শাহ মতিন টিপু []
সুকান্ত ভট্টাচার্য । মাত্র ২১ বছরের জীবন পেয়েছিলেন এই কবি কিশোর।আর সেই কিশোর বয়সেই তিনি অসংখ্য কবিতায় প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন।জন্মলগ্ন থেকেই দ্রোহের আগুন নিয়ে বেড়ে ওঠা এই কবির ৭০তম প্রয়াণ বার্ষিকী আজ।
দুর্ভাগ্য যে, ১৯৪৭ সালের ১৩ মে তিনি দুরারোগ্য যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় যাদবপুর টিবি হাসপাতালে মারা যান। জন্ম ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতার বেলেঘাটায় নানা বাড়িতে।পৈতৃক নিবাস ছিল বাংলাদেশের ফরিদপুর।
এমন একটা সময়ে জন্ম ও বেড়ে ওঠা কবি সুকান্তের।সময়টাই ছিল তখন প্রতিবাদের। চারিদিকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা আর নিপীড়ন। কিশোর বয়সেই ‘ক্ষুধার’ মতো ভয়াবহ শব্দের সঙ্গে পরিচিত এই কবি ক্ষুধার্ত, নিষ্পেষিত মানুষের বন্ধু হয়ে ওঠেন।
বাংলা সাহিত্যর রবীন্দ্র-নজরুল বলয়ের ভেতরেই সেই সময় অন্য এক দ্রোহের আগুন নিয়ে আবির্ভাব ঘটে কবি কিশোর সুকান্তের। স্কুলছাত্র অবস্থাতেই তিনি জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে। মার্ক্সবাদী ধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণে মানুষের জন্য নিজেকে নিবেদনের প্রস্তুতি ছিল তার।
কবিতা, শ্রম ও ঘামে সবকিছুতে প্রতিফলন ঘটে সেই চেতনার। কবিতায় অনুরণিত হয় মানুষের ক্ষুধা আর জঠরযন্ত্রণার ধ্বনি । ‘হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়/ এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো/ পদ-লালিত্য-ঝঙ্কার মুছে যাক/ গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো।/ প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা-/ কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি/ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময় :/ পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। ( কাব্য, মহাজীবন )
আবার বিশ্বময় ক্ষুধা-দারিদ্র্য, যুদ্ধ আর আর সংঘাতের জঞ্জাল সরিয়ে এই বিশ্বকে শিশুদের বাসযোগ্য করতে অনাগত শিশুর জন্য তার দৃঢ় অঙ্গীকার ফুটে ওঠে ‘ছাড়পত্র’ কবিতায়। বিশ্ব জুড়ে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজেছে। পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে একদিকে ছড়িয়ে পড়েছে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, আরেক দিকে তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ। কবি সুকান্ত এ সবকিছুকেই করে তোলেন তার কবিতার উপজীব্য।
তার রচিত : ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২) এসব কাব্যের প্রতিটি পত্রই যেন একেকটি অনল প্রবাহ ।
সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম, যন্ত্রণা-বিক্ষোভ আর দ্রোহই ছিল তার কবিতার প্রধান উপজীব্য। এক ছড়ায় কবি লেখেন-
‘কোন কাজটাই পারিনাকো বলতে পারি ছড়া,/ পাশের পড়া পড়ি না ছাই, পড়ি ফেলের পড়া।/পড়তে বসে থাকে আমার পথের দিকে চোখ,/পথের চেয়ে পথের লোকের দিকেই বেশী ঝোঁক।’
সত্যিই পথের লোকের দিকেই বেশি ঝোঁক ছিল কবির। আর সুকান্তের সাহিত্য সাধনার মূল ক্ষেত্রই ছিল কবিতা। শোষণহীন এক নতুন সমাজ গড়ার প্রত্যয় ও অঙ্গীকার তার কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তিতে উচ্চারিত হয়েছে। তার কবিতার রচনাশৈলী, ভাষা, ছন্দ ও রূপকল্পনা ছিল বলিষ্ঠ, স্বচ্ছন্দ নিখুঁত। যা তার বয়স বিবেচনায় বিস্ময়কর ও অসাধারণ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে সুকান্ত কলম ধরেছেন বলিষ্ঠ হাতে।
সুকান্তের কবিতা গণসংগীতে রূপান্তরিত হয়েছে । হে মহাজীবন আর কাব্য নয়, হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ, হে মহামানব একবার এসো ফিরে, বেজে উঠলো কি সময়ের ঘড়ি ও হে সাথী আজকে স্বপ্নের দিন গোনা- এর সবগুলোই সুকান্তের কবিতা থেকে জনপ্রিয় গণসংগীতে রূপ লাভ করেছে।
বাংলা কাব্যসাহিত্যে রবীন্দ্র, নজরুলের পর সুকান্ত ভট্টাচার্যকেই সর্বাধিক উচ্চারিত কবি । সাহিত্যে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা, রোষ, স্বপ্ন আর সংগ্রাম সবচেয়ে বেশি ধারণ করতে পেরেছিলেনে তিনি। এখনও অবধি, কাব্যচর্চায় তাঁর দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত হয়েছেন, এমন কবির সংখ্যা কম নয়।
‘আমি এক দূর্ভিক্ষের কবি,/প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
আমরা বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতিক্ষায়’ (রবীন্দ্রনাথের প্রতি)
সুকান্ত সারাজীবন এই ক্ষুধার সঙ্গেই লড়াই করে গেছেন। আসলে তিনি তার সময়কে ভালভাবে চিনেছিলেন। সময়ের আহবানে সাড়া দিয়েছিলেন।