।। ১৬ নবেম্বর,২০১৫ মতিন বৈরাগীর সত্তরতম জন্মবার্ষিকী ।।
১৯৭৭ সালে প্রকাশিত মতিন বৈরাগীর প্রথম কাব্য ‘বিষণ্ন প্রহরে দ্বিধাহীন’ থেকে সহজেই শনাক্ত করা গেছে যে মতিন বৈরাগী জীবন চেতনার কবি। তার কবিতার মর্মবাণী মানবিক, সমাজ মুক্তির। মতিন বৈরাগী সুস্পষ্ট ভাষায় তার কবিতার উচ্চারণে দ্বিধাহীন ও জীবন বাস্তবতায় নান্দনিক কবিতা রচনার প্রতি প্রবল ভাবে লগ্ন।
১
মোহময় জীবনের সমস্ত কালভার্ট ভেঙে দিয়ে
হে জীবন হে কবিতা আলোর দিকে ফিরে যাব আমরা
২
দক্ষ নিপুণ হাত ক্রমশই ভেঙে দিচ্ছে
অসুস্থ শিল্পকলা
আসন্ন ঝড়ের উঙ্গিত এখন প্রত্যেক ঘরে ঘরে
তারপর থেকে বৈরাগীর অগ্রযাত্রা থেমে থাকেনি। কোনো ভাবেই মতিন বৈরাগী মানুষের জীবনের প্রতি তার অগ্রযাত্রার নিশ্চিতির প্রতি বিশ্বাস হারাননি। অকপটে সেই সব কথা বলে গেছেন অনবরত যা আগামী বসন্তের ফুল। বর্তমান কঠিন হলেও জীবনের প্রতি অবিশ্বস্ত হলেও নতুন প্রজন্মে নতুন জীবনের সূত্রপাত হবে সে বিষয়ে কবির কোন দ্বিধা ছিল না। অতএব মানুষের জীবনের জন্য চলমান যুদ্ধই তার কবিতা। ‘কাছের মানুষ পাশের বাড়ি’ কাব্যগ্রন্থে ও এরকম উচ্চারণ ছড়িয়ে রয়েছে।
১
জীবনের ক্ষোভগুলো ক্রমশই বিক্ষোভ ঢেলে দেবে
অপ্রতিরোধ্য রক্ত জোয়ার
২
পূবালি হওয়ায় ডেকে ওঠে নদী ফুসে ওঠে জল
জীবন মানেই ক্রমাগত যুদ্ধ যুদ্ধের ফলাফল
এমন অনেক পাঙক্তি জীবন কে জানতে চিনতে নিশ্চিতি দেয়। মতিন বৈরাগীর জীবনবাদী এই সব কবিতা প্রমাণ করে তার যাপিত জীবন এবং জীবনের মৌলিক স্বপ্ন যা স্পষ্ট ও রূপময়।
খরায় পীড়িত স্বদেশ কাব্য
১
আজকে মিছিল কালকে মিছিল মিছিল জীবন পন
গণবিপ্লবের মিছিল এবার চলবেই আমরন
২
বাপ তোর একদিন আসবে ফিরে প্রগতির রেলে
আশা অনন্ত হে কাব্য
১
তিনি বললেন বিপ্লবের জন্য মানুষ চাই
চাই শ্রেনিস্বার্থহীন সুপুরুষ
জনগণকে জানাচাই তাদেও বিশ্বাসের ভাষায়
চাই বিপ্লবী সংস্কৃতি
২
যতোই ভাঙুক
ভাঙতে ভাঙতে বিশ্বজুড়ে আবার মিলবে মানুষ
বেদনার বনভূমি
১
বিষণ্ন পাইনের মতো নুয়ে পড়ছে মানুষ
মানুষের ভালোবাসা সাহস কাঙখিত স্বাধীনতা
২
বিপুল ওজন তলে পিষ্ট হও
তবু তুমি নত হয়ো না
মতিন বৈরাগীর এই সব উচ্চারিত পঙক্তিমালা থেকে স্পষ্টতই তাকে চিনে নেয়া যায় [ যা আমি আগে উল্লেখ করেছি]। তিনি সচেতন জীবনবাদী কবি, গণমানুষের কবি। দীর্ঘ কাব্য ‘অন্তিমের আনন্দ ধ্বনিতে’ দুজনের কথোপকথনের মধ্যদিয়ে সমাজ রাজনীতি বিশ্বাস অবিশ্বাস যা কিছুর কাব্যরূপ সবটুকুই তার চেতনার মৌলিক। মানুষের জীবন বোধের প্রতি অবিচল থেকে মতিন বৈরাগী তার কাব্য যাত্রা অব্যাহত রেখেছেন আজও তার নতুন কবিতাগুলোয় রয়েছে অন্যরকম এক কাব্য নির্মাণে। কিন্তু তিনি প্রগতিবাদীতার বিশ্বাসে রয়ে গেছেন নিরলস।
চল্লিশের প্রগতি চিন্তায় বাংলা কাব্যে যে ধারাবাহিকতায় বিষ্ণুদে. সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ যে ধারার সূত্রপাত করেছিলেন ৪৭ পরবর্তি কবি আহসান হাবীব. হাসান হাফিজ, কবি আহমদ রফিক প্রমূখের কবিতায়। সেই ধারাবাহিকতায় তার উজ্জ্বল এবং পরবর্তিতে ইন্দুসাহা, সমুদ্রগুপ্ত, মুনীর সিরাজ, মতিন বৈরাগী, কাজী মনজুর উন্মেষ সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ-এর নিয়মিত আডডায় সেই চেতনাকেই ধারণ করে কাব্য নির্মাণে সচেষ্ট থেকেছেন। মতিন বৈরাগীর প্রেমের কবিতাও নিতান্ত কম নয় তবে সে খানেও তিনি সচেতন ভাবে নান্দনিকতার উৎকর্ষকে উর্দ্ধে রেখে প্রেম যে জীবনের, জীবন যে প্রেমের এমন প্রতীতি থেকে বিচ্যুত হননি।
যে কথাটি হয়নি বলা
হৃদয় কুসুম ফুলে
আসবো ফিরে তোমার কাছে
সকল দুঃখ ভুলে
এমনি সহজ সরল তার বয়ান। তিনি কবিতাকে অযথা দুর্বোধ্য করে তোলেননি কিংবা দয়িত দয়িতার চিরকালীন আবেগকে অশ্লিল শব্দ ভঙি দিয়ে অপসংস্কৃতিকে প্রশ্রয়ও দেন নি। সরল ভাষ্যে বাঙময় করেছেন তার অভিব্যক্তি। দীর্ঘ ৪ দশকের বেশি সময় জুড়ে এ ভাবেই কবির কাব্যের বিস্তার তার স্বপ্নের মানুষ সমাজ একদিন ঋদ্ধ হবে এটা আশা করা যায়।