‘দুই তরুণী সেক্সুয়াল পারফরমেন্সে অভ্যস্ত ছিলেন’

রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণ মামলার রায়ে পাঁচ আসামিকেই খালাস

 

রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণ মামলায় আপন জুয়েলার্সের কর্ণধার দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামিকে খালাস দিয়েছেন আদালত।

বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার এ রায় দেন। রায়ে সাফাতসহ পাঁচ আসামিকেই খালাস দেওয়া হয়।

মামলার অপর চার আসামি হলেন-  সাফাত আহমেদের বন্ধু সাদমান সাকিফ, নাঈম আশরাফ ওরফে এইচ এম হালিম, সাফাতের দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন।

আপন জুয়েলার্সের কর্ণধার দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদে বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা দুই তরুণী ‘সেক্সুয়াল পারফরমেন্সে’ অভ্যস্ত ছিলেন। আদালতে চিকিৎসকের দেওয়া মেডিক্যাল রিপোর্টের বরাত দিয়ে রায়ে এ কথা বলা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) দুপুর সোয়া ১টা থেকে দেড় ঘণ্টার বেশি সময় ধরে দেওয়া রায়ে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার রায়ে একথা উল্লেখ করেন।

রায়ের শুরুতেই আদালত বলেন, আপনারা এই মামলাকে আলোচিত বলেন। আমি অবশ্য তেমনটা মনে করি না। আদালতের কাছে সব মামলাই সমান।

এরপর বিচারক একে একে এজাহার, ভুক্তভোগীর জবানবন্দি, সাক্ষীদের জবানবন্দি, মেডিক্যাল রিপোর্ট, আসামিদের ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দির বর্ণনা দেন।

আদালত নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ২২ ধারার বর্ণনা দিয়ে পর্যবেক্ষণে বলেন, মামলার বাদী নিজেকে অবিবাহিত বলে উল্লেখ করেন। তবে তার বয়ফ্রেন্ড আছে এবং তার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে মেলামেশা হতো। অপর ভুক্তভোগী নিজেকে এঙ্গেজড হিসেবে উল্লেখ করেন।

এই মামলায় ২০১৭ সালের ১ জুন আসামিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন ঢাকা মেডিক্যালের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডা. সোহেল মাহমুদ। সেই মেডিক্যাল রিপোর্টে বলা হয়েছে, কোনো ফোর্সফুল সেক্সুয়াল ইন্টাকোর্স (জোরপূর্বক যৌনসঙ্গমের ঘটনা) আলামত পাওয়া যায়নি। তবে তারা যৌনসঙ্গমে অভ্যস্ত।

মেডিক্যাল রিপোর্টের বরাত দিয়ে আদালত বলেন, এতে প্রমাণিত হয় যে, তারা রেগুলার শারীরিক সম্পর্ক পারফর্ম করে। তাই তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। মামলার আসামি সাদমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে ওই দুই তরুণীকে সাফাতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।

সাফাতের সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই মামলা করেছেন মর্মে আদালত অভিমত দেন। রায়ে বলা হয়, ঘটনার পরদিন মামলা হওয়ার আগে থেকেই পিয়াসা থানায় গিয়ে বসেছিল। ভুক্তভোগীরা জানান, পিয়াসা যে সাফাতের সাবেক স্ত্রী একথা তারা জানতেন না। তবে সে সাফাতের সঙ্গে সমঝোতার কথা বলেছিল। পিয়াসা যে সাফাতের সাবেক স্ত্রী একথা তারা পরে জেনেছেন।

সাক্ষীদের জবানবন্দি ও জেরার বর্ণনায় বিচারক বলেন, এই ঘটনায় রাষ্ট্রপক্ষে প্রথম পর্যায়ের পাঁচজন সাক্ষী ছিলেন রেইন্ট্রি হোটেলের কর্মচারী। তারা আদালতে সাক্ষী হিসেবে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, ওইদিন রাতে বিভিন্ন সময়ে তারা হোটেলে ডিউটিরত ছিলেন। তবে সেখানে কোনো ধর্ষণ বা অপ্রীতিকর ঘটনা তারা শোনেননি বা দেখেননি। পরদিন পুলিশ এসে সেখান থেকে কিছু সিসিটিভি ফুটেজ জব্দ করে নিয়ে যায়। এ সময় তারা পুলিশের কাছ থেকেই প্রথম ধর্ষণের ঘটনার কথা জানতে পারেন।

এই মামলায় পাঁচ আসামির চারজন আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূরক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তারা বলেন, ওইদিন রাত ১২টা ৫০ মিনিটে সাফাতের জন্মদিনের কেক দিয়ে যান হোটেলের কর্মচারী। এরপর ওই দুই ভুক্তভোগীসহ (বান্ধবী) আরও কয়েকজন তরুণী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেসময় তারা একত্রে মদপান করেন এবং নাচে মত্ত হন।

সাফাতের দেহরক্ষী রহমত আলী তার জবানবন্দিতে বলেন, তিনি রাত পৌনে তিনটার দিকে রেইন্ট্রি হোটেলের ওই রুমে সাফাত, নাঈম ও দুই তরুণীকে একসঙ্গে শুয়ে থাকতে দেখেন। বিচারক বলেন, একসঙ্গে মদ্যপ অবস্থায় ড্যান্স করলেন, পরে এক বিছানায় চারজন মিলে শুয়ে থাকলেন, এখানে ধর্ষণ কীভাবে হলো? তারা ছিলেন উইলিংলি পার্টনার (স্বেচ্ছায় শয্যাসঙ্গী)। সেখানে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে কিন্তু সেটা ধর্ষণ নয়। আর ওই হোটেলে অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করা যায় না বলে কর্মচারীরা সাক্ষ্যে বলেন। সুতরাং অস্ত্রের মুখে কীভাবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটলো?

আসামিরা ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আত্মপক্ষ সমর্থনে দেওয়া বক্তব্যে বলেছেন, রিমান্ডে নিয়ে পুরুষাঙ্গে ইলেক্ট্রিক শকসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে তাদের স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছে। তাদের ওই ১৬৪ ধারার জবানবন্দি প্রত্যাহারেরও আবেদন করা হয়েছে। পারিপার্শ্বিক বিবেচনায় আমার কাছেও তাই মনে হচ্ছে। তাই ওই ১৬৪ ধারার জবানবন্দিকে এই রায়ে সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করতে পারছি না।

এরপর আদালত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারার ব্যাখ্যা উল্লেখ করে বলেন, যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোনো নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা ষোল বৎসরের কম বয়সের কোনো নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌনসঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।

এখানে ধর্ষণের তিনটি উপাদান উল্লেখ রয়েছে, সম্মতি ব্যতিরেকে, ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলক সম্মতি আদায় কোনোটিই এই মামলায় বিদ্যমান নাই। ঘটনার ৩৮ দিন পর মামলা হলো, চিকিৎসক মেডিক্যাল রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত পাননি মর্মে মতামত দিলেন, ভুক্তভোগীদের পরিধেয় কাপড়ে কোনো পুরুষের সিমেন্সের কণা পাওয়া যায় নাই এবং আসামি নাঈম আশরাফের সঙ্গে ডিএনএ টেস্ট ম্যাচ করে নাই। তারপরও তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) পরিদর্শক ইসমত আরা এমি চার্জশিট দাখিল করে আদালতের পাবলিক টাইম নষ্ট করেছেন। এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধর্ষণ মামলার বিচার ব্যাহত হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা অন্য কোনো পক্ষ কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে এই চার্জশিট দিয়ে মামলাটি বিচারের জন্য পাঠিয়েছেন। আজকের দিনসহ এই মামলায় ৯৪ কার্যদিবস ব্যয় হয়েছে।

আদালত আরও বলেন, ২২/২৩ বছরের একজন লেডি, এক বেডে চারজন একত্রে শুয়েছিল, মদ খেল, ড্যান্স করলো—এটা জেনেও অহেতুক এই প্রতিবেদন দিয়ে কোর্টের টাইম কনজিউম করলো।

আদালত বলেন, ৭২ ঘণ্টার পর মেডিক্যাল টেস্ট করা হলেই ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। তাই ৭২ ঘণ্টার বেশি হলে মামলা না নেওয়ার আদেশ দিচ্ছি। কেননা তাতে মামলা প্রমাণ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। পারিপার্শ্বিক বিবেচনায় এই মামলা সাজা হওয়ার মতো নয়। তাই প্রসিকিউশন এই মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেনি। তাই আসামিদের উক্ত অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হলো।

২০১৭ সালের ২৮ মার্চ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে অস্ত্রের মুখে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ৬ মে বনানী থানায় পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

২০১৮ সালের ৭ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) পরিদর্শক ইসমত আরা এমি পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রটি আদালতে দাখিল করেন। ওই বছরের ১৩ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।

গত ২২ আগস্ট মামলাটিতে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। চার্জশিটভুক্ত ৪৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত। গত ৩ অক্টোবর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত রায়ের তারিখ ১২ অক্টোবর ধার্য করেন। ওই দিন জামিনে থাকা এ মামলার পাঁচ আসামির জামিন বাতিল করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। কিন্তু রায় প্রস্তুত না হওয়ায় তা পিছিয়ে ২৭ অক্টোবর ধার্য করেন আদালত।

এরপর গত ২৭ অক্টোবর প্রবীন আইনজীবী আব্দুল বাসেত মজুমদারের মৃত্যুতে নিম্ন আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। তাই রায়ের তারিখ ফের পিছিয়ে ১১ নভেম্বর ধার্য করা হয়।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts