গল্প ll মাটির আত্মকথন

রণজিৎ সরকার

শিক্ষিত কাদির কৃষিকাজ করেন। যে জমিতে ফসল ফলান। সে জমি আগে তার ছিল না। তার পূর্বপুরুষদের ছিল না। ক্রয়সূত্রে মালিক হয়েছেন। তিনি টাঙ্গাইল জেলার অধিবাসী ছিলেন। যমুনার তীরবর্তী তার ঘরবাড়ি ও জমিজমা ছিল। যখন যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু তৈরির কাজ শুরু হয় তখন স্ত্রী-সন্তান, বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে তিনি বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হন। অর্থের বিনিময়ে। তিনি পাশের জেলা সিরাজগঞ্জের চান্দাইকোনা ইউনিয়নে এক হিন্দু বাড়ির কিছু জায়গা আর মাঠের কয়েক বিঘা জমি কিনে নিয়ে বসবাস শুরু করেন। মাঠের কেনা জমিতে বিভিন্ন সময় ফসল ফলান কাদির।

জমিতে শীতের সময় ফুলকপি আর বাঁধাকপি চাষ করেছেন। একদিন সকালে কাদির ফুলকপির জমিতে ফুলকপি কাটতে এসেছেন। হঠাৎ কে যেন বলে উঠল- ‘কাদির, ফসল এবার খুবই ভালো হয়েছে?’

কণ্ঠ শোনামাত্র কাদির জমির এদিক-ওদিক তাকালেন। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। কণ্ঠটাও তার পরিচিত মনে হয়নি। এলাকায় তিনি প্রায় ত্রিশ বছর হলো বসবাস করছেন। শীতের সকালে হালকা কুয়াশা আছে। জমির আইলে মানুষ থাকলে দেখা যেত, তেমন ঘন কুয়াশাও নেই। জমির উত্তর পাশ দিয়ে রাস্তা। সেই রাস্তার দক্ষিণ পাশে কলাগাছটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু জমির আশপাশে কোনো মানুষ দেখা যাচ্ছে না। কাদির এবার ভাবলেনÑ নিশ্চয় জমির আইলে চুপ করে বসে আছেন কেউ একজন। আমাকে ভয় দেখানোর জন্য।

আবার বলল, ‘কাদির, ভয় পাচ্ছেন। ভয় পাবেন না। আমি ক্ষতিকর কেউ নই। আপনার ভালো চাই। তাই এবার ভালো ফলন হয়েছে। কারণ এবার আপনি মনোযোগ দিয়ে কাজ করেছেন। যে কোনো কাজ মনোযোগ দিয়ে করলে সফলতা পাওয়া যায়, তা জানেন নিশ্চয়ই।’

‘সচেতন মানুষ সবাই জানে। আমিও জানি। আপনি আসলে কে? পরিচয়টা দেন?’
‘এত সহজেই দিয়ে দেব পরিচয়!’
‘দিলে ভালো। আমার মনের ভেতর ভয়টা দূর হয়।’
‘ভোররাতে ভয় করে না। একটু পর পূর্বদিকে সূর্য উঠবে আর কুয়াশা কেটে যাবে। আলো দেখে আপনার সাহস বেড়ে যাবে।’
‘তা ঠিক বলেছেন। কিন্তু অদূশ্য আপনাকে না দেখে শুধু কণ্ঠ শুনে আমার সত্যি সত্যি ভয় করছে? আপনি সামনে আসুন। পরিচয় দিন।’
‘ভাবুন তো আমি কে হতে পারি!’

কাদিরের মাথায় এবার প্রথম যে ভাবনা এলো- একজনের কাছে গল্প শুনেছিলেন- ১৯৮৮-র বন্যায় তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে একটা নারীর মরা দেহ ভেসে এসে এই জমির কাশবন গাছের সাথে বেঁধে ছিল। তার কথাই সে ভেবে ফেলল। ওই কথা মনে পড়ার পর তার হৃদয় ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠল। এবার হৃদয়ে সাহস সঞ্চরণ করার জন্য এদিক-ওদিক তাকালেন। কোনো মানুষের দেখা পাওয়া যায় কি না। কিন্তু না। দেখতে পেলেন না। জমির আইলে দাঁড়িয়ে ফুলকপির একটা ফুলের দিকে তাকিয়ে সাহস করে বললেন, ‘ও তুমি তো এখন শিশু। মায়ের পেট থেকে বের হচ্ছো। সেজন্য কান্নার বদলে আমার সাথে কথা বলছো। তাই না। ফুল বাবু।’
এবার কণ্ঠটা রেগে জোরে বলল, ‘এই তুমি কাকে কী বলো। ফুলকপির ফল কি কথা বলতে পারে। পারে না। তবে মনে হয় মাছ দিয়ে যখন তরকারির রান্না হয় তখন তারা মৃত থেকেও দুজন চুপিচুপি কথা বলে আমরা শুনতে পাই না কিন্তু তরকারির টগবগ শব্দ শুনতে পাওযা যায় ওটাই তাদের কথা মনে হয়। আমি যে কথা বলছি, আমাকে চিনতে পারছ না।’

‘না। সেজন্য বলছি, আপনি পরিচয়টা দিন।’
‘আমি তোমার পায়ের নিচে।’

পায়ের নিচের কথা শোনামাত্র কাদির লাফ দিয়ে উঠল। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে কোনো জীবজন্তু তো নেই। তা হলে কে! এবার কাদির মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন ওই কণ্ঠের সাথে আর কোনো কথা বলবে না। জমির ফুলকপির গাছ দেখে তাড়াতাড়ি চলে যাবে। ধীরে ধীরে সে এগিয়ে যেতে লাগল। এমন সময় কণ্ঠটা আবার বলল, ‘কাদির তুমি আমাকে রেখে সত্যি সত্যি চলে যাবে। যেও না। আমার কথা শোনো। আমারও কিছু কথা তোমাকে বলার প্রয়োজন মনে করেছি। তাই তোমার সাথে এমন করছি। তুমি দাঁড়াও। আমার পরিচয় দিচ্ছি।’

কাদিরের এবার মনের ভেতরের ভয়টা কিছুটা কেটে গেল। পেছনে না গিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, ‘আচ্ছা। যাব না। তুমি তোমার পরিচয় দাও। তারপর কথা বলব।’

‘কিছুক্ষণ আগে কিন্তু বলেছিলাম, ‘আমি তোমার পায়ের নিচে’। তুমি ঠিক বুঝতে পারনি। তুমি তো খালি পায়ে জমির আইল দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছ। তোমার পায়ের নিচে কি আছে। তোমার পায়ের নিচে মাটি আছে। আমি সেই মাটি!’

কাদির বিস্ময়ের সাথে বললেন, ‘মাটি হয়ে তুমি কথা বলছ। মাটি কথা বলতে পারে। আগে জানা তো ছিল না।’

‘এতদিন শুধু জেনেছ মাটি ফেটে গ্যাস বের হয়, তেল বের হয়। গুপ্তধন পাওয়া যায়। স্বর্ণ পাওয়া যায়। আজ দেখি মাটির নিচ থেকে কণ্ঠও বের হয়। সত্যি অবিশ্বাস্য!’

‘অবিশ্বাস হওয়ার কথাই। কারণ তুমিই মনে হয় প্রথম ব্যক্তি। যে কি না মাটির কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছ।’

‘আমি প্রথম ব্যক্তি হাওয়ায় আমার লাভ কী আর তোমার লাভ কী বলো তো।’
‘আমার লাভ। আমি আজ অনেকগুলো দুঃখের কথা বলব তোমাকে। আর তোমার লাভ হবে যদি আমার কথায় মনোযোগ দিতে পার। পরে কাজে লাগাতে পারলেই তোমার লাভ হবে।’

কাদিরের সাহস ধীরে ধীরে বেড়ে গেল। কাদির বললেন, ‘আচ্ছা, তোমার দুঃখের-কষ্টের-বেদনার কথা কী বলবে বলো। দেখি তোমার জন্য কিছু করতে পারি কি না।’

‘আচ্ছা, বলছি শোনো, এই যে জমিতে ফুলকপি লাগিয়েছ। এই জমি আগে কি ছিল। তুমি কি জানো। জানো না হয়তো। তখন তোমার জন্মই হয়নি। সেজন্য তোমাকে আমি বলে দিই। এই জমিটা ছিল একটা কাশবন। তুমি যার কাছ থেকে কিনে নিয়েছ। তার ঠাকুরদাদা কাশবন কেটে দুই ছেলেকে ভাগ করে দেয়। তার এক ছেলে তোমার কাছে বিক্রি করে ভারতে চলে যায়। কিন্তু জমিতে সঠিকভাবে চাষবাস হচ্ছিল না। তুমি নিয়ে জমিটাকে আরও নষ্ট করে ফেলছ।’

‘কেন কী হয়েছে?’

‘জমিতে প্রচুর পরিমাণ কীটনাশক ওষুধ দিয়ে চাষবাস করে সফল ফলাচ্ছ, জমির উবরতা ক্ষতি হারিয়ে ফেলছ দিন দিন। আর সেই সফল মানুষ খেয়ে অনেক মানুষ নানা রকমের রোগে ভুগছে।’

‘কথা ঠিক বলেছ। কিন্তু এজন্য তো আর আমি দায়ী নয়। পরস্পর সবাই দায়ী। বিশেষ করে বেশি উৎপাদন বৃদ্ধি করতেই যত সব সর্বনাশ মানুষের।’

‘তা ঠিক। সেজন্যই তো কাশবন এখন সফল ক্ষেত হয়ে গেছে। গরু-মহিষের হালচাষ বাদ হয়ে এসেছে আধুনিক যন্ত্রপাতির চাষাবাদ পদ্ধতি।’

‘এখন মাটি তোমাকে বাঁচাতে আমি কী করতে পারি?’

‘আমাকে তো বাঁচানোর কথা বলছি না। তোমাদের বাঁচানোর জন্যই তো আমি কথা বলে ফেললাম। এখন তুমি চিন্তা করো। কীভাবে কী করে তোমরা স্বাস্থ্য রক্ষা করবে। আমি আর বেশি কিছু বলতে পারব না। আশপাশে লোকজন এসে যাবে। আমি এখন যাই।’

‘তুমি যখন কথা বলতে শুরুই করেছ। তাহলে এক কাজ করো সব জমির মাটি এক হয়ে প্রতিবাদ করবে। তা হলেই আমরা স্বাস্থ্যসম্মত সব ফসল পাব। আমাদের শরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকে। আর যদি না করো তা হলে দিন দিন আরও ভয়াবহভাবে রোগবালাই বাড়তেই থাকবে।’
‘তোমার কথার গুরুত্ব আছে। কিন্তু তুমি কি একটা জিনিস লক্ষ করেছ। গভীরভাবে ভেবেছ। আমি মাটি, আমাদের শেকড় কিন্তু একটাই। জলে-স্থলে সব জায়গা এক হয়ে মিশে আছি। শুধু স্থান-কাল-পাত্রভেদে মালিকানা পরিবর্তন হয়ে আছি। তোমরা ব্যবহার করো। জায়গাজমির জন্য ভাই ভাইকে খুন করে আর কতজন কত ভাবে খুনখারাবি করে ফেল। তাই বলছি, তোমরা যদি সচেতন না হয় তা হলে ক্ষতি কিন্তু তোমাদেরই হবে।’

‘আমরা আর কবে সচেতন হবো। কে করবে সচেতন। তুমি যেমন এই মুহূর্তে আমাকে সচেতন করার জন্য কথা বলছে। ঠিক এভাবেই একসাথে ভূমিকম্পনের মতো কেঁপে উঠে সচেতনতার কথা বলতে হবে সব জমির মালিককে। তা হলে সবার উপকার হবে, সব মানুষের ভালো হবে।’

‘তোমার আইডিয়া খারাপ না। আমরা মাটির সব স্তরের সাথে কথা বলে দেখি কী করা যায়।’

এর মধ্যে কাদিরের স্ত্রী একটু দূর থেকে বললেন, ‘এই তুমি কার সাথে কথা বলো। আশপাশে তো কাউকে দেখছি না। তোমার কানের কাছে তো মোবাইল ফোনও নেই।’

মাটি বলল, ‘তোমার স্ত্রী এসেছে। আমরা এখন কথা বলা বন্ধ করি। তুমি ফুলকপির গাছ কাটো, বাজারে তো নিয়ে যেতে হবে। আর স্ত্রীর সাথে কথা বলো।’
কাদির ধীরে ধীরে বলল, ‘ঠিক আছে। তোমার ওপর দিয়েই তো সব সময় চলাফেরা করি। সুযোগ-সুবিধামতো কথা বলবে কিন্তু।’
‘আচ্ছা।’

কাদিরের কাছে স্ত্রী এসে দাঁড়াতেই একটা কাক উড়ে যাওয়ার সময় তার মাথায় পায়খানা করে দিল। স্ত্রী বললেন, তুমি কাকের সাথে কথা বললে। কাককে কী বলেছো, রাগ করে মাথায় পায়খানা করে দিল। এ তো অশনিসংকেত। তোমার কখন না কোন বিপদ হয়। চলো বাসায়। গোসল করতে হবে। তারপর এসে ফুলকপির গাছ কাটবে।’
সব কথা গোপন রেখে কাদির বললেন, ‘সত্যি সামনে বিপদ আসবে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’

স্ত্রী বললেন, ‘কথায় আছে না সতর্কের মার নেই।’ এই বলে দুজন হেঁটে বাড়ির দিকে যেতে লাগল। জমি থেকে রাস্তায় উঠতেই হঠাৎ কাদিরের স্ত্রী পড়ে গেল। কাদির ভাবল স্ত্রী আসায় আমার আর মাটির কথা শেষ হয়নি। তাই মাটি স্ত্রীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য হয়তো ফেলে দিল। ভূমিকম্পনের মতো তারা যে কোনো এক সময় নড়ে উঠবে সেই নমুনা দেখিয়ে দিল। কাদির আর কিছু না ভেবে স্ত্রীকে তুলে নিয়ে বাড়িতে গেল। সামনের দিনে কী ঘটবে সে দুশ্চিন্তায় থাকলেন কাদির।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts