শিউল মনজুর এর দীর্ঘ কবিতা

ধূলিচিত্র নগরে একা একা

এক.

 

ধূলিচিত্র নগরে পড়ে আছি একা একা। বোধের বিলাসে জমা হয়ে আছে ফেরারী বসন্তের রাত। তবু হাঁটছি স্মৃতির পদচিহ্ন ধরে দিগন্তের পথে। যেখানে যেমন ছিল গত দশকে তার কিছুই এখানে নেই। মোড়ে মোড়ে অস্ত্রহাতে চন্দ্রমল্লিকারা দাঁড়িয়ে আছে- সেই গণভবন থেকে উপজেলা সদর পর্যন্ত। কোথাও কোনো গোলাপি ফেরিওয়ালা নেই। দরজায় দরজায় শুধু, নেই শব্দের উল্লাস। আর আমি শুধু নৈঃশব্দ্যের ভেতর দিয়ে মুখের রেখাচিত্র আঁকতে আঁকতে দীর্ঘশ্বাসের পোড়াভূমিতে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন এঁকে যাই নতুন প্রাণের নতুন দেশ।

দুই.

কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। জলকাঁপানো পাতাকাঁপানো থিরিথিরি কোনো হাওয়া নেই। বহু বর্ণিল ঘরের পর্দাগুলো প্রযুক্তির বাতাসে মাঝে মাঝে দোলে নিরব নিঃশ্বাসে। ভোরের ক্যানভাসে কোনো রঙনেই। পাখিদের মুখরিত কোন শব্দ নেই। সকাল হলে রাতজাগা মানুষগুলো মাতালের মতো ত্রস্তব্যস্ত পথের ধূলিচিত্রে নেমে আসে জংশনে দেখা নিঃসঙ্গ রেলগাড়ির মতো। তাদের চোখে বহুদূরের কোনো সমুদ্র নেই, তাদের চোখে বহুদুরের কোনো নদী নেই। তাদের চোখে শাওয়ারে ভেজা টাওয়াল আর সুগন্ধি সাবানের বিস্তৃত ঝড় ছাড়া আর কোনো বন্দনা নেই। অথচ আমার বুকে গত শতকে হারানো সবুজ পাতায় মোড়ানো ধূ ধূ বাতাস বারবার ঘুরে আসে নিরবে এবং এখনো স্বপ্নাচ্ছন্ন শিশির ভেজা দূর্বাঘাসে পা মাড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছি সকালের পাঠশালায়।

তিন.

সন্ধ্যার পর ল্যাম্পপোস্টগুলো থেকে বিদ্যুতের আলো বেরিয়ে এলে নগর অন্যরকম মোহনীয় নারীর মতো রহস্যময়ী এবং খুববেশি অচেনা হয়ে ওঠে। গোপন সড়কের বাঁক পেরিয়ে আড়াল হয়ে যেতে থাকে সকালে-বিকালে দেখা পাড়ার প্রতিদিনের মুখ। ফুটপাতে একটার পর একটা চায়ের স্টলঘুরে জানান দিতে থাকি জীবনের অস্তিত্ব দিয়ে এখনো পৃথিবীর পথে ধূলিচিত্র নগরে ঘুরছি একা একা। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে দেখি রাতের পাতায় গাড়ির চাকায় বদল হচ্ছে সময়ের পরিক্রমা। এখানে শক্রমিত্রবন্ধু বলে কিছু নেই। যারা কাছে আসে কিছু নিয়ে যেতে আসে, দিতে কেউ আসে না। ধূলিচিত্র নগরে বিধান হয়ে আছে এখানে দেবার নিয়ম নেই, নেবার আছে। ধরা দেবার নিয়ম নেই, পালানোর নিয়ম আছে। আমি কবে যে সেই নিয়ম আর সূচিবদ্ধলিপিতে পৌঁছে গেছি নিরবে নিরবে, কখন কিভাবে তাও জানি না।

চার.

আগামিকাল ভালোবাসা দিবস। শহরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত সাজ সাজ রব। ব্রান্ডসপগুলোর ব্যানার ফ্যাস্টুন আর বিশাল বিশাল নানারঙের তোরণ ও বিলবোর্ডগুলো জানান দিচ্ছে উৎসবের রঙ। শহরের নানা বয়সী লোকগুলোর সাথে বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল কলেজের তরুণ-তরুণীরাও ছুটে যাচ্ছে শপিংমলগুলোতে। আসলে শপিংমলগুলোতে কি ভালোবাসা দিবসের ভালোবাসা পাওয়া যায়…। পুরনো পাগলের সাথে নতুন নতুন পাগলও যুক্ত হচ্ছে…। পাগলগুলোর গাড়ি আছে বাড়ি আছে হাড়ি আছে কাড়ি আছে তারা ভিক্ষুক নয় তারপরও কিসের জন্যে তারা কাঙাল! তারা ভিক্ষারপাত্র নিয়ে ঘুরঘুর করে সময়ের তৈলচিত্র ধরে। তারা ভালোবাসারই কাঙাল তবে তারা শুধু ভালোবাসা নিতে জানে, দিতে জানে না। ধূলিচিত্র নগরের হাওয়ায় হাওয়ায় এমনই প্রতিভা ঘুরে বেড়ায় অলিগলি ফুটপাতে। তার ভেতরে তার ভেতরে আমি শুধু একজন ধূলোবালি মেখে একা একা ঘুরছি স্বপ্ন দেখছি, বদলে যাবে একদিন সবকিছু, নতুন ভোরে নতুন পাতায় জেগে উঠবে নতুন সূর্য; যেখানে মানুষ মানুষের জন্যে তৈরী করবে ভালোবাসার প্রাণময় নতুন সাঁকো।

 

পাঁচ.

অতঃপর দেখি, দুলতে দুলতে ধূলিপথেই ভেসে যাচ্ছে আমার জীবন। কেউ কোথাও কারো জন্য বসে নেই। কেউ কোথাও কারো জন্য থেমে নেই। তবু মনে হয় কখনো কখনো ধূলিপথের ঐ বাঁকেই বুঝি লুকিয়ে আছে আমার হারানো স্বপ্নময় সোনার বাংলাদেশের নদী মাতৃক প্রচ্ছদ।

Aspen hill, Silver Spring, Maryland, U S A.

 

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts