শেরপুরের মুক্তিযুদ্ধ: স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি মূল্যবান দলিল

আতাতুর্ক কামাল পাশা

 

এ. এ. জাফর ইকবাল

মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। প্রতিটি সেক্টরে নিজস্ব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। এর মধ্যে ১১ নম্বর সেক্টর গঠন করা হয় সবার শেষে।

অবস্থানগত কারণে এই সেক্টরের গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। কারণ, এই সেক্টর দিয়েই মুক্তিবাহিনী মেজর জেনারেল নাগরার নেতৃত্বে সবার আগে ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১১ নম্বর সেক্টর হল সেই সেক্টর যে সেক্টরে নৌ, বিমান ও পদাতিক বাহিনী পরস্পরের সহযোগিতায় যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। এই সেক্টর দিয়েই দেশের বেশ কিছু জওয়ান, শ্রমিক, মেহনতী মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য ট্রেনিং নিতে ভারতে গিয়েছিল। এই সেক্টরেরই একটি থানা শেরপুর।

শেরপুরের প্রায় ১,০০০ বর্গকিলোমিটার ঘন বনাঞ্চল এবং এর পুরোটাই ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন। মুক্তিযুদ্ধের সময় শেরপুর ছিল একটি প্রশাসনিক থানা। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় এটিকে জেলার মর্যাদা দেওয়া হতো। এই জেলার অন্যান্য থানাগুলো ছিল যথাক্রমে নালিতাবাড়ী, নকলা ও শ্রীবরদী। বর্তমানে এই জেলায় রয়েছে পাঁচটি উপজেলা। নতুন উপজেলা হিসেবে সংযুক্ত হয়েছে ঝিনাইগাতি। শেরপুর জেলায় মোট ১১টি পাহাড়ী নদী রয়েছে। এগুলো হলো কংস, হোগাই, কর্ণঝোড়া, চেল্লাখালি, ঝিনাই, দুধদা, মহারশি, মালিধি, সোমেশ্বরী, মিরগী এবং গসানী। শেরপুর জেলার মোট আয়তন ১৩৬৪.৬৭ বর্গকিলোমিটার।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে কোন্ জেলা বা অঞ্চলে শত্রুবাহিনীর সাথে সবচেয়ে বড় ও বেশি সংঘর্ষ হয়েছিল, এ নিয়ে কয়েকটি বিতর্ক রয়েছে। তবে অনেকের মতে শেরপুরে পাকিস্তান বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ছিল। ঘাঁটিটি ভারত বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন। এ সীমান্ত দিয়েই মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে যাতায়াত করত এবং অদূরে ভারতীয় পাহাড়ের পাদদেশে তাদের ট্রেনিং দেয়া হতো। এ ছাড়াও রণকৌশলগত কারণে শেরপুর জেলা মুক্তিবাহিনীদের নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব জরুরি ছিল। তাই তারা পাকিস্তান বাহিনীর ঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য বেশ কয়েকবার এখানে আক্রমণ চালায়। এর মধ্যে কর্ণেল আবু তাহেরই ৫-৬ বার শেরপুরে পাকিস্তান বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করেন।

এই বইটিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণার পর থেকেই শেরপুরের স্বাধীনতা আদায়ের বিভিন্ন কর্মসূচি ও সংগ্রামের প্রস্তুতি, কমিটি গঠন, স্বেচ্ছাসেবক ও মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং থেকে শুরু করে ঢাকায় যৌথবাহিনীর হাতে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমপর্ণ পর্যন্ত শেরপুরের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধে এ অঞ্চলের ও এ অঞ্চলের মানুষের অবদানের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।

পাকিস্তান বাহিনীর শেরপুর দখলের পর স্থানীয় ১২ জন তরুণ ছাত্রলীগ সদস্য প্রথম যে অস্ত্র পরিচালনার জন্য এগিয়ে আসেন, তারপর ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলস্ যোগদান করেন, শেরপুর সীমান্ত ১৮৩তম বিএসএফ ব্যাটেলিয়ানের বাংলাদেশের শ্মরনার্থদের আশ্রয় ও মুক্তিযোদ্ধাদের সবরকম প্রশিক্ষণের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে এই বইতে।

এর পর পাকিস্তান বাহিনীর শেরপুরের কামালপুর বিওপি ঘাঁটিতে, নকশী বিওপি ঘাঁটিতে, ভাওয়াডাংগায়, ঝিনাইগাতিতে, তন্তরের বিভিন্ন এলাকার মুক্তিবাহিনীদের অনেক ভয়াল সংঘর্ষ ও যুদ্ধের নিঁখুত বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে।

পাকিস্তান বাহিনীকে শেরপুর শহরে ঢুকতে বাধা দেয়ার জন্য শেরী ব্রিজ, কাঁটাখালি ব্রিজ, তেনাচিরা ব্রিজ আগুন লাগিয়ে ও গ্রেনেড দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার সেদিনের ইতিহাস এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যেন আজো মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াল দিনগুলো আমাদের মাঝে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো চমকে দেয়।

বইতে এক স্থানে শেরপুর থানা ও শহর আক্রমণের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। “মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ছিল শেরপুর শহর থেকে ১০ কিলেমিটার দূরে ফটিয়ামারি চরে। রাত সাড়ে আট ঘটিকার দিকে নিজেদের অবস্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা যাত্রা শুরু করে। নবীনগর এসে প্রথমে তারা অবস্থান নেয়। রাত বারোটার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা দু’দলে বিভক্ত হয়ে এক দিকে যায় বারো জন অন্য দিকে যায় আট জন। বারো জনের দল শেরপুর নিউমার্কেটের কাছে পুকুরপাড়ে অবস্থান নেয়। দ্বিতীয় আটজনের দল নবীনগর থেকে থানার দিকে অগ্রসর হয়। মুক্তিযোদ্ধারা জানত এ যুদ্ধে তারা জয়ী হতে পারবে না। কিন্তু জনমনে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে অবস্থান তৈরির জন্য একটি আক্রমণ ছিল অত্যন্ত জরুরি।” (পৃ-৯৭)। এমন এবং এর চেয়েও আরো বেশি লোমহর্ষক মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের ঘটনা উল্লেখ আছে বইতে।

বইয়ের দ্বিতীয় অংশে শেরপুরের ১৪ বছর বয়সের মুক্তিযোদ্ধা থেকে বয়োবৃদ্ধ যোদ্ধাদের তালিকা রয়েছে। স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছর শেষে এসে এখনো বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাস এখনো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে। পরিকল্পিত সংগ্রহের অভাবে তা আজ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সে হিসেবে ‘শেরপুরের মুক্তিযুদ্ধ’ বইটি এ. এ. জাফর ইকবালের একটি অনন্য সম্পাদিত বই। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি মূল্যবান দলিল। প্রচ্ছদ ও অলংকরণ ভালো।

শেরপুরের মুক্তিযুদ্ধ
সম্পাদক : এ. এ. জাফর ইকবাল

প্রকাশক:বীর মুক্তিযোদ্ধা মোখলেসুর রহমান আকন্দ
প্রচ্ছদ:মাহবুবুল আলম খান
মূল্য:৭০০ টাকা

Print Friendly

Related Posts