নামে সাধারণ, আসলে অসাধারণ

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ নাম ‘রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগার’ হলেও আসলে এটি একটি অসাধারণ গ্রন্থাগার। কারণ, গ্রন্থাগারটি বয়ে চলেছে সুদীর্ঘ শতাব্দিকালেরও বেশি সময়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

যাত্রা শুরুর সময়টি ধরলে বর্তমানে রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারের বয়স ১৩৩ বছর। রাজশাহীর এই হেরিটেজটি এবার ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে পরিচালনা পর্ষদ। গত ১৮  সেপ্টেম্বর রাজশাহীর দুটি স্থানীয় দৈনিকে ভেঙে ফেলা ও অপসারণের জন্য টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। শিগগিরই এটি ভেঙে সেখানে বহুতল কমপ্লেক্স করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে সেখানে কমপ্লেক্সটি নির্মাণ করা হবে।

সুদীর্ঘ সময়ের ঐতিহ্য বহনকৃত প্রতিষ্ঠানটি ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেওয়ায় রাজশাহীর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মহলে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

১৮৮৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করলেও গ্রন্থাগারটির সূচনা আরও আগে। দীঘাপাতিয়ার জমিদার রাজা প্রমদানাথ রায়ের দান করা জমিতে কাশিমপুরের জমিদার রায় বাহাদুর কেদার নাথ প্রসন্ন লাহিড়ী এই গ্রন্থাগারটি স্থাপন করেছিলেন । রাজশাহী মহানগরীর মিয়াপাড়ায় অবস্থিত বলে এটিকে ‘মিয়াপাড়া সাধারণ গ্রন্থাগার’বলেই চেনেন অনেকে।

রাজশাহীর জেলা প্রশাসক ও গ্রন্থাগারের সভাপতি হেলাল মাহমুদ শরীফ জানান, গ্রন্থাগার ভবনটির অবস্থা মোটেই ভালো না থাকায় সেটি ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ জন্য অর্থও পাওয়া গেছে। তবে এটির যেহেতু ঐতিহাসিক মূল্য আছে, সে কারণে তার একটি রেফ্লিকা তৈরি করা হবে। যেন পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারে আগে গ্রন্থাগারটি কেমন ছিল।

ঐতিহাসিকভাবে এই গ্রন্থাগারটি এ অঞ্চলের হেরিটেজ। ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট বইতে এই গ্রন্থাগারের উল্লেখ রয়েছে। মূলত ভবন এবং জমি পাওয়ার পর ১৮৮৪ সালে গ্রন্থাগারটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়।

হান্টারের বইয়ের তথ্য মতে, ১৮৭১-৭২ সালে এই গ্রন্থাগারটিতে বই ছিল মাত্র ৩,২৪৭টি এবং সাময়িকী ছিল ছয়টি। এ সময় পাঠক ছিল নয়জন। এর মধ্যে ছয়জন ছিলেন ইংরেজ। রাজা আনন্দ রায়ের পরে তার ছেলে রাজা চন্দ্র রায় বছরে ২০ পাউন্ড বা ২০০ টাকা অনুদান দিতেন। এক সময় এই গ্রন্থাগারটি পুরাতন বাস স্ট্যান্ডের কাশিমপুর হাউসে ছিল ।

পরে দিঘাপতিয়ার রাজা প্রমদা নাথ রায়ের দান করা বর্তমান ভবনে মিয়াপাড়ায় স্থানান্তরিত হয়। তার চার ছেলে রাজা প্রমদনাথ রায়, কুমার বসন্ত কুমার রায়, কুমার শরৎ কুমার রায়, কুমার হেমন্ত কুমার রায় এবং মেয়ে রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা রায় রাজশাহীর অন্য প্রতিষ্ঠানের মতো এই গ্রন্থাগারটিতেও বিভিন্নভাবে সহায়তা দিতেন।

আগে জেলা প্রশাসন, রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন এবং জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে নিয়মিত অনুদান পাওয়া যেতো। এখন শুধু জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে বছরে অনুদান পাওয়া যায় ৬০ হাজার টাকা। এর মধ্যে বই হিসেবে দেওয়া হয় ৩০ হাজার টাকা এবং নগদ অনুদান পাওয়া যায় ৩০ হাজার টাকা।

এখানকার শতকরা ৫০ ভাগ বই-ই দুষ্পাপ্য ও দুর্লভ। গ্রন্থাগারের বয়স ১৩৩ বছর হলেও এখানে ২০০ বছরের পুরনো বইও আছে। স্কটল্যান্ড থেকে প্রকাশিত শেক্সপিয়ার গ্রন্থাবলী প্রথম সংস্করণ, অ্যানুয়াল রেজিস্ট্রার, মাইকেল মধূসূদন দত্তের ‘একেই বলে সভ্যতা’র প্রথম সংস্করণ, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’ এর প্রথম সংস্করণ, বৃটিশ আমলের পত্রিকা ভারতবর্ষ, শনিবারের চিঠি, বসুমতি, রিভিউ প্রভৃতি দুষ্পাপ্য গ্রন্থ ও পত্রিকা থাকার কারণে বহু গবেষকের আগমন ঘটে এখানে।

মহাত্মা গান্ধী, সরোজিনী নাইডু, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ বহু গুণী মানুষের আগমন ঘটেছিল এই গ্রন্থাগারে। ফলে গ্রন্থাগারটি ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেওয়ায় ক্ষুব্ধ রাজশাহীর সংস্কৃতি কর্মীরা। ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি ভেঙে কমপ্লেক্স নির্মাণের বিরোধিতা করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তারা।

ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে রাজশাহীর উদীয়মান কবি ও সংবাদকর্মী শামীম হোসেন বলেন, ‘এ ভবনটি ভেঙে নতুন কমপ্লেক্স তৈরি হবে। আমি বরাবরই ঐতিহ্য রক্ষা করে উন্নয়নের পক্ষে। যদি নতুন কিছু করতেই হয়, তবে মূল ভবন সংস্কার করে গ্রন্থাগারের পেছনে বিশাল জায়গা ফাঁকা আছে- বরং দৃষ্টিনন্দন করে সেখানেই তা তৈরি করা হোক। একটু অনুসন্ধানী চোখ দিয়ে তাকালেই আমরা দেখতে পাবো এর আগেও রাজশাহীর ঐতিহাসিক কিছু স্থাপনা ভেঙে তৈরি করা হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।’

ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখক চন্দন আনোয়ার তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘শত বছরের উপরের এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা, যেখানে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত কবিতা পাঠ করেছেন, আরও বড় বড় মনীষীদের স্মৃতিজড়িত, এরকম একটি স্থাপনাকে নতুনভাবে করার নামে ভেঙে ফেলা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। বরং পাশেই আর একটি নতুন স্থাপনা হোক।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক সুজিত সরকার তার দেওয়া স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘ অলকা সিনেমা হলটি এক সময় রাজশাহীর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল। সেটি ভেঙে মার্কেট করে দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, যারা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি তৈরি করেছিলেন, তাদের নামটিও মুছে ফেলা হয়েছে। এভাবেই ইতিহাস-ঐতিহ্য মুছে যায়।’

গবেষক জুলফিকার মতিন লিখেন, ‘বই পড়া থাকবে কি থাকবে না, তা নিয়ে উচ্চাভিলাষী কল্পনা করার ব্যাপার এটা নয়। প্রশ্নটা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন বাঁচিয়ে রাখার। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রাখার। বিবেচনাটা হওয়া উচিৎ তাই।’

পরিচালনা পর্ষদের মতো রাজশাহী সিটি করেপারেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলও ভবনটি ভেঙে ফেলার পক্ষে মত দিয়েছেন।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts