।। মানে ‘ট্রেনিং অ্যান্ড প্লেসমেন্ট অফিসার’। মফস্সলে গজিয়ে ওঠা এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, সেখানে স্টুডেন্টদের নামী কোম্পানিতে ‘প্লেস’ করে দিতে হবে! পারলে ফ্লাইং কিস, না পারলে জুতোর মালা!।।
এই নামের আগে পিছে আরও অনেক অক্ষর জুড়ে আমায় ডাকা হয়। সব মেনে নিয়েছি। মেনে নিতে হয়। শর্বরীর ফ্লাইং কিস যেমন দখিনা বাতাসের মতো গায়ে মেখেছি, ঠিক তেমনই ঢোক গেলার মতো করে গিলেছি কলেজে ঢোকার মুখে আমার ছবিতে ঝোলানো হাওয়াই চটির মালা। মেনে নিতে হয়। কোম্পানি আসার খবরে আমার টেবিলের উপরে যেমন
দেখেছি ফুলের তোড়া, ঠিক তেমনই একটাও রিক্রুট না করে কোম্পানি চলে যাওয়ার পরে সেই একই জায়গায় ছড়িয়ে থাকতে দেখেছি সাপের ঘুম ভাঙানো তেলের খালি বাক্স। মেনে নিতে হয়। প্রতিবাদের উত্তর যদি ‘ঘেরাও’ হয়ে আমায় ঘিরে ধরে ফের!
আমি অনিল সাহা। টি.পি.ও। মানে ট্রেনিং অ্যান্ড প্লেসমেন্ট অফিসার। ফ্লাইহাই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। স্টেশন বসিরহাট। বারুইপুর থেকে রোজ যাতায়াতের ঝক্কিটা গত পাঁচ বছরে অনেকটাই গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। ফ্লাইহাইয়ের জন্ম থেকেই আছি। আর আমাদের ডিরেক্টর স্যরের মতো করিতকর্মা মানুষ এই দুনিয়ায় ক’টা আছেন! ক’জন ডিরেক্টর কলেজের ভিতপুজোর পাঁচ মাসের মাথায় ছাত্র ভর্তি করিয়ে নিতে পারেন! ল্যাবরেটরি-ট্যাবরেটরি না হয় পরেই তৈরি হবে। অ্যাডমিশনটা তো আগে হোক। ডিরেক্টর স্যর বলেন, ক্যাশ ফ্লো হল সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট।
শিয়ালদা থেকে বসিরহাট লোকালে আমার সঙ্গে কলেজের তিনটে ছাত্র আর দুটো ছাত্রী আসে। আমায় দেখলে সিট ছেড়ে দেয়। আমায় বসতে দিয়ে বলে, স্যর প্লেসমেন্ট হবে তো স্যর, প্লেসমেন্ট? আমি বলি, চেষ্টা তো করছি ভাই। ওরা বলে, স্যর পাঁচ লাখ প্যাকেজ হবে তো স্যর, পাঁচ লাখ? আমি বলি, জীবন তো শুরু করছ তোমরা। এখনই এত টাকার কথা ভাবো কেন? ওরা বলে, স্যর পয়সাটা তো আপনার বাবা দেয় না। আমার বাবা দেয়। ছ’লাখ টাকা খরচ করছি। পাঁচ লাখ টাকা পার অ্যানাম না হলে রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট কী হবে স্যর? আগে বুঝতাম না, এখন বুঝি, সিট ছেড়ে দেওয়ার সম্মানটার মধ্যেও কোথাও যেন স্টার দিয়ে ছোট ছোট হরফে ‘কন্ডিশনস অ্যাপ্লাই’ কথাটা লেখা থাকে।
পাঁচ লাখ টাকার স্বপ্ন দেখাই। মাসের শেষে বারো হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরি। আমার বাবার ছ’লাখ ছিল না। তাই আমি বি.কম পাশ। যাদের বাবার ছ’লাখ আছে, তারা জয়েন্টে পঞ্চাশ হাজার র্যাংক করেও দিব্যি বি.টেক হয়ে যায়। জয়েন্ট দিলেই র্যাংক। আর র্যাংক হলেই কোনও না কোনও কলেজে সিট জুটে যায় ঠিক। কপাল যাদের খোলে, তারা দু’বছর সেক্টর ফাইভে কোনও রকমে ঘষে-মেজেই নায়াগ্রার সামনে ফোটো তুলে পোস্ট করে। বড়দিনে শূন্য ডিগ্রিতে টার্কি আর ওয়াইন খেয়ে ক্যাপশন দেয় ‘ইয়ামি’। আর ফ্লাইহাইয়ের ছাত্রদের এই ইয়ামি বলতে পারানোর দায়ভার এই টিপিও-র।
তবে মুশকিল হল, আইটি পড়া ভাইটি যেমন আইটি ফার্মে চাকরি করতে চায়, ঠিক তেমনই মেকানিকাল, বায়োটেকনোলজি, ফুড টেকনোলজির ছাত্ররাও বলে, আইটি ফার্মে ঢুকিয়ে দিন স্যর। কারণ, টাকা বেশি। একটা এক্সেপশনের কথা বলি। ফুড টেকনোলজির ফাইনাল ইয়ারে উঠে প্রশান্ত মণ্ডল নামে এক ছাত্র বলল, আমার কোর কোম্পানিতে চাকরির ব্যবস্থা করে দিন স্যর। আইটি মানে ওবামার গোলামি। নানা রঙের ফিতে গলায় ঝুলিয়ে বারকোড লাগানো ক্রীতদাস। আংকল ওবামা’স কেবিনে হাম নেহি যায়েঙ্গে। দেশে আমাদের কত ফসল নষ্ট হয়। আমি খাবারদাবারই প্রসেস করব। টাকা কম হলে হোক।
বিলবোর্ড আর প্ল্যাকার্ড দেখে নম্বর জোগাড় করে, কলকাতার এক গুঁড়ো মশলার কোম্পানিকে ক্যাম্পাসিংয়ে ডাকলাম। খাবারদাবারের কোম্পানির নাম-ঠিকানা ইয়েলো পেজেস-এ থাকে হাতে গোনা। ইন্টারভিউ’তে কলেজের তরফ থেকে আমিও ছিলাম, তবে জাস্ট দর্শক হিসেবে। কোন প্রিজারভেটিভে কোন খাবার কত দিন তাজা থাকে, এ সব বলার পরে মশলা-কোম্পানির লোক প্রশান্তকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কত টাকা এক্সপেক্ট করো? প্রশান্ত বলল, বি.টেক করেছি স্যর। পনেরো হাজার টাকা মিনিমাম না পেলে কি প্রেস্টিজ থাকবে! আইটিতে তো পঁচিশ হাজার টাকা স্টার্টিং। শুনে মশলা কোম্পানির তো বিষম খাওয়ার জোগাড়। বলল, ভাই রে! আমাদের কোম্পানির জিএম মাসে পায় তেরো হাজার পাঁচশো। প্রশান্ত তখন খেপে গিয়ে বলল, শালা এমন কোম্পানির জিএম থাকারই কোনও দরকার নাই। ইন্টারভিউ ক্যানসেল। আর প্রশান্ত সে দিন কলেজ থেকে বেরিয়ে আমায় বাপ তুলে খিস্তি দেয়। মুখে মদের গন্ধ ছিল। আর বারবার বলছিল, নিজের সাবজেক্টটাকে ভালবেসে যেচে বাঁশ নিলাম। শালা সব ফসল পুড়ে যাক। সব আলুচাষি পচে মরুক।
ডিরেক্টর স্যরের অ্যাটাচিতে বছরে ছ’লাখ ইনটু ছ’শো স্টুডেন্ট। বলেছেন, সামনের বছরে সিট সাড়ে ছ’শো করার কথাবার্তা চলছে। এ দিকে একের পর এক আইটি কোম্পানি জমি না পেয়ে আমাদের রাজ্য থেকে পালিয়ে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচছে। রাজারহাটে জমি-জটের বলি হয়ে ইনফোসিস্টেম ইন্টারন্যাশনাল যে দিন সরকারের কাছে পিছিয়ে আসার প্রস্তাব দেয়, সে দিন আমার গা গুলোচ্ছিল। খবরটার বাইশ পয়েন্টের হেডলাইন থেকে হ্রস্ব ই-কারগুলো আঁকশির মতো চেপে ধরছিল আমার গলাটা। দু’মাসের মধ্যেই ফ্লাইহাইয়ে ক্যাম্পাসিংয়ে আসার কথা ছিল ওই কোম্পানির। ৬০-৭০ জনের চাকরি হওয়ার কথা ছিল চোখ বুজে। আমি পারলাম না। কোম্পানিকে বললাম, কথা দিয়েছিলেন, প্লিজ এক বার আমাদের স্টুডেন্টদের নিয়ে দেখুন স্যর। ওরা ফোন রেখে দিল। কলটা কেটে দেওয়ার সময় ও-প্রান্ত থেকে শুনতে পেয়েছিলাম, ডিজগাস্টিং স্টেট। ক্যাম্পাসিং বাতিল হওয়ার খবরটা সে দিন ছাত্রদের মিনমিন করে জানাই। পরের দিন কলেজের গেটে আমার ছবিতে জুতোর মালা পড়েছিল।
অথচ জয়েন করার পর পর এমনটা ছিল না। শর্বরীর কথা মনে পড়ে। ইলেকট্রনিক্স। প্রথম ব্যাচ। থার্ড ইয়ারে ওঠার পর থেকেই আমার কেবিনে আসত। বারবার আসত। দরকারে অদরকারে। পরে অদরকারে আসাটা বাড়তে থাকে। আমার শর্বরীকে বেশ লাগত। স্মার্ট। মার্জিত। ওরও হয়তো আমাকে তেমন মন্দ লাগত না। না হলে কেনই বা বলত, ছুটির পরে একসঙ্গে চা খেতে যাবেন অনিলদা! ধ্যাড়ধেড়ে বসিরহাটে ‘কাফে কফি ডে’ ছিল না। থাকলেও বারো হাজারে ওই কফি হয় না। যাই হোক, শর্বরীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। এক মেঘলা বিকেলে রফিকুলের চায়ের দোকানের পিছনে যখন প্রথম চুমু খাওয়ার পারমিশন দিয়েছিল শর্বরী, ঠোঁটে ঠোঁট লাগানোর এক ন্যানোসেকেন্ড আগে বলেছিল, প্লেসমেন্টটা ঠিকঠাক হয়ে যাবে তো অনিলদা! বলেছিলাম, শর্বরী, আর কারও না হলেও তোমারটা করার চেষ্টা করব। মা কালীর দিব্যি। তার পরেই ‘কন্ডিশনস অ্যাপ্লাই’ একটা ডিফ্রস্ট চুমু খেয়েছিলাম।
যাক গে যাক, তবু চুমু তো! এর বছরখানেক পরে যখন প্রথম কোনও কোম্পানিকে অনেক বলেকয়ে আমাদের কলেজে ক্যাম্পাসিংয়ে আনতে পেরেছিলাম, ভিতর থেকে চেয়েছিলাম চাকরিটা ওর হয়ে যাক। কোম্পানির এইচআর’কে বলেছিলাম,শর্বরী মুখোপাধ্যায় খুব ডিজার্ভিং ক্যান্ডিডেট। ওকে কনসিডার করবেন প্লিজ। শর্বরীর চাকরিটা হয়ে গিয়েছিল। খবরটা পাওয়ার পরে ও লাঞ্চ ব্রেকে কলেজ ক্যান্টিনে সবার সামনে আমায় ওপেন কিস দেয়। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা হাতে পেয়ে অবশ্য বলেছিল, তোমায় হয়তো ভালই লাইক করি অনিলদা। কিন্তু আমাদের আর না এগোনোই বেটার। বাবা আইআইটি ছাড়া কাউকে মেনে নেবে না। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি? শর্বরী ডায়েট কোকে চুমুক দিতে দিতে বলেছিল, আমায় তুমি ভুলে যেয়ো অনিলদা।
মে মাসে আবার একটা ব্যাচ বেরোবে। ২০০ জনের মধ্যে মাত্র ৩০ জনের চাকরি করে দিতে পেরেছি এ পর্যন্ত। ফাইনাল ইয়ার আমায় দেখলেই বাপ-বাপান্ত করে। খেতে গিয়ে জিভে কামড় পড়ে প্রায়ই। মা বলে, জিভে কামড় পড়া মানে কেউ নাম করছে। নাম করার মাহাত্ম্য আমি হাড়ে হাড়ে টের পাই। গত মাসে আমায় এক রাত ঘেরাও করে রেখেছিল। বাথরুমে যেতে দেয়নি। জল খেতে দেয়নি। বলছিল, চাকরির ব্যবস্থা করে বেরোবেন স্যর। ছ’লাখ টাকা আপনাদের ফুর্তির জন্য দেওয়া হয়নি। রাত সাড়ে দশটার সময় ডিরেক্টর স্যরকে অসহায় হয়ে ফোন করে বলি, আমায় বাঁচান স্যর। স্যর জড়ানো গলায় কী একটা বলার চেষ্টা করলেন। ঠিকঠাক বলে উঠতে পারলেন না। পরের দিন স্যর বিএমডব্লিউ থেকে নেমে আমায় বলেছিলেন, স্কাউন্ড্রেল, ডোন্ট প্লে উইদ মাই রেপুটেশন।
আমার বারো হাজারটা চোদ্দো হাজার করার স্বপ্ন আপাতত মর্গে শুয়ে থাকে। নেতারা বিদেশে শিল্প আনতে গেলে আমি রক্তখোঁজা অ্যানিমিক রোগীর মতো টিভি দেখি। কলকাতায় ইন্ডাস্ট্রি সামিট হলে বারুইপুর লোকালে ব্যবসার খবরের কাগজের এক কপি আমার কাছেই বিক্রি হয়। পাশে বসা লোকগুলো যখন নায়িকাদের পেট দেখে, তখন আমি দু’চোখ দিয়ে শুষতে থাকি শিল্পমন্ত্রী কী বললেন। নবান্নের নেতার সঙ্গে টলিউডের নেতার ছবি ছাপা হয় ছবির মতো লোকেশনে। শিল্প আসে না।
যারা আসবে বলেছিল, তারাও চলে যায়।
আর রাস্তার মোড়ে বিশাল বড় প্ল্যাকার্ডে আরও বিশাল বড় এক নেতা একের পিছনে অনেকগুলো শূন্য লাগিয়ে কাজের খতিয়ান দেয়।
বি.টেকরা দলা পাকাতে থাকে ক্রমশ।
amlankusum@gmail.com