অনুপম রহমান ।। বরেণ্য কবি আল মাহমুদ বলেছেন, কবিতা কষ্টের কলা। সেই কষ্ট কি তা জানতে হলে কবির মধ্যে কবিতার মধ্যে প্রবিষ্ট হতে হয়। একজন কবি কি ভাবেন, তার চৈতন্যে কোন স্বপ্নের বসবাস- তা বুঝতে হলে তার কাবিতাসাগরে অবগাহন জরুরি। এ অবগোহন যতোটা গভীর হবে ততটাই উদ্ভাসিত হবে কবির স্বরূপ।
কবি রুনু আঞ্জুমান। তারুন্যের অহংকার এই কবিপ্রতিভা স্বপ্ন দেখেন আগামীর। হিংসা, হানাহানি, ঈর্ষা, আর নোংড়ামীর বিপরীতে যেখানে ছড়িয়ে থাকবে প্রেম আর সহমর্মিতা। যা গীতিময় হবে সুর আর ছন্দে, আলোময় হবে হৃদ-আনন্দে। কুয়াশা চাদরে ভিজে কবিতার মুখ খুঁজে ফেরা এ কবি বৈশাখে গোছানো সুখে অপেক্ষার ডানা মেলে অনন্ত শব্দাকাশে ভেসে বেড়ান। কবি রুনু আঞ্জুমান আক্ষরিক অর্থেই যে একজন কবি তার প্রায় প্রতিটি কবিতায় মূর্তমান।
সাগরের বুকে শত উর্মি ছুঁয়ে যাওয়া কবি শুধু স্বপ্নাক্রান্ত নন তিনি একজন চরম ও পরম বাস্তববাদীও। সুখের পাশাপাশি কষ্টচাদরে নিজেকে আড়াল করে নিতে যেন এতোটুকু কার্পণ্য নেই তার।
‘ব্যথার সাগরে যদি সময় ভাসিয়ে দাও তবে-
শ্রাবণ কান্নার মাঝে বৃষ্টি স্থির হবে
তাই এসো আজ, এসো শ্রাবণজল, বৃষ্টির মাঝে’
(শ্রাবণ জল)
বৃষ্টির মাঝে ক্রমাগত কষ্টকে আমন্ত্রণকারি কবি সৃষ্টির আনন্দে মেতে থাকলেও তার মধ্যে বিরাজিত এক গভীর শূন্যতা। একাকি এক ভূমন্ডলের বাসিন্দা কবি কষ্টের শেকলে নিজেকে আবদ্ধ করে এগিয়ে চলেন একা ক্রমাগত এক অন্ধকারের দিকে। অবহেলা আর অভিমানকে বুকে ধারন করে ভেঙ্গে পড়েন তীব্র আর্তনাদে-
‘পৃথিবীর সর্বএকা আমাকে করছে যেন গ্রাস
রাজপথ সেও একা শুধুই রাত্রির-
কারণে পেয়েছে অবহেলা
বাকিটা সময় তার বুকে শুধু পথচারী-খেলা
আমার কিছুই নেই আছে কাঁটাতার কষ্টের শেকল মালা
শরীরের অবয়বে শর্তে শর্তে বাঁধা’
(কষ্টের শেকল)
সহস্র যুদ্ধের মাঝেও সাবলীল রুনু আঞ্জুমান জীবন্ত প্রাসাদে স্থির হয়ে স্বপ্ন দেখেন নিবিড় ঘাসের। দুগ্ধ মাখা শিশির শরীরে নতুন প্রভাত আবিস্কারের নিরন্তর চেষ্টা যেন তার একান্ত কর্মেরই অংশ।
রুনু আঞ্জুমান যেমন অনাবিল আলোময় আগামীর প্রত্যাশি তেমনি তিনি অতীত আশ্রীতও। তার অতীত তাকে কাঁদিয়ে যায়- স্থবির আঁচলে মোড়া ঘনঘোর বর্ষায় তিনি হয়ে ওঠেন ছায়াময় ধূসর।
‘অতীত আবারো কাঁদে সময়ের বুকে
ছিল বুঝি-কেউ ছিল অথবা কখনো ভেজা সুখে’
(অতীত আবারো কাঁদে)
অপেক্ষার দৃষ্টিপাতা সময়ে শব্দবৃষ্টির আকাংখায় অনাগত দিনের দিকে ধাবমান রুনু আঞ্জুমান আশাভূমিতে বপন করতে চান মেঘবীজ। সুখবৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হারিয়ে যেতে চান শব্দ অরণ্যে-যেখানে শুধুই কবিতা-কাব্য বসবাস।
“টেবিলের কম্পনেই জাগে অভিমান শব্দদৃষ্টি
স্পর্শেই ঝরবে যেন অঝোর ধারার সুখবৃষ্টি”
(দুটি হাত)
শত কষ্ট শত বেদনাকে বুকে ধারণ করে শুধুমাত্র কবিতা- সুধা পানের জন্য অসীম আগ্রহে অপেক্ষমান রুনু আঞ্জুমান সৃষ্টিপিয়াসী। নির্ঘুম বিলাসী স্বপ্ন তাকে নিয়ে যায় অন্যলোকে। বিমূর্ত চেতনায় তার যেন শুধু শব্দ নিঃশ্বাস- যা তার একান্ত বিশ্বাস থেকে সৃষ্ট, ক্রমাগত আলোময় ধ্বণিময়।
“লালিত ভাবনা তার ফেলে যে নিঃশ্বাস
আধোজাগা আধোঘুমে প্রতিটি বিশ্বাস”
(আকাশ উপুড় হয়ে দেখে)
শব্দ ক্ষুধার্ত কবি রুনু আঞ্জুমান প্রকৃতি প্রেমিক, গভীর ঈশ্বরাক্রান্ত এবং প্রতিবাদী। যেখানেই অন্যায় সেখানেই তার স্বশব্দ প্রতিবাদ। কোমলে কঠোরে মেশানো এই অভিমানী কবিসত্ত্বা নিজেকে মেলে ধরেছেন আলোচিত গ্রন্থে। গ্রন্থভূক্ত কবিতাগুলোর ছত্রে ছত্রে যেমন উচ্চারিত সত্য ও সুন্দর তেমনি প্রকাশিত দ্রোহ ও ক্ষোভ। “পাখিবউ মধুবর” যেন কোমলে কঠোরে মেশানো এক প্রেমময় কবিসত্ত্বার গোপন গভীর উচ্চারণ। তার অন্তরে কবিতা এবং প্রচ্ছদেও কবিতা। কবিতাবরণে ঢাকা এক আবক্ষ কবিতা রমণীর মায়া উচ্চারণে যেন মোহিত সমগ্র সময়।
“অবাক দৃষ্টিতে দেখি তোমার তুমিকে
শব্দের ভেলায় তুমি চলেছো শব্দের নদী বুকে,
(শব্দ ক্ষুধার্ত কবি)
রুনু আঞ্জুমান সময়ের কবি সম্ভাবনার কবি। ১৮ নভেম্বর এ কবির জম্মদিন । তারুন্যের অহংকার রুনু আঞ্জুমানের জম্মদিনে শত সহস্র শুভেচ্ছা।