ধূমকেতু কবি

শাহ মতিন টিপু  [] নজরুল নিয়ে এসেছিলেন দ্রোহ, প্রেম, সাম্য, মানবতা ও শোষিত বঞ্চিত মানুষের মুক্তির বার্তা।  বাংলা কবিতায় নজরুলের আর্বিভাব একেবারেই ধুমকেতুর মত। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু/ আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’

বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তার কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে তার কবিতা ও গান । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।

‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব তবু আমারে দেবনা ভুলিতে..।’ তিনি আমাদের জাতীয় জীবনে আপন সৃষ্টি কুশলতায় এতটাই মিশে আছেন তাকে ভুলে গেলে আমরাই হয়ে যাব অর্থহীন। ১৪২১ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ জাতীয় কবির ১১৭তম জন্মবার্ষিকী। বৃটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় ১৩০৬ বঙ্গাব্দের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রের এই মহান পুরুষ।

তিনি সত্যি আমাদের মন ও মনন দখল করে আছেন। তিনি আমাদের জাতীয় কবি। কাজী নজরুল ইসলাম এক অসম্ভব প্রিয় চরিত্রের নাম। তিনি বাংলা ভাষাভাষি সকলেরই প্রিয় কবি। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ উভয় বাংলাতেই তার কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তার ক্ষুরধার লেখনি ছিলো মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার, প্রভূত্ব, অধর্মের চর্চা এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার। কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন উচ্চকন্ঠ। বাংলা সাহিত্যে অগ্নিবীণা হাতে নিয়ে এসেছিলেন। প্রকাশিত হয়েছেন ধূমকেতুর মতো।

সেই শৈশবে ফিরে গেলে দেখা যায়, দুঃখ ও কষ্টেই কেটেছে তার শৈশব। যখন তার পিতার মৃত্যু হয়, তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর। পারিবারিক অভাব-অনটনে তার শিক্ষাজীবন চরমভাবে বাঁধাগ্রস্ত হয়। মাত্র দশ বছর বয়সে তাকে নেমে যেতে হয় জীবিকা অর্জনে। আর্থিক সমস্যা তাকে পড়ালেখায় বাধাগ্রস্ত করেছে বারবার। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পরই তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। কষ্টের মাঝেই অতিবাহিত হয় তার বাল্য জীবন। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’।

আসানসোলের চা-রুটির দোকানে কাজ করার সময় দারোগা রফিজউল্লাহ তার প্রতিভার পরিচয় পান। তিনিই নজরুলকে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। সেখান থেকে যান রানীগঞ্জের সিয়ারসোল। সেখানে অষ্টম শ্রেণি থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষা না দিয়েই যোগ দেন সেনাবাহিনীতে ।

সেনাবাহিনীতে ছিলেন প্রায় আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধার সৈনিক থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। এখানেই ফারসি ভাষা শিখেন। সঙ্গীতের চর্চা অব্যাহত রাখেন, চলতে থাকে গদ্য-পদ্যের চর্চাও।

নজরুলের বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী (প্রথম গদ্য রচনা), মুক্তি (প্রথম প্রকাশিত কবিতা), গল্প: হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধি এইসব লেখেন করাচি সেনানিবাসেই । এখানে তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকারও গ্রাহক ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী, মর্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা।

এই সময় তার কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং ফারসি কবি হাফিজের কিছু বই ছিল। বলা যায় নজরুলের সাহিত্য চর্চার শুরুটা এই করাচি সেনানিবাসেই। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাননি। যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এর পর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।

৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে শুরু হয় তার বসবাস। এসময় নজরুল ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মত কবিতা, ধূমকেতুর মত সাময়িকী। জেলে বন্দী হলে পর লিখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী।

বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হল ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল। এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামাসংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন তিনি নিজেই।

নজরুলের রাজনৈতিক চেতনায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নানাভাবে প্রভাবিত করে। তার লাঙ্গল ও গণবাণী পত্রিকায় তিনি প্রকাশ করেন সাম্যবাদী ও সর্বহারা কবিতাগুচ্ছ। এরই সাথে প্রকাশ করেছিলেন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল-এর অনুবাদ ‘জাগ অনশন বন্দী ওঠ রে যত’। তার পত্রিকায় প্রকাশিত হয় রেড ফ্ল্যাগ-এর অবলম্বনে রচিত রক্তপতাকার গান।

নজরুল বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন কামাল পাশার দ্বারা। নজরুল ভেবেছিলেন তুরস্কের মুসলমানরা তাদের দেশে যা করতে পেরেছে ভারতীয় উপমহাদেশে কেন তা সম্ভব হবেনা? গোড়ামী, রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নজরুলের অবস্থান ছিল কঠোর। এ ক্ষেত্রে তার জীবনের নায়ক ছিলেন কামাল পাশা।

১৯২০ এর দশকের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে তিনি অংশ গ্রহণের চেষ্টা করেন। প্রথমে কংগ্রেসে সমর্থন লাভের জন্য তিনি কলকাতা যান। কিন্তু কংগ্রেসের কাছ থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে তিনি একাই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেন। নির্বাচনে তিনি তেমন সাফল্য পাননি।

এরপর সাহিত্যের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে থাকেন। এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়।

এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাঁধন হারা এবং কবিতা বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানি, মোহররম, ফাতেহা-ই-দোয়াজ্দম্। এই লেখাগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমালোচকদের সাথে নজরুলের ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয়।
১৯২০ সালের জুলাইতে নবযুগ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন।
১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে যেয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল।

১৯২১ সালে মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন নজরুল। তার সাথেই তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। আর এখানেই পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সাথে যার সাথে তার প্রথমে পরিণয় ও পরে বিয়ে হয়েছিল।

তবে এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস আসার খানমের সাথে। বিয়ের আখত সম্পন্ন হবার পরে কাবিনের নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

১৯২১ সালের নভেম্বরে নজরুল তখন কুমিল্লায়। ২১ নভেম্বর ছিল সমগ্র ভারতব্যাপী হরতাল। নজরুল পথে নেমে আসেন; অসহযোগ মিছিলের সাথে শহর প্রদক্ষিণ করেন আর গান করেন, ‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী’।

নজরুলের এ সময়কার কবিতা, গান ও প্রবন্ধের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব প্রকাশ পেতে থাকে। যার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’। বিদ্রোহী কবিতাটি ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় এবং সারা ভারতের সাহিত্য সমাজে খ্যাতিলাভ করে।

এ বছরের  আগস্টেই নজরুল ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। এটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু / আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু/ দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন। পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে এই বাণী লেখা থাকতো।

পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার ওই সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাকে কুমিল্লা থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়।

বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। নজরুলকে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে যখন বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন তখন (১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি ২২) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এতে নজরুল বিশেষ উল্লসিত হন। এই আনন্দে জেলে বসে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতাটি রচনা করেন।

১৯৪২ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। এ বছরের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করেন। ধানমন্ডিতে কবির বসবাসের জন্য একটি বাড়ি প্রদান করেন তিনি। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে।

কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কবির অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তার সমাধি রচিত হয়।

‘অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহসে’ তিনি যেমন বিদ্রোহের অনল ছড়িয়েছেন, তেমনি প্রেম-ভালবাসাতেও দ্যোতনা তৈরি করে গেছেন। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে তিনি যে ঝংকার তুলে দিয়ে গেছেন, তাতে তাকে ভুলে যাওয়া মোটেই সহজ নয়।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts