বিডি মেট্রোনিউজ, নারায়ণগঞ্জ ॥ রাত সাড়ে তিনটা থেকে পরের দিন সকাল সাড়ে সাতটা মাত্র ৪ ঘন্টায় মামীর প্রতি আসক্তি থেকে ৫টি খুনের ঘটনা ঘটায় ভাগনে মাহফুজ। একটি খুনের পর স্বাক্ষী হওয়ায় একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটিয়ে চলে মাহফুজ। যা অনেক লোমহর্ষক কাহিনীকেও ছাড়িয়ে যায়। নারায়ণগঞ্জের বাবুরাইল এলাকায় পাঁচ খুনের ঘটনায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে আসামি মাহফুজ ওরফে মোশারফ।
বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতে সাড়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী জবানবন্দিতে মাহফুজ জানান, মামি লামিয়ার প্রতি অনৈতিক আসক্তি মেটাতে ১৫ জানুয়ারি শুক্রবার সন্ধ্যায় সে ওই বাড়িতে যায়। পরে রাতের দিকে সে ধরা পড়ে যায়। এর পরেও তাকে কঠোর কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি। কিন্তু আবারো পারিবারিক শাস্তি ও অপমানের আশঙ্কা থেকে সে একাই একে একে ঠান্ডা মাথায় পাঁচজনকে খুন করে। এর সঙ্গে অন্য কেউ জড়িত না।
ওই রাতেই সাড়ে তিনটা থেকে পরের দিন সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে দুই শিশুসহ পাঁচজনকে নির্মমভাবে খুন করে মাহফুজ। তবে এ ঘটনায় গ্রেফতার নাজমা বেগমের কোনো সংশ্লিষ্টতার কথা বলেনি মাহফুজ। হত্যাকাণ্ডের শিকার তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র শান্ত ঘটনার সময়
স্কুলে গেলেও ওইদিন স্কুলে কোনো ক্লাস না হওয়ায় সে বাসায় ফিরে আসে। ঘটনা দেখে ফেলায় তাকেও খুন করা হয়।
ঘাতক মাহফুজ মামলার বাদী শফিকুল ইসলামের বোনের ছেলে। মামলার এজাহারে হত্যাকাণ্ডে মাহফুজকে সন্দেহের কথা উল্লেখ করা হয়। গত ১৮ জানুয়ারি মাহফুজকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করে পুলিশ। আদালত মাহফুজকে সাত দিনের পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করে। রিমান্ডের চারদিনের মাথায় আদালতে স্বীকারোক্তি দিল মাহফুজ।
দুপুর সাড়ে এগারোটা থেকে তিনটা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাঈদুজ্জামান শরীফের আদালত এই জবানবন্দি গ্রহণ করে।
আদালত সূত্র ও পুলিশ জানায়, স্বীকারোক্তিতে মাহফুজ হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেন, গত শুক্রবার মাহফুজ নিশ্চিত হন ওই দিন রাতে তার দুই মামা বাড়িতে থাকবেন না। বড় মামা শফিকুল ইসলাম ঢাকায় এবং ছোট মামা শরীফুল ইসলাম ত্রিশালে একটি কাজে যাবেন। এই সুযোগে সে চিন্তা করে ছোট মামীর সঙ্গে রাতে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে।
শুক্রবার সন্ধ্যায় মাগরিবের আযানের আগ মুহূর্তে সে মামা শফিকুলের বাড়িতে যায়। দরজা খুলে দেয় শান্ত। সে শান্তকে সঙ্গে নিয়ে লামিয়ার ঘরে গিয়ে অবস্থান নেয়। সে যে এসেছে এটি না বলার জন্য শান্তকে দশ টাকা দেয়। শান্ত চলে যাওয়ার পর সে ওই ঘরের খাটের নিচে গিয়ে ঘাঁপটি মেরে থাকে। এ সময় অন্য ঘরে তাছলিমা, লামিয়াসহ অন্যরা টিভি দেখছিল। টিভি দেখা শেষ করে তারা খেতে বসে।
এ সময় সে খাটের নিচ থেকে বের হয়ে দরজার কোনায় দাঁড়িয়ে তাদের খাওয়া-দাওয়া দেখে মাহফুজ। খাওয়া শেষ করে তারা আবারও টিভি দেখতে বসে। এভাবে রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত তারা টিভি দেখে। টিভি দেখা শেষ করে লামিয়া তার কক্ষে না এসে তার জা তাছলিমার কক্ষেই ঘুমিয়ে পড়ে। লামিয়ার কক্ষে ঘুমাতে আসে তাছলিমার ভাই মোর্শেদুল ইসলাম। এ সময় তাছলিমা এসে তার ভাইকে বিছানা করে দেয়। লামিয়া না আসায় মনে মনে ক্ষিপ্ত হয় মাহফুজ। এক পর্যায়ে তার প্রস্রাবের বেগ আসলে সে খাটের নিচ থেকে বের হওয়ার সময় মাথা খাটের সঙ্গে লেগে শব্দ হয়। মোর্শেদুল খাটের নিচে তাকিয়ে দেখেন মাহফুজ খাটের নিচে লুকিয়ে আছে।
তখন খাটের নিচ থেকে তাকে টেনে বের করে আনেন মোর্শেদুল। তাছলিমাকে ডেকে এনে বিষয়টি জানান। এরপর দু’জনে মিলে মাহফুজকে প্রচণ্ড বকাঝকা করেন। তবে রাত গভীর হওয়ার কারণে তাকে বের করে দেয়নি তারা। এলাকায় নিজেদের মান-সম্মানের ভয় এবং সম্পর্কে ভাগিনা হওয়ার কারণে তাকে মোর্শেদুলের সঙ্গে একই খাটে ঘুম পারিয়ে রাখে তারা। মোর্শেদুল ঘুমিয়ে পড়লে মাহফুজ উঠে পড়ে এবং টয়লেটে গিয়ে সিগারেট খেতে খেতে হত্যার পরিকল্পনা করে। টয়লেটের দরজার ফাঁক দিয়ে রান্নাঘরের শিল-পাটা দেখতে পায়।
টয়লেট থেকে বের হয়ে সে রান্না ঘরে যায়। সেখান থেকে শিল নিয়ে এসে বালিশের পাশে রেখে শুয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর উঠে মোর্শেদুলের মাথায় শিল দিয়ে আঘাত করে। এ সময় মোর্শেদুল চিৎকার করে উঠলে মাহফুজ একটি শার্ট এনে মোর্শেদুলের মুখে ঢুকিয়ে দেয়। তার শার্ট দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে। এর পরপরই ফজরের আজান হলে মাহফুজ অস্থির হয়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করে। আবার কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে।
ভোর সাড়ে ৬টার দিকে বড় মামি তাছলিমার মোবাইল ফোনে অ্যালার্ম বেজে ওঠে। ঘুম থেকে জেগে ওঠেন তাছলিমা। মোর্শেদুলের ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে মাহফুজ দেখতে পায় তাছলিমা ছেলে শান্তকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছেন। তাকে দাঁত ব্রাশ করানোর পর রান্না ঘরে বসিয়ে খাইয়ে দেন। এরপর স্কুল ব্যাগ কাঁধে দিয়ে ছেলেকে স্কুলে পাঠান। শান্তকে স্কুলে পাঠিয়ে তাছলিমা আবার গিয়ে শুয়ে পড়েন।
এরপর মাহফুজ ভাবে- রাতে তার খাটের নিচে লুকিয়ে থাকা বিষয়টি তাছলিমা জানে। আর মোর্শেদুলকে যেহেতু সে খুন করেছে, তাই এ হত্যার জন্য তাকেই দায়ী করে মামী তাছলিমা সবাইকে বলে দেবে। এ কারণে মামীকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন মামীর কক্ষে গিয়ে সে বলে যে, মোর্শেদ মামা আপনাকে ডাকছে। তাছলিমা ঘুম ঘুম চোখে মোর্শেদুলের কক্ষের সামনে গিয়ে তাকে ডাকতে থাকে। এ সময় মাহফুজ দরজার আড়াল থেকেই তাছলিমার মাথায় শিল দিয়ে আঘাত করে। তাছলিমা ফ্লোরে পড়ে গেলে সে একটি কাপড় এনে তার গলায় পেঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে।
এদিকে তাছলিমাকে আঘাত করার পর তার চিৎকার শুনে লামিয়া জেগে ওঠে। তখন লামিয়ার কক্ষে মাহফুজ শিল নিয়ে ঢুকে পড়লে তাকে দেখে লামিয়া খাটের উপরে দাঁড়িয়ে যায়। মাহফুজ এ সময় লামিয়ার মাথা লক্ষ্য করে প্রথমে শিল ছুড়ে মারে। এরপর লামিয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মাথায় শিল দিয়ে বেশ কয়েকটি আঘাত করে। এরপর বিছানার পাশে কাপড় শুকানোর জন্য বাঁধা দড়ি নেওয়ার চেষ্টা করে লামিয়ার গলায় ফাঁস দেয়ার জন্য।
এ অবস্থায় লামিয়া শিল নিয়ে মাহফুজকে পাল্টা ছুড়ে মারে। তবে তা গিয়ে পড়ে তাছলিমার মেয়ে সুমাইয়ার মাথায়। এতে সুমাইয়া জেগে উঠে কান্না শুরু করে। মাহফুজ আবার শিল নিয়ে লামিয়ার মাথায় আঘাত করে এবং গলায় পা দিয়ে চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে লামিয়া মারা যায়। এরপর সে কাপড় শুকানোর দড়ি নিয়ে পাঁচ বছরের সুমাইয়ার গলায় পেঁচিয়ে তাকে হত্যা করে।
এদিকে এ সময় শান্ত স্কুল থেকে ফেরত আসে। তখন শান্তকেও মাহফুজ খুন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে সে শান্তর মায়ের লাশ করিডোর থেকে মোর্শেদুলের ঘরে নিয়ে আসে। ঘরের রক্তের ওপরে একটি সাদা চাদর দিয়ে রাখে। মাহফুজ দরজা খুলে দিলে শান্ত বাসায় প্রবেশ করে তার মায়ের কক্ষে ঢুকে মাকে খুঁজতে থাকে। তখন মাহফুজ পেছন থেকে শান্তকে ঘাড় ধরে দেওয়ালে প্রচণ্ড জোরে মাথা ঠুকে দেয়। শান্ত ফ্লোরে পড়ে দাপাতে থাকে। এ সময় একটি কাপড় দিয়ে শান্তর গলা পেঁচিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে।
সবাইকে হত্যার পর মাহফুজ শিল নিয়ে বাথরুমে গিয়ে বালতিতে তা ধুয়ে ফেলে। এরপর রান্নাঘরে গিয়ে পাটার ওপর শিল রেখে আসে। এরপর আবার বাথরুমে গিয়ে তার গায়ে লেগে থাকা রক্ত পরিষ্কার করে ও হাত-মুখ ধুয়ে নেয়। ঘরে এসে সে একটি শুকনো কাপড় দিয়ে হাত-মুখ মুছে ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে বের হয়ে চাবিটি সে ছুড়ে বাড়ির জলাধারে ফেলে দেয়। এরপর মাহফুজ মোর্শেদুলের হোসিয়ারি কারখানায় যায়। এখানে সে কাজ করে।
জবানবন্দিতে মাহফুজ আরো জানায়, তাকে জুতাপেটা করার পর ১২ দিন ক্ষোভে সে খাবার খায়নি, গোসলও করেনি। এরপরই সে হত্যাকান্ড ঘটায়। এ হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর সে ওই হোসিয়ারি কারখানার বাথরুমে গিয়ে গোসল করে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জানান, শফিকুলের ভাগিনা মাহফুজ পুলিশের কাছে খুনের বিষয়ে জানিয়েছে সে একাই পাঁচজনকে হত্যা করেছে। বাড়ির পাটার জন্য ব্যবহৃত পুঁতো দিয়ে আঘাত করে একের পর এক পাঁচজনকে হত্যা করেছে। বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ১টার দিকে নিজস্ব কার্যালয়ে পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন সংবাদ সম্মেলনে জানান, মামী লামিয়াকে ঢাকায়ও অনৈতিক সম্পর্কের চেষ্টা করে মাহফুজ। এ কারণে মামা শরীফ ঢাকার কলাবাগান থেকে পরিবার নিয়ে নারায়ণগঞ্জে ভাড়া বাড়িতে চলে আসেন।
শান্তর বাড়িতে আবার ফিরে আসার কারণ জানতে নগরীর বাবুরাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেলে স্কুলের প্রধান শিক্ষক শাহীদা আক্তার জানান, ওইদিন প্রচুর বোর্ডের বই স্কুলে চলে আসে। তাই ছাত্র-ছাত্রীরা চলে এলেও স্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। তাই শান্ত বাসায় চলে যায়। শান্ত এ স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ছিল। সকাল সাতটা থেকে তার স্কুল শুরু হয়।
প্রসঙ্গত, গত ১৬ জানুয়ারি ভোরে নগরীর দুই নম্বর বাবুরাইলের প্রবাসী ইসমাইলের পাঁচতলা বাড়ির একতলার পূর্ব দিকের ফ্ল্যাটে পাঁচজন খুন হয়। নিহতরা হচ্ছে তাছলিমা, তার ছেলে শান্ত, মেয়ে সুমাইয়া, তাছলিমার ভাই মোরশেদুল ও তাছলিমার জা লামিয়া।
তাছলিমার স্বামী শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় মাহফুজসহ তিনজনকে হত্যার সন্দেহভাজন হিসেবে উল্লেখ করা হয়।