ফকির ইলিয়াস এর একগুচ্ছ কবিতা

গৃহ বিষয়ক 

 

কটা আকাশ আছে পৃথিবীতে, কটা সমুদ্র
এক হয়ে গেলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে জলের
সীমানা – এমন সব প্রশ্নের মুখোমুখি ধীর
দাঁড়িয়ে কেবলই দেখে যাই সৌম্য সংকেত।
লিখিত মনবিধান নাড়াচাড়া করে বুঝে ফেলি
শষ্যদানায় সঞ্চিত শক্তিরা সব উন্মুখ হয়ে
আছে, দেখবে বলে অন্য কোনো মাটির ভিত।
যেভাবে জেগে থাকা রাত স্পর্শ করে পাতার
রঙ কিংবা ঘুমন্ত দিন এসে নাড়ে দরদী দরোজা।

নেড়ে যেতে আনন্দ আছে ভীষণ। আর ভুলে
থাকাতেও।
যার কোনো বাসগৃহ নেই, আমরা জানি, মাধবী
আকাশকেই কেবল ছায়া ভাবতে পারে সে ও।

উড়ে মেঘ  পোড়ে ছায়া

বলয় নিয়ে বাড়ন্ত আকাশের ও একটা গৌরব থাকে। দিন
কিংবা রাতের শরীরে নির্মাণ করে যাবার প্রহর এবং প্রত্যয়
ধারন করে শিল্পীর চোখ তাকায় জ্বলন্ত ইচ্ছেগুলোর দিকে।
কে পোড়ায় এই প্রতিশ্রুতির নন্দন কানন ! কার পদছায়া
জমা থাকে মনের শোকেসে ! কোন নিখিলের প্রথম অভিজাত
অভিষেকে বার বার প্রবাহিত হয় সারিবদ্ধ মানুষের বিমূর্ত পরাণ।

অনেক মেঘ উড়ে । অনেক সর্বজনীন সন্ধ্যার ছায়া মাড়িয়ে ঝরে
বৃষ্টির বহুগামী রূপ। প্রথম কে এলো তৃষ্ণার সমুদ্রপাড়ে , তার নাম
লেখা থেকে যায় তিস্তাতোরণের দৈর্ঘ্যে, নি:শ্বাসের বিনম্র আষাঢ়ে।


জন্মের ঋষিরাতে

কটা লতা নুয়ে পড়েছিল চন্দ্রের মুখোমুখি। কটা প্রজাপতি
উড়ে উড়ে জপ করেছিল কার নাম ! ছাদের বিষন্ন প্রহর
এভাবে দাঁড়িয়েছিল সৌর বুননে। একটা নীলাভ এ্যকুরিয়াম
মেতে উঠেছিল ধারণ উৎসবে।

এই ঋষিরাত ছিল আামাদের ছাদ।আর আমরা ছিলাম বৃন্দাবনে
আরাধ্য প্রাণের আকর।
তবে কি কেবল উৎস আখ্যানেই বার বার এসেছিল ঝড়
আর পরস্পর লুকিয়েছিলাম,একে অন্যে,লতার ভেতর !


তৎসমপর্ব

আমার প্রতিবেশী ছিল আলখেল্লা পরা একটুকরো রাত,ডানপাশে
কয়েকটা মাকড়শা বুনছিল তাদের স্বপ্নজাল।আর শুকনো পাতার
মর্মরে বাজছিল অনাগত দিনের দ্যোতনা, কিছু সমবেত পিঁপড়া
খুঁড়ছিল মাটি। মাঝে মাঝে এভাবে খুঁড়ে যেতে হয় – তা আমার

আগেই জানা ছিল। কালো বন্দুকটার গায়ে হেলান দিয়ে আমি
যে মমতার স্থির চিত্র আঁকতাম , সেও থাকতো বহুদূরে কারণ
এই গুহাজীবন তার কখনোই পছন্দ ছিলো না। কেবল আমিই
একটা পালিত পাঁজর সম্বল করে বেছে নিয়েছিলাম তৎসমপর্ব।

একদিন গুহা থেকে বেরিয়ে আমি পেলাম সে এক অন্য মানব-
জীবন ! যেখানে মানুষ মাটি খুঁড়তে জানে না। দাঁড়াতে পারে
না ভালোবাসার স্বপক্ষে। দ্বেষের দ্বিতীয়জীবন নিয়ে তারা দেশ
ছেড়ে যায় – তবু সমবেত হয় না .. হতে পারে না ..হতে পারে না।

বৃত্তসম্ভাবনা

গ্রীষ্মের মুকুল ঝরিয়ে পৃথিবীও লিখে নতুন কবিতা
বর্ষার বৃষ্টি হয়ে ঝরে আকাশ। কদমফুলগুলো ভার
নিয়ে তাকায় দিগন্তের দিকে। কখন আসবে শরত
কখন ভোরের নেত্র ছুঁয়ে জাগবে নদী , আরেকটা দিন
থেকে যাবে কাছে – আরেকটা রাত বলে যাবে কানে
কানে গল্পের আনমনা অধ্যায়! এভাবে নৃত্যগীতি
শোনাতে শোনাতে চারপাশে প্রদক্ষিণ করবে হেমন্তের
ফসলের ঘ্রাণ। জীবন , মৃত্তিকার উষ্ণতা নিয়ে কালে
কালেই লিখে রাখে যে বৃত্তান্তবীজ , শীতের পরশ পেয়ে
একদিন তা ও ভেদ করে সম্ভাবনার নবম স্তর। আহা
বসন্ত ! আহা লালপুষ্প ! তুমিও কি আমাকে রাঙাতে আসো ?

 

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts