প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরা সাজেকে খাবার পানির হাহাকার

রাঙামাটি প্রতিনিধি: বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কোল ঘেঁষে রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ভ্যালি। এখানে বসবাস করে পাংখোয়া, চাকমা, লুসাই ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন হচ্ছে বাঘাইছড়ির সাজেক। এই সাজেকের বেশির ভাগ মানুষ এখন খাবার পানির সংকটে ভুগছে। সাজেক ইউনিয়নের প্রায় ৫ টি মৌজার মানুষই খাবার পানির সংকটে দুর্বিষহ জীবন পার করছে।

সাজেকের শিয়ালদাই ১৬৯ নং মৌজার হেডম্যান ও ৯ নং ওয়ার্ড মেম্বার জৈপুথাং ত্রিপুরা জানান, সাজেকের শিয়ালদাই, কংলাক, বেটলিং, লংকরসহ বেশ কয়েকটি মৌজায় চরম খাবার পানির সংকট চলছে। অথচ এখানের পুরাতন জুপুই পাড়ায় ৪০ পরিবার, নিউ থাংনাং পাড়ায় ৫০ পরিবার, তারুম পাড়ায় ২৫ পরিবার, কমলাপুর পাড়ায় ১৯ পরিবার, লুংথিয়ান পাড়ায় ৬২ পরিবার, অরুন পাড়ায় ৭০ পরিবার, খাইচ্যা পাড়ায় ৩০ পরিবার, শিয়ালদাই পাড়ায় ৬২ পরিবার, হাইস্কুল পাড়ায় ৩৫ পরিবার, খগড়াকিচিং পাড়ায় ২৬ পরিবার, নিউ লংকর পাড়ায় ২২ পরিবার, অলংকার পাড়ায় ১৮ পরিবার, হুাদুক পাড়ায় ১৪ পরিবার এবং আনন্দ পাড়ায় ২৮টি পরিবারের বসবাস।

সাজেকের শিয়ালদাই পাড়ার বৈজন ত্রিপুরা বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে এখানে খুব কষ্ট পেতে হয়। এখন কুয়াতেও পানি পাওয়া যায় না।’

লুইংখিয়ান পাড়ার মেথন ত্রিপুরা জানান, পানির জন্য আমাদের প্রচুর কষ্ট করতে হচ্ছে। অনেক পাহাড় ডিঙিয়ে ঝিরি থেকে গিয়ে পানি আনতে হয়।  আগে শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়ের নীচু স্থানে কয়েক হাত বালি মিশ্রিত মাটি খুঁড়লে পরিস্কার ঠান্ডা পানি পাওয়া যেতো। সেসব কুয়া খাবার পানির যোগান দিত। এখন আরো গভীর করে কুয়া খুঁড়লেও পানি পাওয়া যায় না, পানি ওঠে না।

তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ বৃষ্টি পড়ে ততক্ষণ ঝর্ণা, ছড়া প্রাণবন্ত সচল, আর বৃষ্টি নাই তো সব কিছুই অচল শুকনা।’

সাজেক ইউপি মেম্বার জৈপুথাং ত্রিপুরা বলেন, ‘বর্ষাকালে পাহাড় থেকে পানি আসলেও প্রতি বছর গ্রীষ্ম মৌসুমে এখানে পানির সংকট দেখা দেয়। এখানে গ্রামগুলো থেকে প্রায় ২-৩ কিলোমিটার দূরে ছড়ায় গিয়ে দুই তিন ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়।এরপরও ছড়া ঝিরির পানিগুলো বিভিন্ন লতা-পাতা পড়ে নষ্ট হয়ে যায়।ওই পানিগুলো খেলে ডায়রিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের পানিবাহিত রোগ দেখা দেয়।’

ইউপি মেম্বার আরো বলেন, ‘এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হচ্ছে পাড়াগুলোতে যদি একটি করে বড় পানির ট্যাংক করা যায় তাহলে কিছুটা দুর্ভোগ লাঘব হবে।’

সাজেকের  থুইচুই এর ৭নং ওয়ার্ড মেম্বার হীরানন্দ ত্রিপুরা বলেন, ‘সাজেকের পাহাড়ে উচুঁ জায়গায় পানির সমস্যা  প্রকট। এখানে পাথরের কারণে রিং ওয়েল বসানো যায় না।’

এদিকে, সাজেক ইউনিয়ন পরিষদ সচিব বিশ্বজিৎ চক্রবর্ত্তী বলেন, ‘সাজেকের বেশিরভাগ এলাকা দূর্গম । এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থাও অপ্রতুল। এখানে ডিপ টিউবওয়েল বসাতে চাইলেও পাথরের কারণে তা সম্ভব হয় না। এখানকার এ সমস্যা দীর্ঘদিনের।’

সাজেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নেলশন চাকমা বলেন, ‘গত দুই তিন অর্থ বছরে ৩০-৪০টি রিং ওয়েল করেছি। কিন্তু এখানে বেশিরভাগ এলাকা খুবই দুর্গম যার কারণে খাবার পানির সংকট লেগে থাকে। পানির সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নত করতে হবে।’

এদিকে, রাঙামাটির উন্নয়ন কর্মী নুকু চাকমা বলেন, ‘আমরা সবাই জানি সাজেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিখ্যাত।কিন্তু সেখানে বনভূমি উজাড় করে রির্সোট করায় প্রতিনিয়ত পর্যটক যাচ্ছে। যার কারণে এখানের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।এর ফলে খাদ্য সংকট, পানি সংকট দেখা দিচ্ছে।স্বাভাবিক জীবন জীবিকা ব্যাহত হচ্ছে।

পরিবেশ কর্মী অম্লান চাকমা বলেন, ‘একটা সময় ছিলো,যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জীবন আর পাহাড় জুড়ে থাকা শত শত পাহাড়ী ছোট-বড় ঝর্ণা, ছড়া, ঝিরিগুলো ছিলো একে অপরের সাথে পরিপূরক। এখন সময় বদলেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উঞ্চতা বৃদ্ধি, অব্যাহত বৃক্ষ নিধনের প্রভাবে ক্রমশঃ শুকোতে শুকোতে বিলীন হচ্ছে পাহাড়ের অজস্র ছড়া ঝর্ণা ঝিরি।পর্যাপ্ত বৃক্ষ না থাকার কারণে প্রাকৃতিক ঝর্ণা, পাহাড়ি ঝিরির পানির উৎসসমূহ শুকিয়ে গেছে। ফলে সাজেকের বসবাসরত মানুষগুলোর খাবার পানির সংকট চলছে।’

রাঙামাটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে বলেন, ‘সাজেক হচ্ছে সবচেয়ে দুর্গম অঞ্চল।এখানে সত্যিকার অর্থে টিউবওয়েল স্থাপন করা খুবই দুরূহ কাজ। এরপরেও খাবার পানি সংকট নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি যারা আছেন তারা যদি আবেদন করেন তাহলে আমরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট ডিপার্টমেন্ট এর বিশেষজ্ঞ টিম এনে সরেজমিনে পরিদর্শন করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবো।’

বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান হাবিব জিতু বলেন, সাজেকের যেসব এলাকাগুলোতে পানির সংকট আছে এগুলো অনেক দিনের সমস্যা। এ এলাকাগুলো অনেক দুর্গম হওয়াতে এখানে রিং ওয়েল বসানোর মতো সুযোগ নেই।’

তিনি বলেন, ‘এখানে একটি রাবার ড্যাম্প করার জন্য গত মে মাসে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবসহ একটি টিম সাজেকের শিজকছড়া মুখ এলাকা পরিদর্শন করে গেছেন। এটি নিয়ে সাজেকের বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের  সাথে মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। কারণ এখানে এ ড্যাম্পটি করার পক্ষে-বিপক্ষে অনেকে আছেন।’

ইউএনও আরো বলেন, ‘সাজেকে ড্যাম্প যদি বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে পানি সংরক্ষণ করা যাবে এবং এখানকার মানুষ উপকৃত হবে।’

Print Friendly

Related Posts