ফ্রান্ৎস কাফকা (৩ জুলাই, ১৮৮৩ – ৩ জুন, ১৯২৪) জার্মান উপন্যাস এবং ছোটগল্প লেখক। কাফকাকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি অস্তিত্ববাদ তত্ত্বকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। তার অধিকাংশ লেখার আদর্শিক দিক মূলতঃ বিচ্ছিন্নতাবোধ, শারীরিক ও মানসিক নিষ্ঠুরতা, অভিভাবক-সন্তান সম্পর্কের সংঘর্ষ, আতঙ্কজনক উদ্দেশ্য চরিতার্থে ব্যস্ত এমন চরিত্র, মানবজীবনে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ এবং রহস্যময় রূপান্তর, ইত্যাদি বিষয় কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
কাফকার গল্প …
এক)
একটি ছোট্ট উপকথা
‘হায়,’ ইঁদুর বললো, ‘দুনিয়াটা প্রতিদিনই ছোট হয়ে আসছে। শুরুতে এটা এতো বড় ছিলো যে আমি চিন্তিত হয়ে গিয়েছিলাম, আমি দৌঁড়াতেই থাকি, দৌঁড়াতেই থাকি, এবং অবশেষে আমি দূরে ডানে ও বামে দেয়াল দেখে খুশি হই, কিন্তু এই দেয়াল দুটো ক্রমশ সরু হয়ে যেতে থাকে আর আমি ততোক্ষণে কামরার শেষে এসে দাঁড়াই, এবং ওইখানে এক কোণায় ফাঁদ পাতা রয়েছে যা অবশ্যই অতিক্রম করে যেতে হবে আমাকে।’
‘তোমার শুধু পথটা বদলানো দরকার ছিলো,’ বিড়াল বললো এবং ওটাকে খেয়ে ফেললো।
দুই)
প্রহরী
আমি প্রথম প্রহরীকে অতিক্রম করে গেলাম। তখন আমি ভয় পেলাম, আবার দৌঁড়ে ফিরে এলাম এবং প্রহরীকে বললাম, ‘আপনি যখন অন্য দিকে খেয়াল রাখছিলেন আমি তখন এখান দিয়ে দৌঁড়ে গিয়েছিলাম।’
প্রহরী তার সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলো এবং কিছুই বললো না। ‘আমার মনে হয় আসলে আমার এমনটা করা উচিত হয়নি,’ আমি বললাম।
প্রহরী তবুও কিছু বললো না। ‘আপনার নীরবতা কি আপনাকে অতিক্রম করে যাওয়ার অনুমতির ইঙ্গিত দেয়?’
তিন)
প্রমিথিউস
প্রমিথিউসকে কেন্দ্র করে চারটি কিংবদন্তি আছে:
প্রথম কিংবদন্তি অনুযায়ী, তাকে ককেসাস পর্বতের পাথরের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিলো দেবতাদের গোপনীয়তা মানুষের কাছে প্রকাশ করার প্রতারণার অভিযোগে, এবং দেবতারা তার হৃদয় ছিঁড়ে খাওয়ার জন্যে ঈগল পাঠাতো, আর অবিরতভাবে সে হৃদয় পুননির্মিত হতো।
দ্বিতীয় কিংবদন্তি অনুযায়ী, প্রমিথিউস প্রতিনিয়ত বিদারিত হওয়ার যন্ত্রণায় নিজেকে ক্রমশ পাথরের গভীরে ঠেলে দিয়েছিলো যতক্ষণ না সে পাথরেরই অংশ হয়ে গেছে।
তৃতীয় কিংবদন্তি অনুযায়ী, হাজার বছরের সময় পরিক্রমায় প্রমিথিউসের প্রতারণার কথা ভুলে যাওয়া হয়, ভুলে যান দেবতারা, ভুলে যায় ঈগল এবং প্রমিথিউস নিজেও।
চতুর্থ কিংবদন্তি অনুযায়ী, প্রত্যেকেই এই অর্থহীন বিষয়ে ক্লান্ত-বিরক্ত হয়ে যায়। দেবতারা বিরক্ত হয়ে যায়, ঈগল ক্লান্ত হয়ে যায় এবং ক্লান্ত-বিরক্ত হয়ে ক্ষতও সেরে যায়।
সেখানে ব্যখ্যাতীত পরিমাণের পাথর ছিলো। কিংবদন্তি এই ব্যাখ্যাতীতকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। যখন এই সত্যের ভিত্তির উপর প্রকাশিত হয়েছে তখন ব্যাখ্যাতীতভাবে এর সমাপ্তি ঘটেছে।
চার)
অন্যমনস্কের জানালা দর্শন
ক্রমশ এগিয়ে আসছে যে বসন্ত দিনগুলি তা নিয়ে আমরা কী করবো? আজ খুব সকালেই আকাশ ছিলো ধুসর, কিন্তু তুমি যদি এখন জানালার কাছে যেতে তাহলে বিস্মিত হতে এবং গরাদহীন জানালর পাল্লায় তোমার চিবুক রাখতে।
ইতোমধ্যে সূর্য ডুবে যাচ্ছে, কিন্তু তুমি দেখবে সে নিচে অলসভাবে যে মেয়েটি হাঁটছে তার মুখে আলো ফেলছে, এবং একইসময়ে সে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, তাকে অতিক্রমরত একটি লোকের ছায়ার কারণে।
এবং তারপর লোকটি চলে গেছে এবং ছোট্ট মেয়েটির মুখ যথেষ্ট উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
পাঁচ)
পরের গ্রাম
আমার দাদা সব সময়ই বলতেন, ‘জীবন বিস্ময়কর রকমের ছোট। আমার কাছে, পেছন ফিরে তাকালে জীবন এতোই ছোট মনে হয় যে আমি খুব সামান্যই এর অর্থ বুঝতে পারি। ধরা যাক, একজন তরুণ কীভাবে কোনো দুশ্চিন্তা ছাড়া পাশের গ্রামে যাওয়ার কথা ভাবতে পারে- কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই- এমনকি স্বাভাবিক সুখের মুহূর্তেও এরকম একটি ভ্রমণের জন্যে যে সময়ের প্রয়োজন সে বিবেচনা করলেও জীবন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত মনে হবে।’
ছয়)
গাছ
আমরা তুষার আবৃত গাছের কাণ্ড দেখতে পছন্দ করি। আপাতভাবে মনে হয় তারা খুব কোমলভাবে দাঁড়িয়ে আছে এবং একটু ধাক্কাতেই দুলে উঠবে। না, তা করা যাবে না, কেননা, তারা গভীরভাবে মাটির সঙ্গে একা; কিন্তু, এমনকি এটাও শুধুই আপাতভাবে মনে হয়।
সাত)
প্রস্থান
আমি আমার ঘোড়াটিকে আস্তাবল থেকে নিয়ে আসার আদেশ দিলাম। ভৃত্য আমার আদেশ বুঝতে পারলো না। তাই আমি নিজেই আস্তাবলে গেলাম, ঘোড়ায় চাপালাম এবং ঘোড়ায় চড়লাম। দূরে ট্রাম্পেট বাজানোর শব্দ শুনতে পেলাম এবং আমি ভৃত্যকে জিজ্ঞেস করলাম, এর মানে কী?
সে কিছুই জানতো না এবং কিছু শোনেওনি। গেটে সে আমাকে থামালো এবং জিজ্ঞেস করলো : ‘প্রভূ কোথায় যাচ্ছেন?’
‘আমি জানি না,’ বললাম, ‘শুধু এই এলাকার বাইরে, এর বাইরে, বাইরে, আর কিছু নয়, এটাই একমাত্র পথ যাতে আমি লক্ষ্যে পৌঁছতে পারি।’
সে জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে আপনি আপনার লক্ষ্য জানেন?’
‘হ্যাঁ,’ আমি জবাব দিলাম, ‘আমি এইমাত্র তোমাকে বলেছি। এর বাইরে- সেটাই আমার লক্ষ্য।’
অনুবাদ: মুম রহমান