ম্যালেরিয়া কেন, কীভাবে..

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস আজ। এবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘চিরদিনের জন্য ম্যালেরিয়া নির্মূল করুন।’এ উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ম্যালেরিয়াপ্রবণ ১৩ জেলা এবং ৭০ উপজেলার ৬২০টি ইউনিয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

ম্যালেরিয়া রোগ যেমন চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময়যোগ্য, তেমনি অগ্রিম ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করাও সম্ভব। আক্রান্ত ব্যক্তিকে পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে। পর্যাপ্ত খাদ্যের মাধ্যমে পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। প্রচুর পানি পান করতে হবে। জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। ম্যালেরিয়া চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ রয়েছে। যেমন- কুইনিন, ক্লোরোকুইন, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন, মেফলোকুইন, ফ্যানসিডার, আর্টিমেসিনিন, আর্টিমেথার ইত্যাদি। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট ডোজের ওষুধ নির্ধারিত দিন পর্যন্ত সেবন করতে হবে।

ম্যালেরিয়া মশাবাহিত একটি সংক্রামক রোগ। বিশ্বের অনেক দেশেই এখনো এটি ঘাতক রোগ হিসেবে পরিচিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন এবং মারা যাচ্ছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। এর অধিকাংশই শিশু। ম্যালেরিয়ার জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হচ্ছে আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলের দেশগুলো। এছাড়া এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এমন কি ইউরোপের কয়েকটি দেশেও ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।

ম্যালেরিয়ার প্রকোপ দেখা যায় বাংলাদেশেও। এক পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৩.৬ শতাংশের ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। দেশের ১৩টি জেলার ৭০টি উপজেলায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি। এই ১৩ জেলার মধ্যে পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ম্যালেরিয়া-জনিত মৃত্যুহার সর্বাধিক।

ম্যালেরিয়ার জন্য দায়ী এককোষী পরজীবীটির নাম ‘প্লাজমোডিয়াম’। সাধারণত চার ধরনের ‘প্লাজমোডিয়াম’ জীবাণু ম্যালেরিয়ার জন্য দায়ী- ‘প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম’, ‘প্লাজমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স’, ‘প্লাজমোডিয়াম ওভালি’ এবং ‘প্লাজমোডিয়াম ম্যালেরি’। এর মধ্যে ‘প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম’ জীবাণুটির আক্রমণই সবচেয়ে মারাত্মক। এই জীবাণু মানুষের দেহে ছড়ায় স্ত্রী মশার মাধ্যমে। স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা মানুষের রক্ত শোষণ করে। যখন কোনো স্ত্রী অ্যানেফিলিস ম্যালেরিয়া-আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত মশার শুঙ্গ দিয়ে এর দেহে ঢুকে যায়। রক্তে থাকে ম্যালেরিয়ার জীবাণু। জীবাণুর বংশবিস্তারের একটি উল্লেখযোগ্য ধাপ সম্পন্ন হয় মশার দেহের ভেতর। মশা যখন পুনরায় একজন সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ায়, সেই সুস্থ ব্যক্তির রক্তে জীবাণু প্রবেশ করে। এছাড়াও আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত সুস্থ ব্যক্তির দেহে পরিসঞ্চালন করলে সুস্থ ব্যক্তি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন। আক্রান্ত গর্ভবতীর গর্ভস্থ শিশুর মাঝেও গর্ভনালির মাধ্যমে জীবাণুর বিস্তার ঘটতে পারে। ম্যালেরিয়া-প্রবণ এলাকার অধিবাসী এবং সেসব এলাকায় ভ্রমণকারীদের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। অল্পবয়স্ক ও শিশুরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।

ম্যালেরিয়া-আক্রান্ত ব্যক্তির প্রধান উপসর্গ হচ্ছে জ্বর। এ রোগে জ্বরের কোনো নির্দিষ্ট ধরন থাকে না। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে পারে, সঙ্গে ঠাণ্ডা বা শীত শীত অনুভূতি হতে পারে, জ্বর ছাড়ার সময় ঘাম হতে পারে। জ্বরের সঙ্গে মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, দুর্বলতা, ক্লান্তি বা অবসাদ থাকে।

এছাড়া রক্তস্বল্পতা, বমি, বমি বমি ভাব, কাশি ও পাতলা পায়খানা হতে পারে। ম্যালেরিয়া-আক্রান্তের যকৃত ও প্লীহা বড় হয়ে যেতে পারে, জন্ডিস দেখা দিতে পারে। সময় মতো চিকিৎসা না করালে ম্যালেরিয়াজনিত বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়।

অত্যধিক রক্তস্বল্পতার কারণে হার্ট ফেইলিওর হতে পারে।
রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হতে পারে।
রক্তের লোহিত কণিকা ভেঙে গিয়ে ব্লু্যাক ওয়াটার ফিভার নামের রোগ হতে পারে।
প্রস্রাব কমে যাওয়া, নেফ্রোটিক সিনড্রোমসহ কিডনির অন্যান্য রোগ হতে পারে।
কিডনি ও লিভার অকার্যকর হয়ে যেতে পারে।

ম্যালেরিয়ার একটি মারাত্মক জটিলতা হচ্ছে ‘সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া’ বা মস্তিষ্কের ম্যালেরিয়া যাতে রোগী তীব্র জ্বরসহ অজ্ঞান হয়ে যায়, রোগীর খিঁচুনী হতে পারে। সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ার কারণে রোগীর মৃত্যুও ঘটতে পারে। গর্ভাবস্থায় ম্যালেরিয়া হলে গর্ভপাত, কম ওজনের শিশু বা মৃত শিশু প্রসব হতে পারে, এমনকি প্রসূতিরও মৃত্যু ঘটতে পারে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. মুনতাসীর মারুফ এর মতে,  ম্যালেরিয়া রোগ যেমন চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময়যোগ্য, তেমনি অগ্রিম ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করাও সম্ভব। আক্রান্ত ব্যক্তিকে পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে। পর্যাপ্ত খাদ্যের মাধ্যমে পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। প্রচুর পানি পান করতে হবে। জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। ম্যালেরিয়া চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ রয়েছে। যেমন- কুইনিন, ক্লোরোকুইন, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন, মেফলোকুইন, ফ্যানসিডার, আর্টিমেসিনিন, আর্টিমেথার ইত্যাদি। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট ডোজের ওষুধ নির্ধারিত দিন পর্যন্ত সেবন করতে হবে। ওষুধের ডোজ এবং সেবনকাল নির্ভর করে সাধারণত রোগীর বয়স, ম্যালেরিয়ার ধরন, আক্রান্ত এলাকা, রোগের তীব্রতা প্রভৃতির ওপর। ম্যালেরিয়াজনিত জটিলতা দেখা দিলে আলাদাভাবে তারও চিকিৎসা করাতে হবে। যেমন, রক্তস্বল্পতার কারণে রক্ত পরিসঞ্চালন, খিঁচুনি হলে ডায়াজিপাম-জাতীয় ওষুধ ইত্যাদি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই ম্যালেরিয়া রোগের চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায়। এছাড়া জেলা সদর এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতেও এ রোগের চিকিৎসা দেয়া হয়।

ম্যালেরিয়া রোগ প্রতিরোধের জন্য এর জীবাণু বহনকারী মশার কামড় থেকে বাঁচতে হবে। এ জন্য ঘরে বিশেষত রাতে মশারির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অ্যানোফিলিস জাতীয় মশা সাধারণত রাতেই কামড়ায়। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ যেসব অঞ্চলে বেশি, সেখানে কীটনাশক-সিক্ত মশারি টানিয়ে ঘুমানোর পরামর্শ দেয়া হয়। সন্ধ্যার পর মশা-নিবারক কয়েল, ম্যাট বা এরোসল ব্যবহার করতে হবে। ঝোপ-ঝাড়, ডোবা, নর্দমা, ছোট নালাসহ মশার বংশবৃদ্ধির জন্য উপযোগী স্থানগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে। এসব স্থানে নিয়মিত মশা-নিবারক কীটনাশক ছড়ানো যেতে পারে। ম্যালেরিয়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে ভ্রমণের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন ও অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া জাতীয় পর্যায়ে ম্যালেরিয়া রোগ নির্ণয়, প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় দক্ষ জনশক্তি বাড়ানো ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা; তদারকি ও ব্যবস্থাপনা জোরদার করা; দুর্গম, প্রত্যন্ত এলাকায় চিকিৎসাসেবা সুলভ করা; জনসচেতনতা বৃদ্ধি- প্রভৃতিতে আরো মনোযোগ দিতে হবে।

Print Friendly

Related Posts