সেজান মাহমুদের ভেতর ছোট বেলা থেকেই এক ধরণের কবি কবি ভাব দেখা যায়। যখন সে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র, তখন থেকেই কবিতার মতো কী যেন লেখে। তখন ঠিক বুঝতে পারে না। ভেতর থেকে কে যেন ঠেলা দেয়, অনুভূতি প্রকাশের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। লিখে ফেলে আকাশ, বাতাস, চাঁদ, তারা, কাশফুল নিয়ে হিজিবিজি কিছু। তখন থেকেই ডায়েরিতে সংরক্ষণ করে। স্কুলের ম্যাগাজিনে প্রকাশ পায়। সে কী আনন্দ! কীসের এ আনন্দ, কেন এ আনন্দ, এ প্রকাশে এত আনন্দ কেন? বাড়ি এনে বাবা-মাকে দেখায়। তারা পাত্তাই দেয় না। যখন সে দশম শ্রেণির ছাত্র, তার হাতে এসে পড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের কাব্যগ্রন্থ।
সেই প্রথম প্রেম কবিতার বইয়ের সাথে। সে ভাবে সেওতো ছাত্র, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যদি কবিতার বই বের করতে পারে, তবে সেও পারবে। এস এস সিতে পড়ে, তাতে কী? শুরু হয়ে গেল নিয়মিত কবিতা লেখা। লোডশেডিং এ বসেও হারিকেন জ্বালিয়ে কবিতা লেখা চলে। গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝরে পড়ে। একটি বই বের করতে হবে। চল্লিশ-পঞ্চাশটি কবিতা দরকার। এভাবে লিখতে লিখতে এক সময় প্রয়োজনীয় সংখ্যা পূরণ হয়।
এখন বই ছাপতে হবে। অল্প কিছু টাকা আছে নিজের কাছে, বিভিন্নভাবে জমানো। বিভিন্ ঈদে পরীক্ষার রেজাল্ট ভাল করলে অভিভাবকরা দিয়েছে, সেই সব টাকা। কিন্তু এত কম টাকায় বই বের হবে না। এ প্রেস থেকে ও প্রেস। একটা সেণ্ডেল ক্ষয় হয়ে গেল। কার কাছে গেলে কম টাকায় বই করা যাবে সেই প্রচেষ্টা চলতে থাকে। শেষে একটা প্রেস খুঁজে পাওয়া গেল। আম্মাকে বলল, বই বের হলে বিক্রি করে টাকা শোধ দেবে। তিনি কিছু টাকা দিলেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও। শুরু হলো বই ছাপানোর কাজ। সুন্দর একটা প্রচ্ছদ তৈরী করালেন। অনেক কষ্টের পর বই বের হলো। সে কী আনন্দ! প্রাণে ধরে না, সেই ১৯৯২ সালের কথা।
বাবা বললেন, কবিতা লিখতে লিখতে সব বুড়ো হয়ে গেল, তবু বই বের করার সাহস হয় না আর এ এখনই বই বের করল! সেই থেকে পরিবারের থেকে মানসিক বিচ্ছেদ শুরু। বেশ কিছু বই বন্ধুদের মাঝে বিক্রি হলো। তারা সাদরে গ্রহণ করল। অনেকেই বইয়ের মূল্য ত্রিশ টাকা দিয়ে দিল। অনেকে বিশ টাকা দিল। কেউ কেউ অনেক দিন ঘুরিয়ে কোন টাকাই দিল না। আম্মাকে আর টাকাগুলো শোধ দেয়া হয়নি। এরপর সাহিত্যের নেশা পেয়ে বসল ভীষণভাবে। বেশ কিছু পত্রিকায় লেখা শুরু করল। অনেকেই বাহ্বা দিল। এস এস সি ও এইচ এস সিতে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হয়েও সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে। ফলশ্রুতিতে অনার্স ও মাস্টার্স করলেন বাংলায়। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের কাছে নিকৃষ্ট জীব হিসেবে পরিণত হলেন। সবাই শুধু নাক সিটকায়, ঘৃণার চোখে তাকায়, ছেলে নষ্ট হয়ে গেছে, ওকে দিয়ে কিছু হবে না। রাত জেগে কবিতা লেখে। রাত জেগে পড়লেও দোষ হয়। অনার্স ও মাস্টার্সে বাংলায় তার ব্যাচে সর্বোচ্চ নাম্বার পায়। তবু অভিভাবকরা অখুশী। ততদিনে আরও দুই-তিনটি বই বেরিয়েছে।
এখন শিক্ষকতা করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করছে। এ দেশে শিক্ষকগণ বেশ অবহেলিত অর্থনৈতিকভাবে। রাজধানী থেকে সুন্দর করে বই বের করার ইচ্ছা জাগে। প্রকাশকরা বই বের করার জন্য হা করে থাকে। কিন্তু যত ভাল লেখায় হোক, ফর্মা প্রতি নির্দিষ্ট টাকা দিতে হবে। একটি চার-পাঁচ ফর্মার বই বের করতে গেলে কমপক্ষে ত্রিশ হাজার টাকা প্রকাশককে দিতে হবে। প্রতি বছর তার একটি বই প্রকাশ করতে ইচ্ছে জাগে। কিন্তু সংসার চালিয়ে এত টাকা দিয়ে বই বের করা খুবই কষ্টকর। নিজে এত মেধা-মনন ব্যয় করে লিখে আবার নিজেই অনেক টাকা দিয়ে বই বের করতে হবে। বই বিক্রি হবে না বলা যায়। সবাই হাতে নেবে, নেড়ে চেড়ে রেখে দেবে। তারপর জ্ঞানী-জ্ঞুনীদের সৌজন্য কপি হিসেবে দিতে হবে। তারাও নেড়ে চেড়ে রেখে দেবে। প্রকাশনা উৎসব করতে হবে নিজের টাকায়। লোকজন ডেকে আনতে হবে। কয়েকজন ধারাবাহিক রেডিমেট বক্তব্য দেবে। তারপর সবাইকে মিষ্টি মুখ করাতে হবে। গোদের ওপর বিষফোঁড়া। অজস্র বই কিনে নিজে গবেষণা করে নিজের টাকায় বই করে, লোকজন ডেকে নিজের টাকাই প্রকাশনা উৎসব করে, মিষ্টি খাইয়ে একটু কবি কবি ভাব নেয়া। সবাই এরপর আড়ে আড়ে দেখে, নাক সিটকায়। দুনিয়ায় আর কোন কাজ পেল না, বড্ড কবি হয়েছে! ঘৃণার আগুন জ্বলে চোখে-মুখে। অন্য কবিদের কাছেতো কোন পাত্তাই নেই। অন্য কবিরা বলে, ও কোন কবি হলো, ফালতু। কী সব হাবি-জাবি লেখে! এর চেয়ে পাড়ার ওমুকের ডায়রীর লেখা অনেক সুন্দর। সমাজের অন্য ব্যক্তিরা ভাবে কবি হয়েছে, কাজ আর পায়নি, বেটা নিশ্চিত নেশা করে, গাজা খোর। নেশা না করলে নাকি লেখা হয় না। বেটা আপদমস্তক লুচ্চ। ওর বস্তা খুললে টুপটাপ করে বৃষ্টির মতো নারী পড়ে। নারীরা সতী-সাধ্বী কিন্তু ওবেটা পুরোটাই লুচ্চর ভাণ্ডার। বেটা নাস্তিকের ঢোল। নাস্তিক না হলে নাকি ভাল মানের কবি হওয়া যায় না। সমাজের সবাই একজন কবিকে ঘৃণা করে, খোটা দেয়, তিক্ত আশ্লেষের বাণে বিষাক্ত করে। পরিবারের লোকজনের কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে। বউ, ছেলে-মেয়েরা কিছুটা হলেও ভাল জামা কাপড় পরতে পারত। কিন্তু ঐ কবি বছরের সামান্য জমানো টাকা দিয়ে ফূর্তি করে। নিজের টাকা দিয়ে বই বের করে, তারপর সৌজন্য কপি বিলায়, তারপর প্রকাশনা উৎসব করে, অন্যদের মিষ্টি খাওয়ায় আর পরিবারের প্রতি থাকে উদাসীন। বউ ভাবে এমন কপাল আমার, শেষে পর্যন্ত একটা কবির সাথে বিয়ে হলো, এর চেয়ে রিকশাওয়ালার সাথে বিয়ে হলেও ভাল হতো। ছেলে-মেয়েরা ভাবে, ভাল মোবাইল দিতে পারে না, সপ্তাহে অনন্ত তিন দিন বিরানী খাওয়াতে পারে না, ফালতু বাবা। শুধু গাদা গাদা বই কেনে, রাত জেগে পড়ে আর নিজেও কী সব হাবিজাবি লেখে। নিজের টাকায় প্রকাশ করে। এ ধরণের পাগল বাবাদের পাগলা গারদে রেখে আসা উচিত।
কবি সেজান মাহমুদ কাউকে সুখী করতে পারল না। বাবা-মা অতিষ্ঠ, পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে ঘৃণিত চরিত্র, বউ-ছেলে-মেয়ের কাছে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। তবু তার ভাল লাগে, লোকজন কবি বলে, আড়ে আড়ে চায়, মৃদু মৃদু হাসে, ভালই লাগে। যে যাই বলুক, এক ধরণের কবি কবি ভাব হয়।
অবশেষে সে কী পেল, কিছুই না। কালোত্তীর্ণ কবি-হাস্যকর। ছোট বেলা থেকেই শুধু লাঞ্ছনা, শুধুই গঞ্জনা, শুধুই নিজের অর্থ ব্যয়। কবিরাই কবিদের প্রধান শত্রু। তারাই নানা প্রকার ব্যঘাত ঘটাতে সর্বদা সোচ্চার। দীর্ঘ রাত শেষে, বয়সের মাঝামাঝি পৌঁছে সে বুঝতে পারে, জন্মই কবির আজন্ম পাপ! কেন সব কিছু বোধের দরজায় আটকে যায়? অন্যদেরতো যায় না। সামাজিকভাবে তারাতো বেশ সুখী বলেই মনে হয়। তবু কী আর করার? ভেতর থেকে কে যেন ধাক্কা দেয়, বাইরে এসো, দ্যাখো-সূর্য উঠেছে, তার আলোয় ঝলমল করছে পৃথিবী। বাতাস বয়ে যায় শরীর ছুঁয়ে, শীতল পরশ। আকাশে এক ঝাঁক পাখি উড়ে যায়, কচি পাতারা জানায় নতুন দিনের আগমন। কবির মুখে স্মিত হাসি ফোটে।