বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ লেখক তাহমিমা আনাম এ বছর ও’ হেনরি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। এর আগে তাহমিমা আনাম তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আ গোল্ডেন এজ’ (A Golden Age, ২০০৭)-এর জন্য ২০০৮ সালে কমনওয়েলথ সেরা প্রথম বই পুরস্কার পান এবং দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য গুড মুসলিম’ (২০১১)-এর জন্য ‘ম্যান এশিয়ান লিটারেরি প্রাইজ’-এর জন্য প্রাথমিকভাবে মনোনীত হন।
তাহমিমা আনামসহ ২০ লেখক এবারের সাহিত্যের এই সম্মানজনক পুরস্কার পেলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত ছোটগল্পকার ও’ হেনরির নামে এই পুরস্কারের নামকরণ হয়েছে। ১৯১৮ সাল থেকে ছোটগল্পের জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয়। এবার ছিল পুরস্কারের ৯৯তম আসর। ‘গার্মেন্টস’ গল্পের জন্য এই পুরস্কার পেয়েছেন তাহমিমা আনাম। তিনি লন্ডন থেকে লেখেন। ২০০৮ সালে কমনওয়েলথ লেখক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন তাহমিমা।
এবারের ও’ হেনরি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে আরও রয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখক শ্রুতি স্বামী, ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন পরমাণু রেডিওলজিস্ট অমিত মজুমদার ও লেখক জয় চক্রবর্তী।
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সাময়িকীতে প্রকাশিত ইংরেজি ভাষায় লেখা গল্পের সাহিত্যমূল্যের বিচারে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। বার্ষিক ভিত্তিতে তিনজন বিচারকের প্যানেল পুরস্কারের জন্য গল্প মনোনীত করেন। সাহিত্যের ছোটগল্প শাখাটিকে সমৃদ্ধ করাই এ পুরস্কার প্রবর্তনের লক্ষ্য। অতীতে এ পুরস্কারজয়ী সাহিত্যিকদের মধ্যে আছেন আসাকো সেরিজাওয়া, ফ্রেডেরিক টুটেন, এলিজাবেথ ম্যাকক্র্যাকেন, অ্যালিস মুনরো, উইলিয়াম ট্রেভর, স্টিফেন কিং, জন আপডাইক প্রমুখ।
গল্পটির বাংলা অনুবাদ এখানে তুলে দেওয়া হলো :
গার্মেন্টস
একদিন মালা তার মুখের ওপর থেকে মাস্কটা সরিয়ে জেসমিনকে ফিসফিস করে বলল, ‘আমার নাগর তোরে বিয়া করতে চায়।’ জেসমিন ছয়টা শার্টের কাজে পিছিয়ে ছিল, তাই ব্যস্ততায় সে মুখ তুলে তাকাতে পারেনি। ছুটির পর পুরো বিষয়টা মালা জেসমিনকে খুলে বলে। বেশ কয়েক মাস ধরে আশপাশের মেয়েগুলোকে মালা বলে আসছে, ‘যেকোনো দিন আমি আর দুলাল কাজী অফিসে যামু।’ মেয়েরা মালার কথা শোনে, কিন্তু বিশ্বাস করে না। তারা জানে, মালার প্রেমিক একটা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বিশাল দোকানে কাজ করে; কোনোভাবেই তার একজন গার্মেন্টসের মেয়েকে বিয়ে করার কথা নয়। হয়তো মালাও বুঝতে পারে ব্যাপারটা। এ কারণে সে জেসমিনকে তার একটা ফন্দির কথা বলে। সব শুনে জেসমিন ভাবে, মালার প্রস্তাব মন্দ নয়। সে রাজি হয়।
এর দুই দিন বাদে ভরা গ্রীষ্মে দগ্ধ মানুষের মতো ঘামছিল মালা। দুলাল আরও একজনকে চায়। মানে একসঙ্গে তিন বউ। মানে আরেকটা মেয়েকে খুঁজে বের করতে হবে। মালা আর জেসমিন সেলাই মেশিনের পাশে বসা সারি সারি মেয়ের দিকে চোখ বোলাতে থাকে। অবিবাহিত সব মেয়েকেই চেনে মালা। কার একটা রুম দরকার, কার আত্মীয়স্বজন অনাহারে দিন কাটায়, কে আগাম বেতন নিয়ে তা পরিশোধ করার মতো ওভারটাইম করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না—মালা সব জানে। মালা আর জেসমিন প্রথমে ফাতেমা, কেয়া আর কমলাকে পছন্দ করেছিল। কিন্তু কয়েকটা কারণে তাদের সবাইকে বাদ দিতে হয়। এই সারির ঠিক সর্বশেষে যে মেয়েটা কাজ করছিল, সে নতুন এসেছে। প্রথমে তাকে মনে ধরেছিল মালার। কিন্তু পরে দেখা গেল তার এক চোখ খারাপ; চোখের কর্নিয়া সাদা।
প্যান্টির নতুন অর্ডার এসেছে। জেসমিন একটা স্যাম্পল কপি হাতে নিয়ে দেখছিল। এমন প্যান্টি আগে কখনো সে দেখেনি। খুব ভারী। সামনে-পেছনে-নিতম্বের চার দিকটায় পুরুষ্ট প্যাড দেওয়া। প্যান্টিটার পা সেলাই ছাড়াই কাটা। জেসমিন মালাকে জিজ্ঞেস করে, ‘এইটা আবার কী রে?’
‘বিদেশি মেমসাবরা এইডি পরে। ইগুলানরে তারা কয় থ্যাঙ্কস।’ মালা বলে।
‘থ্যাঙ্কস!’ অবাক হয় জেসমিন। মালা বলে, ‘হ, বিদেশি মাইয়ারা এইডি পইরা যহন আয়নার সামনে খাড়ায়, তহন নিজেগো অনেক সোন্দর মনে হয়। এই কারণে তারা এই প্যান্টিরে ধইন্যবাদ জানায়া কয় থ্যাঙ্কস।’ নিজেদের কথায় হেসে ফেলে দুজনই। হাসি ঢাকতে মাস্ক পরে নেয়, পাছে সুপারভাইজার জামাল তাদের হাসি-ঠাট্টা দেখে ফেলে।
জেসমিন ভেবে দেখে স্বামী ভাগাভাগি করে বিয়ে করাটা খুব একটা খারাপ হবে না। প্রেম করে যে বিয়ে হবে এমন স্বপ্ন দেখার সামর্থ্য তার নেই। আর মালার সঙ্গে যদি যৌনতা ভাগ করে নিতে হয়, তাতেও আপত্তি নেই তার। ছুটির পর কারখানার আর সব কর্মীর মতো জেসমিনও হেঁটে বের হচ্ছিল। টঙ্গী থেকে তাকে যেতে হবে উত্তরায়। এই সময় একটা মেয়েকে চোখে পড়ল। মেয়েটার নাম রুবি। কালো কিন্তু ভারি মিষ্টি চেহারা। সাদা ঝকঝকে দাঁত। চোখ দুটো সিনেমার নায়িকাদের মতো। মেয়েটা নতুন এসেছে বলে খাতির জমানোর আগ্রহটা তারই বেশি। মেয়েটা বলে, ‘প্রত্যেক দিন গেরাম থাইক্যা ফ্যাক্টরিতে আসতে দু-তিন ঘণ্টা লাইগা যায়।’ সে জানায়, এখানে তার থাকার জায়গা নেই। জেসমিন ভাবে, থাকার জায়গার কী কষ্ট, সেটা তো সে বোঝে। খালি একটু থাকার জায়গা জোটানোর জন্য তাকে বিয়ে করার কথা ভাবতে হচ্ছে।
যে বছর জেসমিন ঢাকায় আসে, তখন সে তার বাবাকে বলেছিল, সে যেন নাসির চাচাকে বলে তার মেয়ের মোবাইল নম্বরটা দিতে। নাসির চাচার মেয়ে কুলসুম গার্মেন্টসে কাজ করে। জেসমিনের বাবা জেসমিনকে আটকায়নি। তার মা কুঁড়ের সামনের ছোট্ট উঠোনে সরষে নাড়ছিল। সে চিৎকার করে বলছিল, ‘যা, যাইস না ক্যান? আমি তোর মুখ আর দ্যাখতাম না।’ পেছনে না তাকিয়ে চলে এসেছিল জেসমিন। এমন একটা সময় ছিল, মা তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছে—তার মেয়ের বড় ঘরে বিয়ে হবে, রানির মতো থাকবে। সারা গ্রাম বলবে কত বড় কপাল নিয়ে ওর জন্ম হয়েছিল। কিন্তু এই সবই আমিনের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে, সালিসের পর সাজাখানায় কাটানোর আগের কথা।
জেসমিনকে সাহায্য করেছে কুলসুম। কড়াইলে ছোট্ট একটা ঘরে নিজের বাচ্চাকাচ্চা আর শাশুড়ি নিয়ে থাকে সে। স্বামী থাকে বিদেশে। ছোট্ট ঘরটাতে জেসমিনকে মেঝেতে ঘুমানোর মতো জায়গা দিয়েছে কুলসুম। বিনিময়ে থাকা-খাওয়া বাবদ মাইনের অর্ধেক কুলসুমের হাতে তুলে দিতে হয় জেসমিনকে। এত দিন সেখানে থাকায় অসুবিধা ছিল না। কিন্তু এখন কুলসুমের স্বামী দেশে এসেছে। তাই জেসমিনকে খুঁজে নিতে হবে নতুন কোনো আশ্রয়। ফ্যাক্টরির কাছেই একটা ঘর ভাড়া নেওয়ার জন্য গিয়েছিল সে। দেয়ালের মাঝে মাঝে মোটা কাগজ দিয়ে ভাগ করা ছোট ছোট রুম। ওপরে টিন। বাড়িওয়ালা বলেছে, সে আর কোনো অবিবাহিত মেয়েকে ঘর ভাড়া দিতে পারবে না। তার যদি স্বামী থাকত, তাহলে সে ভেবে দেখতে পারত।
জেসমিন যখন ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করে, তখন সে ছিল মালার হেলপার। এর আগেই রানা প্লাজার ধর্মঘট শেষ হয়ে গেছে। ওই দুর্ঘটনায় মালার একটা পা ভেঙে যায়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা মালার ওপর তার ওপরের কর্মকর্তারা নজর রাখে। পা খোঁড়ার কারণে কাজে কমতি হচ্ছে কি না তা সুপার ভাইজার জামাল দেখে সজাগ চোখে। মালা আজকাল বাথরুমে দীর্ঘ সময় কাটায়—এটা জামালের নজর এড়ায়নি। তবে মালার হাত খুবই চালু। সবার চেয়ে সব সময়ই সে সাত-আট পিস মালে এগিয়ে থাকে।
নতুন প্যান্টি ‘থ্যাঙ্কস’ বানানো বেশ ঝক্কির কাজ। এটা সেলাই করার সময় বাম হাত দিয়ে জোরে চেপে ধরতে হয়। একবার কাপড়ের সামনে একবার পেছনে—এভাবে বারবার সেলাই দিতে হয়। পুরো কাপড়টা বারবার সেলাইয়ে শক্ত হয়ে ওঠা পর্যন্ত সেলাই চলে। কাজ করার সময় কায়দা করে একটা প্যান্টি নিয়ে এসেছে জেসমিন। দু-পায়ে গলিয়ে টেনে ওপরে তুলে দেখেছে। তার দুই ঊরুর মাংস এতে যেন একটু ফেঁপে ওঠে। এতে কী এমন বিশেষত্ব আছে বোঝে না সে। ভাবে, হয়তো বিদেশি মেমরা আলাদা ধরনের।
জেসমিন আর মালা এক বিদেশি নারীকে চেনে। তার নাম মিস ব্রিজি। সে একবার ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে এসেছিল আর কর্মীদের নানা ধরনের প্রশ্ন করার পর কী সব লিখছিল খাতায়। ‘দুপুরের খাবার দেওয়া হয় কখন’, ‘টয়লেট কোথায়?’—এসব নানা প্রশ্ন করছিল সে।
জেসমিন মিস ব্রিজিকে ‘থ্যাঙ্কস’ সম্পর্কে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল। কিন্তু প্রশ্নটা আর করা হয় না। তার মাথায় এই চিন্তা ঘুরপাক খায়, সে আর মালা মিলে রুবি নামের নতুন মেয়েটাকে বোঝাবে, সব বুঝিয়ে বলতে হবে। রুবিকে বোঝানোর কাজটা মালাই করে। সে বলে, ‘শোন আমরা তিনজন মিলা তারে বিয়া করমু। হ্যার পর হগলের কাছে কইতে পারমু যে আমরা বিয়াদারি। আমাগো দামান আছে। আমরা পালা কইরা তারে থাকবার দিমু, খাইতে দিমু; মোট কথা একজন ইস্ত্রি তার স্বামীরে যা যা দেয় আমরা তারে তা দিমু। সে যুদি আমাগো লগে শুইতে চায়; আমরা শুমু। আদর করতে চায়, করতে দিমু।’ মালা যৌনতার কথা বলায় জেসমিন টের পায় তার দুই পা-ঊরু থেকে নিচ পর্যন্ত একটা জলজ শিহরণে শিরশির করে ওঠে। রুবির চোখ কেমন ছলছল করে। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ‘আমাগো নিজেগো আলাদা আলাদা স্বামী থাকব না ক্যান?’ রুবির বয়স কম। সে বোঝে না। বুঝতে চায় না। কিন্তু মালা তাকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে রাজি করায়।
বিয়ের ধারণা জেসমিন প্রথম পেয়েছিল আমিনের কাছ থেকে। স্কুলে ভর্তির পর ভালোই লেখাপড়া করছিল জেসমিন। সেখানকার শিক্ষক ছিল আমিন। স্কুল শেষে জেসমিনকে সে দেখা করতে বলত। হাতে ধরে চক দিয়ে স্লেটে এ বি সি ডি লেখা শেখাত। সব সময় তাকে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাইতে বলত।
বিয়ের দিন। দুলাল ফ্যাক্টরির বাইরে এসে হাজির। গায়ে লাল জামা। ওপরে একটা সোয়েটার। জেসমিন, মালা আর রুবি তার সামনে এসে দাঁড়াল। মালা বলল, ‘আমার রাজকুমারের দিকে তুমরা একবার চাও।’ জেসমিন আর রুবি দুলালকে দেখল। চোঙা মুখের ওপর দুটো কালো চোখ পিটপিট করছে। হাতে সময় নেই। কাজী অফিসের উদ্দেশে তারা দুটো রিকশায় চাপল। সামনের রিকশায় মালা আর দুলাল। পেছনে জেসমিন আর রুবি। তিনজনের পরনেই নববধূর মতো লাল শাড়ি। কিন্তু মিষ্টিমুখ করানো কিংবা পায়ে একটু আলতা দিয়ে দেওয়ার মতো একজন স্বজনও তাদের সঙ্গে নেই।
পেছনের রিকশায় বসে জেসমিন সামনের রিকশায় বসা মালা আর দুলালকে দেখছিল। জেসমিন জানে, মালার ভাই রানা প্লাজা ধসে মারা গেছে। আহত হয়েও মালা সেই ধ্বংসস্তূপের সামনে টানা সাত সপ্তাহ ধরে ভাইয়ের ছবি হাতে দাঁড়িয়ে ছিল এই আশায় যে তাকে পাওয়া যাবে। শেষমেশ তাকে কাজে ফিরে যেতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আর দশজনের মতো তাকেও স্বাভাবিকভাবে হাসি-ঠাট্টা করতে হচ্ছে।
আজ সকালে জেসমিন সেই বাড়িওয়ালার কাছে গিয়েছিল। ‘আমি তো আইজই বিয়া করতেছি। এখন কি থাকতে দেবেন?’ জেসমিনের মুখে এই কথা শুনে একবার সন্ধিৎসু চোখে তাকিয়েছে বাড়িওয়ালা। তারপর বলেছে, ‘বিবাহিত? জামাই দেখাও!’ জেসমিন বলল, ‘সামনের সপ্তায় নিয়া আসব।’ জেসমিন ভেবেছিল এই লোক ঘরটা নাও দিতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে লোকটা। এরপরই জেসমিন কুলসুমের কাছে গিয়ে বলেছে, ‘আমি আমার জামাই খুঁইজা পাইছি।’ কুলসুম বলেছে, ‘খুব ভালো। নিশ্চিন্ত করলি। তোর বয়সও হইছে। এহন আর তরে নিয়া কোনো চিন্তা থাকল না।’
আসলে এই মুহূর্তে বিয়েটা জেসমিনের কাছে একটা মুক্তির হাতিয়ারের মতো। সে বোঝে, মেয়ে হয়ে জন্মালে তোমার সামনে হাজার সমস্যা। কিন্তু তোমার যদি স্বামী থাকে, তাহলে সব মুশকিল আসান। বিবাহিতা পরিচয়ে কী কী সুবিধা পাওয়া যায়, তা পেছনের রিকশায় বসে রুবিকে বোঝাচ্ছিল জেসমিন। রিকশাটা পার হচ্ছিল মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে। জেসমিন রুবির কাঁধে হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছিল। হঠাৎ তার মনে হয়, তাদের পোশাক ফ্যাক্টরি সানিটেক্সে যাওয়ার পথে বিস্কুটের ফ্যাক্টরির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বিস্কুটের যে সুগন্ধ নাকে ভেসে আসে, রুবির শরীর থেকে যেন তেমন একটা সুগন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
এক বর, তিন বধূ। তিনজনের মধ্যে একমাত্র জেসমিনই বিয়ের নিবন্ধন খাতায় সই করে। বাকি দুজন টিপসই দেয়। বিয়ে পড়িয়ে কাজী সাহেব যথারীতি টাকা গুনে নেন আর সবাইকে ধরিয়ে দেন একটা করে কাবিননামা। জেসমিন বেশ জোরে জোরে কাবিননামার কথাগুলো সবাইকে পড়ে শোনায়।
কাজী অফিস থেকে বেরিয়ে দুলাল তার তিন বউকে নিয়ে একটা চটপটির দোকানে ঢোকে। সেখানে অপেক্ষা করছিল তার তিন বন্ধু। তিন নববধূকে তারা সবাই ভালো করে আপাদমস্তক দেখে নেয়। কনুই দিয়ে একজন দুলালের পেটে গুঁতো মারে। দুলাল এমনভাবে হাসে, যেন সে নগদ টাকাভর্তি একটা ড্রয়ার এইমাত্র খুলেছে। ‘আগে কে?’ একজন বলে। দুলাল ফিসফিস করে বললেও প্রায় সবাই শুনতে পায়, ‘সবচেয়ে পুরনো জন সবার আগে।’ জেসমিনের দিকে আঙুল তুলে বলে, ‘তারপর ওই জন।’ জেসমিনের মনে পড়ে, কুলসুম তাকে বলেছে, আগামী সপ্তাহে জামাই নিয়ে এলে কুলসুম তার বাচ্চাদের নিয়ে মেঝেতে শোবে। খাটের আধাআধি বরাবর একটা কম্বল টাঙিয়ে দেওয়া হবে। খাটের অর্ধেকে জেসমিন তার স্বামীকে নিয়ে থাকবে। বাকি অর্ধেকে কুলসুমের শাশুড়ি থাকবে।
দুলালের এক বন্ধু রুবির দিকে চেয়ে বলল, ‘শেষজনই খাসা রে!’ দুলাল এমনভাবে রুবির দিকে তাকায়, যেন সে প্রথমবারের মতো রুবিকে দেখছে। সে ঘাড় নেড়ে বলে, ‘হুম, ওইডাই আসল ক্রিম।’
চটপটি খাওয়া শেষে দুলালের হাত ধরে উঠে পড়ে মালা। তারা যাবে মালার বাসায়। এক সপ্তাহ সেখানে থাকবে দুলাল। জেসমিন আর রুবি রওনা হয় কুলসুমের বাসার উদ্দেশে। রুবি নতুন কোনো বাসা না পাওয়া পর্যন্ত সেখানে কটা দিন থাকতে পারবে। বদলে কুলসুমকে থাকা-খাওয়ার টাকা দিতে হবে। রাতে কুলসুমের ঘরের হিমশীতল মেঝেতে শুয়ে পড়ে রুবি আর জেসমিন। ফিসফিস স্বরে বলে রুবি, তার দেশের বাড়ি কুড়িগ্রামে। ছোট তিনটা বোন আছে। সারা বছরই খাওয়া-পরার কষ্ট। জেসমিনের চোখের সামনে ভেসে ওঠে কল্পিত তিন বুভুক্ষু শিশুর হাড় জিরজিরে চেহারা। তার নিজের বাড়ির কথা মনে পড়ে।
‘তোমরা ভাইবোন কয়জন?’ প্রশ্ন করে রুবি। জেসমিন বলে, ‘একটা ভাই ছিল। তারে সাপে খাইছে।’ কবরে শোয়ানোর আগে সাপে কাটা ভাইয়ের সেই ধূসর-নিথর মুখটা ভেসে ওঠে জেসমিনের চোখে।
হিমশীতল মেঝের ওপর এক কম্বলের নিচে শুয়ে রুবির পিঠের উত্তাপ অনুভব করে জেসমিন। খানিক বাদে গভীর ঘুমে হারিয়ে যায় রুবি। তার শ্বাস গভীর হতে থাকে। নিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে উঁচু-নিচু হতে থাকে তার কাঁধ। জেসমিনের চোখে ঘুম নেই। ঠিক এই মুহূর্তে মালা তাদের স্বামীর সঙ্গে কী করছে, সেই কল্পনায় ডুবে যায় সে। তার ঊরুসন্ধির কাছে সেই শিরশির করা ভেজা অনুভূতি বাড়তে থাকে। রুবি হঠাৎ পাশ ফিরে জেসমিনের দিকে মুখোমুখি ঘুরে আসে। তার ঘন আর উষ্ণ নিশ্বাস জেসমিনের মুখে এসে পড়ে। বিস্কুটের মতো সেই সুঘ্রাণ চারপাশে পাক খায় যেন। জেসমিন রুবির এক গোছা চুল টেনে নিয়ে শ্বাস প্রলম্বিত করে গন্ধ শোঁকে; চুলের গোছার প্রান্ত নিজের গালের ভেতর পুরে নেয় সে।
পরদিন সকালে সানিটেক্সের কারখানায় ঢুকে জেসমিন দেখতে পায় মালা তার মেশিনে মাথা নিচু করে যথারীতি কাজ করছে। সে বারবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে মালার; কিন্তু চোখাচোখি হয় না। শিফট শেষ হওয়ার পর মালাকে সে জিজ্ঞেস করে, ‘বাসর রাত কেমন কাটল?’ মালা বলে, ‘মন্দ না।’ ‘শুধু “মন্দ না”।’ জেসমিন জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। জবাবে মিষ্টি করে হাসে মালা। কিছু বলে না।
এক সপ্তাহ কাটল। এবার জেসমিনের পালা। সকালে উঠেই সে দীর্ঘ সময় ধরে ট্যাপে মুখ ধুয়েছে। কুলসুম ধমকাধমকি না করা পর্যন্ত চালিয়ে গেছে রূপচর্চা। পরেছে লাল সালোয়ার-কামিজ। রুবি পরম যত্নে বেঁধে দিয়েছে তার চুল। রুবি যখন তার চুলে বিলি কাটছিল, তখন এক অদ্ভুত ভালো লাগার আবেশ যেন পেলব শিহরণে ভরিয়ে তুলছিল তাকে।
সারা দিন কারখানায় কাজ করার সময় এক অজানা আশঙ্কায় ভরে ছিল জেসমিনের মন। মালাকে সে বলল, ‘আমার কেমন ভয় করছে।’ প্রথমে মনে হয় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল মালা, কিন্তু পরক্ষণেই মেশিনের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে সে বলল, ‘সব নতুন বউই পরথম রাইতে ভয় পায়। ভয় পাইস না। তার সব যন্ত্রপাতিই টিপটপ আছে।’
কুলসুম আজ ঠোঁটে কড়া লিপস্টিক লাগিয়েছে। বাড়িতে নতুন জামাই। সে বাচ্চাদের তাদের ‘খালুজানকে’ কদমবুসি করতে বলে। তারা দুলালের স্যান্ডেল ছুঁয়ে সালাম করে। রাতের খাবারের সময় জেসমিন সবচেয়ে বড় মাংসের টুকরোটা দুলালের পাতে তুলে দেয়। কুলসুমও এক টুকরো পায়। বাকিটা ঝোল। তাই দিয়েই সারা হয় খাবার। পাতলা ঝোল কুলসুমের ছোট বাচ্চাটা খেতে থাকে চেটে চেটে। সেদিকে চেয়ে জেসমিন ভাবতে থাকে রুবির কথা। আজ বৃহস্পতিবার রুবির ছুটির দিন। সে গেছে তার ভাইদের কাছে। জেসমিন চুলে হাত দিয়ে টের পায় রুবির পরিয়ে দেওয়া ক্লিপটা এখনো চুলে ঠিকঠাক বসে আছে।
এবার ঘুমানোর আয়োজন। খাটের মাঝখানে দেয়ালের মতো একটা কম্বল টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু জেসমিন সেই কম্বল ভেদ করে কুলসুমের শাশুড়ির ছায়ামূর্তি দেখতে পায়। বৃদ্ধার এক হাতের কনুই কম্বলের নিচের অংশ দিয়ে বিছানার এপারে চলে আসে। দুলাল পাশ ফিরে দেয়ালের দিকে মুখ করে শোয়। গা থেকে জামাটা খুলে জেসমিনকে পিঠ চুলকে দিতে বলে। জেসমিন দুলালের পিঠের ওপর থেকে নিচে চুলকে দিতে থাকে। শিগগিরই দুলালের গায়ের ময়লায় ভরে যায় জেসমিনের নখ। একসময় জেসমিনের হাত টেনে নিজের বুকের দিকে নেয় দুলাল। দুলালের হাতের ভেতরে জেসমিনের হাত। একধরনের ভালো লাগার উষ্ণতা টের পায় জেসমিন। তার মনে পড়ে আমিনের কথা; এ বি সি ডি লেখা সেই চক, গ্রাম, কুয়াশাসিক্ত ভোরে নতুন মৌসুমের ঝোলা গুড়, তার বাবার বাড়ির মাটির দেয়ালে শুকোতে দেওয়া গোবরের গন্ধ—সব মনে পড়ে। একপর্যায়ে দুলালের নিশ্বাস দীর্ঘ হয়ে আসে; কিন্তু তার পৌরুষ নেংটি ইঁদুরের মতো নরম আর নিস্তেজই থেকে যায়—টের পায় জেসমিন। সে ভাবে দুলাল হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। আর তখনই ঘুরে শোয় দুলাল। জেসমিন টের পায়, একটা ভারী শরীর চেপে বসেছে তার ওপর। জেসমিনের কামিজ টেনে নিচে নামিয়ে ফেলে দুলাল। বুঝতে পারে জেসমিন, দুলাল তার সেই ইঁদুরটা গর্তে পাঠানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু না, কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিস্তেজ হয়ে রণে ভঙ্গ দেয় দুলাল; আবার ঘুরে শোয়। ‘পিঠ চুলকায় দেও।’ দুলালের এই কথায় এবার বিরক্ত হয় জেসমিন। শেষ পর্যন্ত জেসমিনের একটা হাত বগলের নিচে চাপা দিয়ে গভীর ঘুমে ডুবে যায় দুলাল।
ভোরে উঠেই দুলাল উত্তরায় রওনা দেয়। আজ শুক্রবার। উত্তরায় তার এক বোন থাকে। সেখানে ছুটির দিনটা কাটাতে চায় সে। জেসমিন আশা করেছিল আজ সন্ধ্যায় দুজনে মার্কেটে ঘুরবে। তা আর হয় না। দুলাল বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই জেসমিন মহাখালীর বাসে চড়ে সোজা মালার বাসায় চলে আসে। মালা তখন সাজগোজ করছিল। তার ঠোঁটে কড়া কমলা রঙের লিপস্টিক। মোবাইলে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল সে। মালার কথা শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল জেসমিন। কথা শেষ হতেই জেসমিন মালাকে বলে, ‘আমার সঙ্গে এইডা করা কি ঠিক অইছে?’ মালা কাছে এসে বলল, তুই কিছু করতে পারস নাই?
ক্যান, আমার কী করার কথা আছিল?
সে তোরে কিছু করে নাই?
না।
মালা গজগজ করে অস্ফুট স্বরে খিস্তি করে। তারপর বলে, আমি তারে কইছিলাম যে তুই-ই পারবি।
কী পারব?
দুলালের ওই জিনিসটা…মানে…যেইডা সে পারে নাই, ওই অসুখডা তুইই সারায় তুলতি পারবি।
জেসমিন ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে বলে, কিন্তু তুই যে আমারে কইলি তার সবকিছু ফিটফাট আছে!
মুখ শুকিয়ে যায় মালার। সে ভাবতে থাকে সবার মনে যে প্রশ্নটা আসে, সেই আসল প্রশ্নই জেসমিন কখনো তাকে করেনি। যে লোকটা একটা ভালো দোকানে চাকরি করে, সারা দিন যাকে হাতে নোংরা লাগিয়ে কাজ করতে হয় না, সে কেন মালার মতো একজন প্রতিবন্ধী গার্মেন্টস-কন্যাকে বিয়ে করতে চাইবে? মালা বলে, ‘সে আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে ক্যান জানিস? আমি তারে টাকা দিতাম বইলা।’
তুই টাকা দিতি?
হ, দিতাম। এরপর সে আরও চায়, আরও চায়। আমি আরও টাকা কই পামু? পরে তারে কইছি তোরে আর রুবিরে দিমু। এইডা ছাড়া তারে ধইরা রাখার আর কোনো পথ ছিল না।
বলতে বলতে কেঁদে ফেলে মালা।
জেসমিন ভাবে, দুলালের উত্থানজনিত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা ছাড়া আপাতত কোনো পথ খোলা নেই। বর্তমানে তার সঙ্গে তাদের বিয়ে হয়েছে। দুলালের সমস্যা তাদেরও সমস্যা।
আচ্ছা, এখন কী করমু? জিজ্ঞাসা করে জেসমিন।
আবার চেষ্টা কর।
মালা তার হাতের লিপস্টিকের টিউবটা বের করে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে বলে, ‘এইভাবে।’
সেই রাতে কুলসুমের কাছে তার সুগন্ধির শিশিটা চায় জেসমিন। খাটের নিচ থেকে কুলসুম শিশিটা বের করে দেয় বিরক্তিভরা মুখে। জেসমিন খানিকটা সুগন্ধি লাগায় তার ঘাড়ে। চোখে বড় করে কাজল পরে। গাঢ় করে লাগায় লিপস্টিক। দুলাল ভাত খেয়ে কুলি করার জন্য ঘরের সামনের ড্রেনের পাশে এসে দাঁড়ায়। জেসমিনও ড্রেনের পাশে এসে দাঁড়ায় দুলালের গা ঘেঁষে। জিজ্ঞাসা করে তার বোন কেমন আছে? ‘আলহামদুলিল্লাহ্, ভালো আছে।’ দুলাল শীতে কাঁপতে কাঁপতে বলে, ‘এমুন শীত পড়ছে, দ্যাখছ, হাড় পর্যন্ত খবর অইয়া যাইতাছে।’
শীতের কথায় গ্রামের কথা মনে পড়ে জেসমিনের। এই রকমের শীতের মৌসুমেই তার মা বাড়ির সামনের খেতে তিলের চাষ করেছিল। ফলন হয়েছিল ভালো কিন্তু বাজারে দাম পড়ে যাওয়ায় খরচের টাকাও ওঠেনি। ওই তিল কাটার পর আর সেখানে চাষ করেনি তারা। কিন্তু কাটা গোড়ার পাশ দিয়ে নতুন নতুন ডগা বেরিয়েছিল। সেই ডগা বড় হয়ে তৈরি হয়েছিল বেশ জঙ্গল-জঙ্গল পরিবেশ। তবে আমিনই ভালো করে জানত, কী করে খুব সন্তর্পণে বিলি কেটে ওই ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়া যায়। সেখানে আমিন নিয়ে যেত তাকে। আমিনের তুলতুলে পায়ের তালু নিজের দুই গালে বুলাত জেসমিন। আমিন বলত, লাইলি-মজনুর প্রেমকাহিনি বলার জন্য সে সেখানে তাকে ডেকেছে। সাপের উদরে ইঁদুর যেভাবে ধীরে ধীরে ঢুকে যায়, ঠিক একইভাবে পুরুষের নাগপাশে একজন নারীর নিজেকে সমর্পণ করার কৌশল আমিনের কাছ থেকেই প্রথম শিখেছিল জেসমিন। স্কুলমাস্টার আর চাষির মেয়ের বিভেদ দূরে সরিয়ে আমিন যখন তার পায়ের বুড়ো আঙুল জেসমিনের গালে বোলাত; জেসমিন তখন আমিনের পায়ের গোড়ালিতে জিহ্বা লাগিয়ে উপভোগ করত মাদকতায় ভরা নোনা স্বাদ। সে যখন আমিনকে জিজ্ঞাসা করত, তাকে বিয়ে করবে কবে? আমিন এমন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ত, যেন এর চেয়ে হাসির কথা জীবনে শোনেনি সে। তারপর শেষ পর্যন্ত সালিসে গেল আমিনের বউ। সালিসে সাব্যস্ত হয়, ফুসলিয়ে জেসমিনই বিপথে নিয়েছে আমিনকে। তাই সাজা হিসেবে তাকে গ্রাম থেকে চলে যেতে হবে। আর যাওয়ার আগে তাকে ঢুকতে হবে গ্রামের মাতব্বরের ‘সাজাখানা’ বলে পরিচিত একটি ঘরে। সাজাখানা থেকে বেরোনোর পর জেসমিনকে এত বিধ্বস্ত ও কুৎসিত মনে হচ্ছিল, যেন সে সাপের মুখে ধরা এক অসহায় ইঁদুর।
মালা যখন জেনেছিল, রানা প্লাজার উদ্ধারকাজ শেষ এবং তার ভাইকে আর কোনো দিনই পাওয়া যাবে না, সে মুষড়ে পড়েছিল। জেসমিন ভাবতে থাকে, যদি এমন ধরনের কোনো ঘটনা দুলালের জীবনে ঘটত, তাহলে বড় বড় রাঘব-বোয়ালের মধ্যে নিজেকে হয়তো সে চুনোপুঁটি ভাবত। ক্ষুদ্রতার অনুভূতি তাকে যদি গ্রাস করত…মালা ভাবতে থাকে। ভাবতে ভাবতে জেসমিন অন্ধকারে দুলালের দিকে এগিয়ে যায়। কাছে আসার পর দুলাল তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুই মালারে কী কইছস?’
অপ্রস্তুত হয়ে যায় জেসমিন। সে বলতে থাকে ‘না, মানে বলছি কি যে সমস্যা তুমার না।’
দুলাল এগিয়ে আসে। রাগে ভারী হয়ে ওঠে তার নিশ্বাস। সেই ক্রোধভরা চোখ দেখে শঙ্কিত হয় জেসমিন। হঠাৎ কোনো কথাবার্তা ছাড়াই ঠাস করে প্রচণ্ড থাপ্পড় পড়ে জেসমিনের গালে। জেসমিন যখন চোখ মেলে, তখন দেখতে পায় কুলসুম, কুলসুমের শাশুড়ি ও বাচ্চারা এবং দুলাল ঘিরে আছে তাকে। উঠে বসে জেসমিন। চুল ঠিক করে দাঁড়ায়। কেউ কিছু বলে না। জেসমিন টের পায় তার ঠোঁটে রক্ত আর লিপস্টিক লেপ্টালেপ্টি হয়ে আছে।
সকালে কারখানায় যাওয়ার পর জেসমিনকে সুপারভাইজার জামাল একেবারে পেছনে বসায়। তার মুখের এক পাশ ফুলে ঢোল হয়ে আছে। ভয়ানক লাগছে। জামাল বলে, ‘তরে এক্কেরে বাদুড়ের মতন লাগতাছে। তর আইজ না আসাই ভালো আছিল।’ রুবি আজ গ্রাম থেকে এসেছে। জেসমিনকে এই অবস্থায় দেখে প্রায় কেঁদে ফেলে সে। ‘চিন্তা করিস না।’ তাকে বলেই জেসমিন বাথরুমে যায়। ফিরে এসে দেখে রুবি একটা আইসক্রিম কিনে এনেছে। জেসমিনের ফোলা জায়গায় আইসক্রিম চেপে ধরে রুবি। একটু বাদে আইসক্রিমটা ভেঙে খায় দুজনে।
যেদিন রুবির পালা, সেদিন দুলাল এসে ফ্যাক্টরির গেটে এসে দাঁড়ায়। জেসমিন দূর থেকে দেখে। রুবিকে এগিয়ে আসতে দেখে চকচক করে ওঠে দুলালের চোখ। কিছু একটা বলে রুবি। শুনে দুলাল খিলখিল করে হেসে ওঠে। তাদের দুজনকে হাত ধরাধরি করে হাসতে হাসতে চলে যেতে দেখে জেসমিন। তার পাঁজরের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। মনে হয়, এই হাসি তার দিকে চরম তাচ্ছিল্য ছুড়ে দিচ্ছে। তার মনে পড়ে সালিসের পর তাকে যখন সাজাখানায় নেওয়া হয়; সেখানে সবচেয়ে বুড়ো লোকটা তাকে সবার সামনে বিবস্ত্র হতে বলেছিল। আমিনসহ অন্যরা তাকে বিবস্ত্র করে ঘিরে ধরে হাসছিল খিলখিল করে। চরম অপমানজনক কথা বলছিল। সেই বীভৎস হাসি যেন সে চোখের সামনে দেখতে পায়। সেই হাসি থেকে মুক্তির জন্য দুই হাতে কান চেপে ধরে সে।
আজ শুক্রবার। জেসমিন নিজের কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিয়ে কুলসুমকে বিদায় জানিয়ে এসেছে। বাড়িওয়ালাকে আগাম ভাড়া দিয়ে নতুন বাসায় উঠেছে সে। স্যাঁতসেঁতে একটা কামরা। কোনায় একটা ছোট চৌকি পাতা। যত ছোট হোক, তবু তো নিজের বাসা। নিজের ঘর। জেসমিন কাপড়চোপড়ের ট্রাঙ্কটা খোলে। সে যে এক জোড়া থ্যাঙ্কস চুরি করে এনেছিল, বের করে সেটা। দরজা বন্ধ করে এসে পা থেকে স্যান্ডেল, গা থেকে সালোয়ার খুলে ফেলে। মেঝেতে শুয়ে পড়ে দুই পায়ে গলিয়ে পরতে থাকে সেটা। প্যান্টিটা পরে দাঁড়ায় জেসমিন। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে নিজেকে। হঠাৎ সে যেন শুনতে পায় হাসির শব্দ। এই হাসি সালিসের সেই বিদ্রূপমাখা কুৎসিত হাসি নয়। এ তার নিজেরই হাসি। জেসমিন জানে, রুবি দুলালের শারীরিক সমস্যা দূর করতে পারবে। সুখী হবে তারা দুজন। দুলাল রুবিকে তার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত দোকানে বেড়াতে নিয়ে যাবে। রুবির ছোট বোনগুলো আর না খেয়ে থাকবে না। অন্যদিকে জেসমিন পড়ে থাকবে এখানেই। এখানে সে কোনো সাজাখানার মেয়ে নয়। এখানে সে এক গার্মেন্টসের মেয়ে, যার নিজের একটা ঘর আছে, আছে নিজের একটা শরীর।
জেসমিন টের পায়, দরজা খুলে যাচ্ছে। বাতাসে ভেসে আসছে বিস্কুটের ঘ্রাণ। জেসমিন প্রাণভরে সেই শ্বাস টেনে নেয়। #
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ