রিশার শেষযাত্রা ও মায়ের বিলাপ

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ‘ও তো আমার বড় আদরের বাচ্চা। বড় মাইয়্যা। ওরে আমি খুব যত্নে পালছি। শরীরে একটা দাগও ছিল না। আমার এতটুকুন বাচ্চারে কী করল? আমি এখন কেমনে বাঁচমু?’ মা তানিয়া হোসেন বলেই যাচ্ছেন, ‘আমার বাচ্চা আমারে বইল্যা গেছে, টেইলার্সের কর্মচারী ওর শরীরে ব্যথা দিছে।’ বলেই চিৎকার। চিৎকার থামলেও একটু পরপর বলছিলেন, ‘আমি এখন কেমনে সহ্য করমু। আমার ১৪ বছরের বাচ্চা। ডায়াবেটিসে আমার অবস্থা কাহিল হইলে আমার মাইয়্যা আমারে আদর করত। বলত, চিন্তা কইরো না। আমি তোমারে দেইখ্যা রাখমু। এখন আমারে কে দেইখ্যা রাখব?’

তানিয়া হোসেনের মেয়ে সুরাইয়া আক্তার (রিশা) দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে গতকাল রোববার সকালে মারা গেছে। সে ছিল রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

গতকাল দুপুরে পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারের বাসায় সুরাইয়ার মা তানিয়া হোসেনকে যাঁরা সান্ত্বনা দিতে এসেছেন, তাঁরাও কাঁদছেন। এক আত্মীয় বললেন, টেলিভিশনে রিশার খবর দেখাচ্ছে। মা তানিয়া হোসেন আধশোয়া হয়ে বসে ছিলেন। টেলিভিশনে রিশার খবরের কথা শুনে আবার অস্থির হয়ে পড়লেন। বললেন, ‘আমি আমার মাইয়্যারে দেখমু। আমি দেখমু।’

বিকেল পৌনে চারটার দিকে বাসার নিচে শোরগোল। মর্গ থেকে স্কুল হয়ে নিথর সুরাইয়া বাড়ি এসেছে। তখন কয়েকজন মিলেও তানিয়াকে আটকে রাখতে পারছিলেন না। সুরাইয়ার দুই মামি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে সুরাইয়ার লাশের গোসল দিয়েছেন। তাঁরা বাসায় ফিরে অন্যদের কাছে রিশার কথা বলছিলেন। তখন মা তানিয়া আবার উত্তেজিত হয়ে পড়লেন, ‘ওকে ভালো করে গোসল করাইছ তো, সুন্দর শরীরে ময়লা রাইখ্যা দেও নাই তো?’

গত বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পরীক্ষা শেষে স্কুল থেকে বেরিয়ে সুরাইয়া রাস্তার ওপারে যাওয়ার জন্য পদচারী-সেতুতে ওঠে। এর মাঝামাঝি পৌঁছালে এক যুবক তাকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। সুরাইয়ার চিৎকারে স্কুলের শিক্ষার্থীরা ও কয়েকজন অভিভাবক ছুটে আসেন। এরপর তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

তানিয়া কয়েক দিন ধরে হাসপাতালে মেয়ের সঙ্গেই ছিলেন। মেয়ে মারা যাওয়ার পর আত্মীয়রা তাঁকে বাসায় রেখে আসেন। সুরাইয়ার চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া ভাই রবি হোসেন ও প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া রোদেলা আক্তার বাসায় মলিন মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাসার সর্বত্র সুরাইয়ার স্মৃতি। তার ঘরে টেবিলে বইপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ড্রয়িং খাতায় গ্রীষ্মকাল, গরুর গাড়িসহ বিভিন্ন ছবি এঁকেছে সুরাইয়া। আরেক ঘরের দেয়ালে সুরাইয়ার ছোটবেলার ছবি।

বাবা রমজান হোসেন একটু পরপর মেয়ের নানান স্মৃতি মনে করছিলেন। পকেট থেকে বের করলেন একটি পিৎজা কেনার রসিদ। এই তো সেদিন মেয়ে নিজে পিৎজার অর্ডার দিল। মেয়ে দোকানে বসে খাবে জানাল। মজা করে খাওয়ার পর বাবাকে ধন্যবাদও দিল।

স্ত্রীর অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মাত্র দুই মাস আগে ছোট ছেলে-মেয়ের স্কুলে আসা-যাওয়ার জন্য ভ্যান ঠিক করেন রমজান হোসেন। আর সুরাইয়া ভ্যানে যাতায়াত করছিল ঘটনা ঘটার মাত্র ১০ দিন আগে থেকে। এর মধ্যে ভ্যানে করে যাতায়াত করে মাত্র চার দিন। আর এর মধ্যেই সব শেষ।

ক্যাবল অপারেটর ব্যবসায়ী রমজান হোসেন মুঠোফোনে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) অচেতন মেয়ের মুখে অনেকগুলো নল লাগানো ছবি দেখালেন। তারপর মুঠোফোনে দেখালেন বৈশাখী টেইলার্সের কর্মচারী ওবায়দুল খানের ছবি। ছবিটি ওবায়দুল খানের ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করেছেন। বললেন, ‘আমি আমার মেয়ে হত্যার বিচার চাই। হত্যাকারীর ফাঁসি চাই।’ জানালেন, গত শুক্রবার মেয়ের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছে। বললেন, ‘মেয়ে হাতটি বাড়িয়ে দিল। ধরলাম। বললাম, ভয় পেয়ো না, আমরা আছি।’ এই বলে রমজান হোসেন নিজের হাত দুটো মুঠো করে ধরলেন। মনে হলো, তিনি মেয়ের স্পর্শটুকু অনুভব করলেন।

সুরাইয়ার দুই মামি ময়নাতদন্ত শেষে মর্গের পাশের একটি কক্ষে সুরাইয়ার লাশের গোসলে সহায়তা করেন। এক মামি পরে বলেন, ‘জন্মের পর মেডিকেল থেইক্যা কোলে করে আমিই মেয়েরে প্রথম আনছিলাম এইটা দেখনের লাইগ্যা? মেয়ের পিঠে ছিদ্র, এই দিকে ছিদ্র, ওই দিকে ছিদ্র। সারা শরীর ঝাঁঝরা কইরা দিছে। শরীর এপার-ওপার কইরা দিছে।’

মর্গে সুরাইয়ার লাশ যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের বন্ধু, বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা আসতে থাকেন। সুরাইয়ার লাশ দেখে একেকজন কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানেও বন্ধু ও অন্য শিক্ষার্থীরা দাবি তোলে—সুরাইয়া হত্যার বিচার চাই।

মর্গের সামনে সুরাইয়ার মামা সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমার বোন তানিয়ার যখন মাত্র তিন মাস বয়স, তখন আমার মা মারা যান। এখন আমার বোনের মেয়েটাকেও মেরে ফেলল। আমরা আসামির কঠোর শাস্তি চাই। আর কোনো মেয়েকে যেন এভাবে মরতে না হয়।’

Print Friendly

Related Posts