলকাতার প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ও অভিনেত্রি রুমা গুহ ঠাকুরতার ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার’ এর সদস্য হয়ে সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠনের লক্ষ্যে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের উজ্জীবিত, উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত করেছেন।
তাঁদের পরিবারের পাঁচ ভাইবোন সকলেই শৈশবে মা লীলাবতী চৌধুরীর কাছে লেখাপড়া, সংগীত, নৃত্য, অভিনয় ও আবৃত্তি শিক্ষাগ্রহণ করেন। প্রবাল চৌধুরীর মাতা অর্গান ও পিয়ানো বাজানোয় পারদর্শী ছিলেন।
এছাড়াও তাঁর বড় ভগ্নিপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা রেলওয়ের সাবেক চিফ মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার শ্রীশ চন্দ্র দাশ মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন।
তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাইবোন শিল্পী কল্যাণী ঘোষ, প্রবাল চৌধুরী ও উমা খানের বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল ভারতের প্রথিতযশা শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, বনশ্রী সেনগুপ্ত প্রমুখের সঙ্গে সঙ্গীতজ্ঞ সলিল চৌধুরীর রচনা ও বাংলাদেশের সঙ্গীত পরিচালক সমর দাশের সঙ্গীত পরিচালনায় কলকাতার এইচএমভি থেকে প্রকাশিত লং প্লেয়িং রেকর্ডে গান গাইবার।
ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত আর ভরাট কণ্ঠের অধিকারী এই শিল্পীকে আশির দশকে সঙ্গীতবোদ্ধারা অভিহিত করেছিলেন বাংলাদেশের হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হিসেবে।
শিল্পী প্রবাল চৌধুরী বেশকিছু চলচ্চিত্রে নেপথ্য কন্ঠদান করেছেন। মুন্সিয়ানার স্বাক্ষর রেখেছেন চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনাতেও। তার গাওয়া উল্লেখযোগ্য গানগুলো হলো – বাংলাদেশের প্রথম রঙিন ছবি ‘বাদশা’ তে বোন উমা খানের সাথে দ্বৈতকন্ঠে গাওয়া ‘আরে ও প্রাণের রাজা’, ‘প্রেমের এই মেলাতে’ এছাড়াও ‘আমি ধন্য হয়েছি ওগো ধন্য’ আমি মানুষের মত বাঁচতে চেয়েছি’ ‘কোথায় যাব বন্ধু বল’, ‘লোকে যদি মন্দ কয়’, ‘চিরদিন সাথী তোমাকেই চাই’ ‘এই জীবন তো একদিন চলতে চলতে থেমে যাবে’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান তিনি বেতার, টেলিভিশন, ক্যাসেট ও সিডিতে রেকর্ড করেছেন।
ব্যক্তিজীবনে প্রবাল চৌধুরী দুই পুত্র সন্তানের জনক। জ্যেষ্ঠ পুত্র তাপস চৌধুরী সুজন বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক এবং সঙ্গীতশিল্পী। কনিষ্ঠ পুত্র ডা. রঞ্জন চৌধুরীও একজন সুরকার, প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীতশিল্পী এবং বাংলাদেশ জাতীয় টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় ছয়বারের চাম্পিয়ন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, শব্দ সৈনিক, সঙ্গীত শিল্পী প্রবাল চৌধুরী তার স্বল্প আয়ুষ্কালের আলোকিত জীবনে কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেছেন দেশবিদেশের বহু পুরস্কার, সংবর্ধনা ও সম্মাননা। পেয়েছেন সর্বোপরি সকল শ্রেণির মানুষের ভালোবাসা।
২০০৯ সালের ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশনরত অবস্থায় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে তিনি স্ট্রোক করেন এবং ১৬ অক্টোবর সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চিরবিদায় নিয়ে চলে যান সঙ্গীতশিল্পী।