গোলাম কিবরিয়া পিনু’র এসময়ের কবিতা

চোখের জলেও মানুষের ঐক্য হয়

চোখের জলেও মানুষের ঐক্য হয়
অপরের চোখে জল দেখে
আমারও চোখে জল আসে
বেদনার মধ্যে মানুষের ঐক্য হয়
আর তখনই আমরা মানুষ!
সব ভেদাভেদ দূর হয়ে যায়
আর তখনই আমরা মানুষ!

 

আশ্রয় পুড়েছে
আমরা আশ্রয়চ্যুত মানুষকে আশ্রয় দেই।
সীমান্ত থাকে না –
উদারতায় নিমগ্ন হয়ে উঠি
যাতায়াতের দুষ্কর পথে অসহায় মানুষেরা
রক্তাক্ত শরীর নিয়ে আসে
অনাহারী হয়ে আসে
আমরা শুশ্রুষা দেই
খাবারও তুলে দেই
আমরা একসাথে বৃহৎ ভূগোলের বাসিন্দা হয়ে উঠি
আর তখনই মানবতা জেগে ওঠে।

 

কী রাষ্ট্র, কী সরকার, কী শাসন
চুরমার হয়ে পড়ে
অর্থহীন হয়ে পড়ে
যখন নিজভূমে ভূমিষ্ঠ হওয়ার জায়গা পায় না নবজাতক!
মা’য়ের ক্রন্দন কাঁপিয়ে তোলে পুরো সমুদ্রের জল
সমুদ্র তলদেশের উদ্ভিদও অনুভব করে
নাড়ি ও হৃদয় ছেঁড়া ব্যথা।
এ-ব্যথায় লুপ্তজ্ঞান ফিরে পেয়ে
আমরা মানুষ হয়ে উঠি।

 

গণহত্যা যখন চলে তখন গণতন্ত্র থাকে না
কূটনীতি ও কৌশলের কাছে হেরে যাবে
সাধারণ মানুষ?
পুঁতে রাখা বোমা মানে
সুপ্ত হিংসে ও অসূয়া!
মাইন বিস্ফোরণে দু’পা হারিয়ে যায়
ক্লান্ত শরীর ও পেটে ক্ষুধা নিয়ে
হাঁটতে হাঁটতে গুলিবিদ্ধ হয়
নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে ডুবে মরে মানুষ
হয়ে যায় লাশ!
নদীতে নৌকায় দুলে ওঠে জীবন!
তিলে তিলে গড়ে ওঠা জীবন এখন ধূলিধূসরিত!
মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই
দিনের পর দিন গোসল নেই
শৌচকর্মের ব্যবস্থা নেই
খোলা আকাশের নিচে থাকে –
কী ঘূর্ণিপাক, কী দুর্বিপাক – আমরা তা দেখে অবাক!
অবাক হই বলে আমরা মানুষ
সমবেদনায় অংশী হয়ে উঠি!

 

217

 

ভেদবুদ্ধি নিয়ে ভেদাভেদ ও গড়ে ওঠা প্রাচীর
বার বার মানুষকে সমকোণ থেকে স্থূলকোণে নিয়ে যায়।
ছয় বছরের শিশুর কোমরের বাঁ পাশে গুলি ঢুকে
ডান দিক বের হয়ে যায়
সেই শিশু তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করে
সে এখন আমাদের হাসপাতালের বিছানায়
অন্ধকারেও হাসপাতাল দ্যূতিময় হয়ে ওঠে!

 

মা গুলিবিদ্ধ হয়ে মরে পড়ে যায়
সেখানে মাটিচাপা দিয়ে আসতে হয় সন্তানকে
তারপর হাঁটতে হাঁটতে আমাদের ভূমিতে
তাকে তো দূরে ঠেলে ফেলে দিতে পারি না!
একাত্তরে আমরাও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম
ডালিম গাছটি নুয়ে পড়েছিল সেদিন ক্রন্দনে
আমরা এখনো সেই ক্রন্দন অনুভব করি
আর সংবেদনায় সমসংগীত গেয়ে উঠি।

 

তীরে ভিড়তে না পেরে বুকপানিতেই নেমে পড়তে হয়েছে
এক হাতে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে সন্তান,
অপর হাতে স্ত্রী। মাঝখানে নাফ নদী।
শোকপ্রবাহ যেন চতুর্দিকে – কোথায় দাঁড়াবে?
কোথায় শান্তি? কোথায় সম্প্রীতি? কোথায় মর্যাদা?
কোথায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ?
শোধ নিচ্ছে কী হিংস্ররূপী দানবেরা!
মানবিক সংকটে অসহায় মানুষের প্রতি সংহতি
আমরাও জানাতে পারি।
সমবেদনার ভূমিতে নাড়িপোঁতা থাকে আমাদেরও।

 

কাকে করো নিশ্চিহৃ মর্মঘাতী সহিংসতায়?
মৃত্যু দিয়ে আটকানো যাবে না মানুষের শক্তি!
একাত্তরে পারেনি আমাদেরও আটকাতে
সেকথা মনে করিয়ে দেই ইতিহাসের কণ্ঠলগ্ন হয়ে
এই আমার কণ্ঠে।
হৃদয়ভেদী সময়ে
ব্যথাতুর হই – ব্যাকুলিত হই – সংক্ষুব্ধ হই
আমরা মানুষ – আমরা মানুষ!

Print Friendly

Related Posts