শীত ও গ্রামীণ জীবনের আনন্দ-বেদনা কাব্য ॥শিউল মনজুর

শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন
আমলকীর এই ডালে ডালে
পাতাগুলো শিরশিরিয়ে
ঝরিয়ে দিল তালে তালে।

এখন শীতকাল। কুয়াশার চাঁদর মুড়ি দিয়ে শীতের আমাদের দুয়ারে উপস্থিত। এই শীত শহরের মানুষের মধ্যে যতনা প্রভাব ফেলে তার চেয়ে বেশি গাই-গেরামের মানুষের জীবন যাপনে প্রভাব ফেলে সবচেয়ে বেশি। শীত ঋতু বিচিত্র অনুভূতি নিয়ে মানুষের জীবনে উপস্থিত হয়। পৌষ-মাঘ এই দুই মাস শীতকাল। শীতের আগমণে গাছ পালার সবুজ পাতা ঝরে যায়। শুকনো পাতার মর্মর শব্দ কানে লাগে। উত্তরের ঠান্ডা বাতাস শরীরের রক্ত কণিকায় কাঁপন ধরিয়ে দেয়। এ সময় গরীব সাধারণ মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না।

পঞ্চগড়, দিনাজপুর, বগুড়া, রঙপুর, নীলফামারী, তেতুলিয়া, শ্রীমঙ্গল, রাজশাহী, মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে শীত ঝাকিয়ে বসে। প্রায় প্রতিবৎসর এসব জায়গায় শীতের কষ্টে শিশু-বুড়োরা বেশি কষ্ট পায়। বিভিন্ন শীত রোগে আক্রান্ত হয়। সর্দি, কাশি, জ¦র লেগে থাকে। এ্যাজমা রোগীদের কষ্টের সীমা থাকে না। অসংখ্য মানুষও শীতের তীব্রতায় মারা যায়।

কনকনে ঠান্ডার এই উপদ্রব দেখে, একজন কবি বলেছেন,
হিম হিম শীত শীত
শীত বুঝি এলোরে
কনকন ঠান্ডায়
দমবুঝি গেলরে।

শীতের যন্ত্রণা শুধু মানব জীবনে প্রভাব ফেলেনা প্রকৃতিতেও এর প্রভাব দারুণ রকম লক্ষণীয়। এই ঋতুতে খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর-ডোবা অনেকাংশে শুকিয়ে যায়। নদ-নদীর বুকে বড় বড় চর জাগে। লঞ্চ, স্টীমার, ফেরি, ছোট বড় জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। গ্রামের মানুষের যাতায়াতে তখন অনেক কষ্ট পোহাতে হয়। দূরপথ ঘুরে যেতে হয় আত্মীয় কিংবা বন্ধুর বাড়ি।

গ্রামীন জনপদে শীতের এতো এতো কষ্ট থাকা সত্ত্বেও এই ঋতু মানুষের জীবনে আনন্দেরও বার্তা নিয়ে আসে। এই আনন্দও কিন্তু কম নয়। পাতাঝরা দিনেও গ্রামের লক্ষ লক্ষ কৃষক ভাইয়েরা অল্প পরিশ্রমে মাঠে-ঘাটে নানা রকম শীতের শাক্ সবজি চাষ করেন।

এ সময় গ্রামের মাঠে মাঠে, বাড়ির আঙিনায়, রাস্তার আশে পাশে লালশাক, লাইশাক, সরিষা, বেগুন, টমেটো, ফুল কপি, বাধা কপি, বিভিন্ন জাতের লাউ, কদু, বিভিন্ন জাতের শিম, ধনে পাতা প্রভৃতির ব্যাপক চাষ আমরা লক্ষ্য করি। ফসলের বিচিত্র রূপ দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে যাই। গ্রামের এসব ফসল প্রতিদিন গাড়ি ভর্তি করে শহরে বিক্রির জন্যে চলে যায়। কৃষকরা প্রচুর লাভও পান। এসব ফসলের পুষ্টিগুণ বলে শেষ করা যাবে না। শীতকালীন এসব শাক-সবজি বা ফসল খেয়ে বাংলার মানুষ তাদের স্বাস্থ্যকে সতেজ রাখে।

তাছাড়া, এ সময় পুকুর-ডোবা, নদ-নদী ও বিলের পানি শুকিয়ে যাবার কারণে মাছ শিকারের ধুম লেগে যায়। নানা ধরণের ছোট মাছ যেমন পুটি, মলাডেলা, টেংরা, কাচকি, চিংড়ি, তেলাপিয়া ইত্যাদি পাওয়া যায়। সেই সাথে বোয়াল, কালা বাউশ, ষোল, আইড়, চিতল, রুই, পাঙ্গাস, বাইন, বাঘা সহ নানা ধরণের বড় বড় ভিন্ন স্বাদের প্রচুর মাছ পাওয়া যায়।

অর্থ্যাৎ এ সময় শাক-সবজি, নানা ফসল ও প্রচুর মাছ থাকায় এবং দ্রব্যমূল্য মোটামুটি কম থাকায় সব পেশার মানুষ আনন্দের ভেতর দিনযাপন করে।

 

 

এ ঋতুতে আরেকটি আনন্দেও বিষয় হলো  ক্ষেতের নতুন পাকাধান গ্রামের প্রায় বাড়িতে থাকে। সেই সাথে খেজুর গাছের রস দিয়ে বিভিন্ন জাতের গুড় যেমন- খেজুরের গুড়, মইরছা গুড়, পাঠালি গুড় ইত্যাদি তৈরী করা হয়। বাজার থেকে সংগ্রহ করে এসব গুড় ও চালের গুড়া দিয়ে নানাজাতের ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের পিঠা বাড়িতে বাড়িতে তৈরী করা হয়। পিঠাগুলোর নামও ভিন্ন ভিন্ন।

যেমন- ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা, রসের পিঠা বানানো হয়। এগুলো বাংলার ঐতিহ্যবাহী পিঠা। গুড় ছাড়াও আরো নানাজাতের পিঠা এসময় বানানো হয়। এগুলোও খেতে অত্যন্ত স্বাদযুক্ত। এই পিঠাগুলো গ্রামের মানুষ শুধু নিজেরা খেয়ে আনন্দটা একা একা ভোগ করে না, দূর-দূরান্তের আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতেও তারা পাঠায়। তখন শীত ঋতুটা আনন্দময় হয়ে ওঠে।

pitha

শীতে মানুষের জীবন চিত্রটা সত্যি অন্যরকম। বাড়ির উঠোনে, পুকুর ঘাটে, বাজারে, রাস্তার পাশে খড়-কুঠো জালিয়ে গোল হয়ে বসে গ্রামের সাধারণ মানুষ শরীরটাকে উষ্ণ করার চেষ্টা করে। এটাও এক ধরণের আনন্দময় চিত্র এবং অবশ্যই ব্যতিক্রমই দৃশ্য।

আবার সকালবেলা যখন কুয়াশাচাদর ভেদ করে বাড়ির উঠোনে কিংবা পুকুরঘাটে রোদ নেমে আসে তখন শিশু-জোয়ান-বুড়ো সবাই রোদ পোহানোর জন্যে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এ ঋতুতে নানা ধরনের খেলায় মেতে ওঠে গ্রামের ছেলে মেয়েরা। ধান কাটা ক্ষেতে হাডুডু, দাড়িয়াবাধা, ফুটবল, ব্যডমিন্টন ইত্যাদি তারা খেলে অতি আনন্দে দিন পার করে।

আবার অনেক বাড়িতে এসময় জারিগান, পালাগান এর আসর বসে, বিভিন্ন জায়গায় মেলাও হয়। কোথাও আবার যাত্রাপালাও অনুষ্ঠিত হয়। তবে এসময়টাতে গ্রামে গ্রামে ধর্মপ্রাণ মুসলিম সমাজ ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করে মহান আল্লাহতায়ালার প্রশংসা প্রচার করে।

মোট কথা, প্রকৃতিতে জীর্ণশীর্ণ ভাব থাকলেও গ্রামের মাঝে একটা উৎসব উৎসব পরিবেশ বিরাজ করে। এই উৎসব ভাবটা আগামি বসন্ত ঋতু পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে বিরাজ করে। শীতের সৌন্দর্য ও মাধুর্য যেনো গ্রামে ভেতর ফুটে ওঠে।

শীতের কল্যাণে গ্রাম যেনো সত্যিকার অর্থেই নতুন উদ্দীপনায় জেগে ওঠে। এক কথায় শীত ঋতু গ্রামের মানুষের নিকট, কিছুটা কষ্ট কিংবা বেদনার হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অত্যন্ত আনন্দের।

শিউল মনজুর   সহকারী অধ্যাপক, রাগীব-রাবেয়া ডিগ্রি কলেজ, সিলেট।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts