মো. মামুন চৌধুরী, হবিগঞ্জ ।। কচুরিপানা ব্যবহারে উপকৃত হবিগঞ্জের হাওর এলাকার লাখো চাষি। এই জেলার বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে হাওর। বছরের প্রায় ৮ মাসই পানি থাকে এই হাওরে। পানির নিচে মাছ। আর উপরে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয় কচুরিপানা।
এক সময় তেমন কোন কাজে আসত না, এখন হাওরবাসীর জন্য বড় উপকারী হয়ে দাঁড়িয়েছে এই কচুরিপানা। হাওরের কৃষকরা ঘরে তোলেন এক ফসল (বোরো ধান)। কৃষকরা প্রায় সকলেই গরু পালন করেন। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে গো-খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এ সময় কৃষকরা বিপাকে পড়েন। কৃষকরা বাধ্য হয়ে অন্যস্থান থেকে গো-খাদ্য অধিকমূল্যে ক্রয় করে নিয়ে আসতে হতো। এখন তারা গো-খাদ্য হিসেবে আবিস্কার করেছেন কচুরিপানা। কৃষকরা বিনামূল্যে গো-খাদ্য পাচ্ছেন। হাওরে প্রাকৃতিকভাবে কচুরিপানা জন্ম নিচ্ছে।
কচুরিপানা শুধু গরুর খাবার হিসেবেই ব্যবহার হয় না, শুকনো কচুরিপানা জ্বালানী হিসেবেও ব্যবহার হয়। তার চেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, এ পানা দিয়ে সার তৈরি করে জমিতে প্রয়োগ করে বিষমুক্ত সবজির আবাদ হচ্ছে।
জেলার হাওর অধ্যুষিত বাহুবল, নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ, লাখাই, আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, মাধবপুর উপজেলার লাখো হাওরবাসী কচুরিপানা ব্যবহার করেই গরু পালন করছেন। তার সঙ্গে তারা গোবর ও কচুরিপানা পঁচিয়ে তৈরি করা জৈব (কম্পোষ্ট) সার ব্যবহার করে বিষমুক্ত সবজি চাষে দিন দিন মনোযোগী হচ্ছেন।
জেলার বাহুবল উপজেলার গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের বাগদার গ্রামের ফয়সল মিয়া বললেন- ছোট বড় মিলে ১০টি গরু রয়েছে তার। এদের তিনি কচুরিপানা খেতে দিচ্ছেন। এগুলো খেয়ে গরুগুলো মোটাতাজা হচ্ছে। কচুরিপানা পঁচিয়ে তিনি সারও তৈরি করছেন। তিনি বলেন বহুরূপেই কাজে লাগছে কচুরিপানা।
একই কথা বললেন আজমিরীগঞ্জের বনশিপ্পার বাসিন্দা খালেদ মিয়াও। তিনি জানান, শীতকালে কম্পোষ্ট সার তৈরিতে কৃষকরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারা কাদা মাটি ও কচুরিপানা মিশিয়ে করে একত্রে রাখেন। ৪৫ দিন অতিবাহিত হলে এসব পঁচে যায়। এতে তৈরি হয় সার। এ সার তারা জমিতে প্রয়োগ করেন। তাতে করে চাষাবাদে আসছে সফলতা। এমনভাবে চাষাবাদ করে দরিদ্র কৃষকরা নিজেদের ভাগ্য বদলে আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।
সূত্র জানায়, জেলার ৮টি উপজেলায় ফসলী জমির পরিমাণ ২,৯৫,৩০০ হেক্টর। উৎপাদনে প্রচুর পরিমাণে সারের প্রয়োজন হয়। অনেক সময় কৃষকরা টাকার অভাবে সার ক্রয় করতে সমস্যায় পড়তে হয়। এ সমস্যা লাঘবে দারুণ কাজ দিচ্ছে কাদা মাটি ও কচুরিপানা।
তাদের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে নানাভাবে সহায়তা করছে হবিগঞ্জ কৃষি বিভাগ। এসব সহায়তা পেয়ে কৃষকরা এ সার তৈরিতে উৎসাহ পাচ্ছে।
লাখাইয়ের বুল্লার কৃষক বাবুল পাঠান বলেন, ‘গরুকে পানা খেতে দিতে পারছি। তার সাথে সার নিয়ে আর ভাবতে হচ্ছে না। এখন সার তৈরির পদ্ধতি জানি। এ সার তৈরি করতে কোনো টাকা খরচ হচ্ছে না। এখানে প্রচুর পরিমাণে কচুরিপানা ও পঁচা মাটি পাওয়া যায়।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ শাহ আলম বলেন, ‘হাওরে প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর কচুরিপানা জন্ম নিচ্ছে। এসব পানা গরু খেতে পারছে। তার সাথে চাষাবাদে হবিগঞ্জের কৃষকরা পূর্বের চেয়ে অনেক অগ্রসর হচ্ছে। আর তাদের নানাভাবে সহায়তা করছে হবিগঞ্জ কৃষি বিভাগ। কৃষকরা কৃত্রিম সার আর গরুর মলের উপর নির্ভর করে বসে থাকছে না। কচুরিপানা দিয়ে তৈরি করছে প্রাকৃতিক সার। এ সারে চাষাবাদে আসছে সফলতা। তাদের এ সফলতাকে আরো এগিয়ে নিতে আমরা কাজ করছি।’
হবিগঞ্জের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আশরাফ উদ্দিন আহম্মদ বলেন, ‘এ জেলায় বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে হাওর। হাওরের জলাশয়ে প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর মাছ জন্ম নিচ্ছে। তার সাথে জন্ম নিচ্ছে কচুরিপানা। আর পানায় রয়েছে বহুমুখী উপকার।’
উপ-সহকারী কৃষি অফিসার তোফায়েল আহমেদ বলেন, কচুরিপানার বহুগুণ রয়েছে। এ পানায় জৈব সার (কম্পোষ্ট) তৈরিতে তেমন কোনো খরচ হয় না। তবে বেশি করে নিজের শ্রম দিতে হয়। এ সার জমিতে প্রয়োগে যেমনটা ভাল ফসল হয়। তেমনি জমির মাটির কোনো সমস্যা হয় না। বরং বেশি পরিমাণে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।