আখতার-উজ-জামান ॥ নায়ক রাজ্জাকের ৭৫তম জন্মদিন আজ (শনিবার)। পুরো নাম : আব্দুর রাজ্জাক, ডাকনাম : রাজু/রাজা/আলতা ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারী পশ্চিমবঙ্গের (কলকাতা) নাগতলার টালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আকবর হোসেন ও মাতা নিসারুন নেসার তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে রাজু (রাজ্জাক) ছিল সবার ছোট। শিক্ষাজীবন শুরু কলকাতার খানপুর স্কুল ও কলেজ জীবন চারুচন্দ্র কলেজ।
সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় স্বরসতী পূজার কোন এক দিনে মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের জন্য তার গেম টিচার রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁকে বেছে নেন কেন্দ্রীয় নায়ক চরিত্রে। শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা নাটক বিদ্রোহীতে এক গাঁয়ের কিশোর চরিত্রের মধ্য দিয়ে আজকের নায়ক রাজ রাজ্জাকের অভিনয়ের সম্পৃক্ততা।
ষাটের দশকের মাঝের দিকে তিনি চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বাকি বছরগুলোতে এবং সত্তরের দশকেও তাঁকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রধান অভিনেতা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ১৯৬৪ সালে পাড়ি জমান পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকার চলচ্চিত্রে।
প্রথম দিকে রাজ্জাক পাকিস্তান টেলিভিশনে “ঘরোয়া” নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হন। মঞ্চের সঙ্গে জড়িত থাকলেও স্বপ্ন ছিল সিনেমাকে ঘিরে। টালিগঞ্জের সিনেমাশিল্পে তখন ছবি বিশ্বাস, উত্তম কুমার, সৌমিত্র, বিশ্বজিতদের যুগ। সেখানে হালকা-পাতলা সাধারণ রাজুর অভিনয় সুযোগ পাবার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না।
এর মধ্যে শুরু হলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এক সময় কলকাতায় থাকাটাই মুশকিল হয়ে পড়ে। ঐ সময় এক সুহৃদ রাজ্জাককে পরামর্শ দিলেন ঢাকায় চলে আসতে। বললেন, ঢাকার চলচ্চিত্র নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে। তখন রাজ্জাক ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা আবদুল জব্বার খানের পরিচিতি পান। তিনি রাজ্জাককে পাঠালেন তার কাছে একটা চিঠি দিয়ে। বলে দিলেন, ঢাকার কমলাপুরে থাকেন আবদুল জব্বার খান।
রাজ্জাক স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ঢাকায় এসে কমলাপুরেই প্রথমে বাসা নেন। চিঠি নিয়ে যোগাযোগ করার পর জব্বার খান ইকবাল ফিল্মস লিমিটেড-এ কাজ করার সুযোগ করে দেন রাজ্জাককে। সহকারী পরিচালকে কাজ। কামাল আহমেদের সহকারী পরিচালক হিসেবে তিনি প্রথম কাজ করেন ‘উজালা’ ছবিতে। শুরু হলো ঢাকায় রাজ্জাকের চলচ্চিত্র জীবন। সহকারী পরিচালক হলেও অভিনয়ের নেশাটা মাথা থেকে কখনো সরে না। এর মধ্যে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করেন বেশকিছু ছবিতে।
জহির রায়হানের সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় অসাধারণ লক্ষ্মীন্দর হয়ে দর্শকদের সামনে উপস্থিত হলেন। সঙ্গে অপূর্ব সুন্দরী বেহুলারূপী সুচন্দা। ১৯৬৬ সালে মুক্তি পেল ‘বেহুলা’। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন একজন নায়ক, যিনি পরবর্তী সময়ে এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের অপরিহার্য নায়কে পরিণত হলেন।
ঢাকার সিনেমা হলগুলোতে তখন পাক-ভারতীয় ছবির দাপট। ভারতের রাজকাপুর, দিলীপ কুমার, নার্গিস, পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী, জেবা, সুধির, শামীম আরা, ওয়াহিদ মুরাদ এবং কলকাতার ছবি বিশ্বাস, উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন, বিশ্বজিৎ, সৌমিত্রদের ছবির সঙ্গে পালা দিয়ে চলতে শুরু করল ঢাকার নির্মাতাদের নির্মিত ছবি।
আব্দুল জব্বার খান, রহমান, শবনম, খলিল, ফতেহ লোহানী, খান আতা, সুমিতা দেবী, আনোয়ার হোসেন, সুচন্দাদের সঙ্গে যোগ হলো আরো একটি নাম ‘রাজ্জাক’। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এখানে নির্মিত বেশিরভাগ ছবির নায়ক রাজ্জাক। দুই ভাই, আবির্ভাব, বাঁশরী, এতটুকু আশা, নীল আকাশের নীচে, যে আগুনে পুড়ি, পায়েল, দর্পচূর্ণ, যোগ বিয়োগ, ছদ্মবেশী, জীবন থেকে নেয়া, মধুর মিলন ইত্যাদি ছবির সাফল্যে রাজ্জাক হয়ে ওঠেন চলচ্চিত্রের অপরিহার্য নায়ক।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে পাক-ভারতীয় ছবির প্রদর্শন বন্ধ হলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব যাদের উপর বর্তায় তাঁদের একজন রাজ্জাক। রহমান, আজীম, আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে হাতে হাত রেখে, রাজ্জাক পথ চলতে শুরু করেন। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় রহমান একটি পা হারালে চলচ্চিত্রের রোমান্টিক নায়কের শূন্যতা রাজ্জাক একাই সামাল দেন। রাজ্জাক অসীম সাহস নিয়ে একের পর এক ছবিতে অভিনয় করতে থাকেন।
১৯৭৩ সালে জহিরুল হকের ‘রংবাজ’ ছবির নাম ভূমিকায় অভিনয় করে রাজ্জাক বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন ধারা প্রবর্তন করেন। তিনি সূচনা করেন চলচ্চিত্রের আধুনিক অ্যাকশন যুগেরও। ‘রংবাজ’ দিয়েই রাজ্জাক তাঁর অভিনয় জীবনে বৈচিত্র নিয়ে আসেন।
রাজ্জাক বলেন, ‘রংবাজ’ ছবির সাফল্যের পর আমার মনে হলো, দর্শকদের একঘেয়েমি থেকে মুক্ত রাখতে হলে সব ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। প্রয়োজনে দর্শকদের জন্য নিজের অর্থে ছবি নির্মাণ করতে হবে। তিনি আরো বলেন, প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার আগে আমি আরো কিছু বৈচিত্র্যময় চরিত্রে অভিনয় করেছি। এসব ছবির মধ্যে বেঈমান, ঝড়ের পাখি, অনির্বান, স্লোগান, এখানে আকাশ নীল, অতিথি, আলোর মিছিল, অবাক পৃথিবী, ত্রিরতন উল্লেখযোগ্য।
শুধু অ্যাকশান, রোমান্টিক নয় ত্রিরতেনর মতো কমেডি ছবিতেও অভিনয় করেছি। আমি চেয়েছি দর্শকদের আনন্দ দিতে। আজিজুর রহমানের ‘অতিথি’ ছবিতে আমি সেক্রিফাইসিং চরিত্রে অভিনয় করেছি। আলমগীর তখন নতুন অভিনেতা। তাঁকে তুলে ধরার জন্য শাবানার সঙ্গে রোমান্টিক চরিত্রে আমি মেনে নিয়েছি। একইভাবে নারায়ন ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’ ছবিতেও আমি ফারুককে রোমান্টিক চরিত্রে মেনে নিয়েছি। এর কারণ একটাই, নতুন নায়ক উঠে এলে আমার উপর চাপটা একটু কমবে এবং আনন্দের কথা আলমগীর, ফারুক দুজনেই কিন্তু উঠে এসেছে, জনপ্রিয়তা পেয়েছে। চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
অভিনেতা রাজ্জাকের বৈচিত্রময় সাহসী চরিত্রে অভিনয়ের কথা স্মরণীয় হয়ে আছে। ১৯৭৮ সালে রাজ্জাক যখন অবিশ্বাস্য জনপ্রিয় এক অভিনেতা। ওই সময় আজিজুর রহমানের ‘অশিতি’ ছবিতে দর্শকরা তাঁকে দেখলেন গ্রামের এক পাহারাদারের চরিত্রে। লুঙ্গি আর চার পকেটওয়ালা শার্ট পরে পুরো ছবিতে রাজ্জাক যা করলেন তখনকার সিনেমাপ্রেমী দর্শকরা কি তা আজও ভুলতে পেরেছে? ছবির শেষ দৃশ্যে মাস্টার সুমনের মৃত্যুর পর পুলিশের খাতায় রাজ্জাকের স্বার করার দৃশ্যটি দেখলে আজও সবার চোখে পানি আসে।
এর দুই বছর পর একই পরিচালক আজিজুর রহমানের ‘ছুটির ঘণ্টা’ ছবিতে স্কুলের দপ্তরির চরিত্রে রাজ্জাকের অসাধারণ অভিনয় কি মন থেকে মুছে ফেলা সম্ভব? বড় কথা ওই সময় যে অবস্থানে থেকে রাজ্জাক পাহারাদার কিংবা স্কুলের দপ্তরির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সেটা আজকের কোনো জনপ্রিয় নায়কের কাছ থেকে আশা করা যায় ?
আবার দিলীপ বিশ্বাসের ‘জিঞ্জির’, মতিন রহমানের ‘অন্ধ বিশ্বাস’ ছবির দুর্দান্ত দাপুটে অভিনেতার গুণ এখনকার ক’জন নায়কের মাঝে খুঁজে পাওয়া যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, রাজ্জাক খুব ভালো করে জানতেন কখন কী করতে হবে। নিজের পরিচালিত ‘বদনাম’ ছবিতে নায়ক জাফর ইকবালকে দিয়ে সবচেয়ে হিট গান ‘হয় যদি বদনাম হোক আরো’ গাইয়ে ছবির সাফল্যটা আদায় করে নিয়েছিলেন। কোন কাজ কখন কোন সময়ে কাকে দিয়ে করাতে হবে এটা ভালোভাবে জানেন বলেই চলচ্চিত্রে অশ্লীলতার সময়ে নিজের প্রযোজনা-পরিচালনায় ‘বাবা কেন চাকর’ বানিয়ে চলচ্চিত্রের চেহারাটাই বদলে দিয়েছিলেন। এই ছবি দ্বিতীয়বার কলকাতায় চালিয়েও সাফল্য নিয়ে এসেছেন।
রাজ্জাক আপদমস্তক চলচ্চিত্রের মানুষ তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে ছোট ছেলে সম্রাটকে সিনেমায় নিয়ে আসা। প্রথম ছবিতেই সফল সম্রাট এখন চলচ্চিত্রের ব্যস্ত নায়ক। রাজ্জাক তার দুই পুত্র বাপ্পারাজ এবং সম্রাটকে নিয়ে এক সঙ্গে অভিনয় করেছেন ‘কোটি টাকার ফকির’ ছবিতে। দুই ছেলেকে নিয়ে অভিনয় করাটাকেই রাজ্জাক তাঁর জীবনের সেরা প্রাপ্তি হিসেবে মনে করেন। তবে একটা কষ্ট আছে, সেটা হলো আমার বড়মেয়ে শম্পার অকাল মৃত্যু।
একজন আবদুর রাজ্জাক থেকে নায়করাজ রাজ্জাক-সেদিনের কমলাপুর থেকে গুলশান যশ, খ্যাতি, সম্মান, দর্শকদের অকৃত্রিম ভালোবাসা, চলচ্চিত্রের প্রতিটি মানুষের শ্রদ্ধা স্নেহ-ভালোবাসায় যে নায়করাজ রাজ্জাকের জন্ম সেই রাজ্জাকের এই অবস্থানে আসার পেছনে যাদের বেশি অবদান তাঁদের প্রসঙ্গে রাজ্জাক একটি চলচ্চিত্র প্রতিবেদনে বলেন, আমি নায়করাজ রাজ্জাক হয়েছি অনেকের অবদানে। তাদের মধ্যে আছেন আবদুল জব্বার খান, জহির রায়হান, নজরুল ইসলাম, আজহারুল আনোয়ার, আবদুল লতিফ বাচ্চু, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সুভাষ দত্ত, আজিজুর রহমান, আমজাদ হোসেন, চাষী নজরুল ইসলাম এবং বন্ধু মজিবুর রহমান চৌধুরী মজনু। এদের সহযোগিতা না পেলে আমি আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে পারতাম না। কৃতজ্ঞতা জানাই তাঁদেরকে যাদের ছবিতে আমি জাতীয় চলচ্চিত্র ও বাচসাস পুরস্কার পেয়েছি। প্রথম ক্যামেরার সামনে আত্মপ্রকাশ কলকাতার ‘শিলালিপি’ নামে একটি ছবিতে।
অভিনয়ে হাতেখড়ি : রঙ্গসভা নাট্যদলের হয়ে। রঙ্গসভার সভাপতি ছিলেন ছবি বিশ্বাস, পরিচালক ছিলেন পীযুষ বোস। বিয়ে : ১৯৬২, স্ত্রীর নাম : খায়রুন নেসা (লক্ষ্মী), ১৯৬৪, প্রথম অবস্থান : ঢাকার কমলাপুর, সন্তান : তিনপুত্র বাপ্পারাজ, বাপ্পি ও সম্রাট এবং দুই কন্যা শম্পা ও ময়না।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম মুক্তি পায় রাজ্জাক অভিনীত ছবি ‘মানুষের মন’। মোস্তফা মেহমুদ পরিচালিত এই ছবির ব্যবসায়িক সাফল্যে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নতুনভাবে জেগে উঠে। সেই সঙ্গে শুরু হয় নায়ক রাজ্জাকের যুগ। সেরা প্রাপ্তি পেলেন ইউনিসেফের শুভেচ্ছা দূত হওয়ার মধ্য দিয়ে।
ষাটের দশকের বাকি বছরগুলোতে এবং সত্তরের দশকেও তাঁকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রধান অভিনেতা হিসেবে বিবেচনা করা হত। এ সময়ে প্রায় ৫০০ ছবিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। সালাউদ্দিন প্রোডাকশন্সের (প্রযোজনায়) তেরো নাম্বার ফেকু অস্তাগড় লেন চলচ্চিত্রে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করে সবার কাছে নিজ মেধার পরিচয় দেন রাজ্জাক। পরবর্তীতে কার বউ, ডাক বাবু, আখেরী স্টেশন-সহ আরও বেশ ক’টি ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয়ও করে ফেলেন। পরে বেহুলা চলচ্চিত্রে তিনি নায়ক হিসেবে হিসেবে ঢালিউডে উপস্থিত হন সদর্পে। তিনি ৩০০টি বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। পরিচালনা করেছেন প্রায় ১৬টি চলচ্চিত্র।
(বিএফডিসি ও বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ার আর্কাইভ থেকে সংগৃীহত)